আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার ও ২০ বছরের যুদ্ধের অবসান ঘটার পর অনেকেই ভেবেছিলেন এবার হয়ত শান্তি ফিরবে দেশটিতে। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। সশস্ত্র গোষ্ঠী তালিবান কাবুল শাসনের ক্ষমতা পেলেও এখনো মেলেনি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ফলে মুখ থুবড়ে পড়েছে দেশটির অর্থনীতি। চরম সংকটে দিনাতিপাত করছে সাধারণ মানুষ।
এরই মধ্যে আফগানিস্তানে পাঁচ দশমিক নয় মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। এতে দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ মারাত্মকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে। ভূমিকম্পে প্রায় ২ হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে। নিহতের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়েছে। তাছাড়া এ ঘটনায় এক হাজার ৫০০ মানুষ আহত হয়েছেন। প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিতদের উদ্ধারকাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
দেশটির সংস্কৃতি ও তথ্য বিভাগ এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
এর আগে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা সালাহউদ্দিন আইয়ুবি জানিয়েছিলেন, দুর্গম পাহাড়ি এলাকার গ্রামগুলোতে মৃতের সংখ্যা বাড়তে পারে ও সম্পূর্ণ তথ্য পেতে আরও সময় লাগবে।
দক্ষিণ-পূর্ব পাকতিকা প্রদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং জাতিসংঘ জরুরি আশ্রয় ও খাদ্য সহায়তা প্রদানের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ভারী বৃষ্টি এবং সরঞ্জামের অভাবে ব্যহত হচ্ছে উদ্ধার তৎপরতা।
বেঁচে যাওয়া এবং উদ্ধারকারীরা জানিয়েছেন, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের কাছের গ্রামগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। সড়ক, মোবাইল ফোনের টাওয়ার ধ্বংস হয়ে গেছে আর আশঙ্কা করা হচ্ছে নিহতের সংখ্যা আরও অনেক বাড়তে পারে।
বুধবার (২২ জুন) ভোররাতে মানুষজন ঘুমিয়ে থাকার সময় আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তে আঘাত হানে প্রবল এই ভূমিকম্প। পাকিস্তান আবহাওয়া অধিদপ্তরের ন্যাশনাল সিসমিক মনিটরিং সেন্টার এবং ইউরোপীয় ভূমধ্যসাগরীয় ভূকম্পন কেন্দ্র (ইএমএসসি) জানিয়েছে, রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ১। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) অবশ্য ভূমিকম্পের মাত্রা ৫ দশমিক ৯ রেকর্ড করেছে।
ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল আফগানিস্তানের খোস্ত শহরে এবং কেন্দ্র ভূপৃষ্ঠ থেকে ৪৪ কিলোমিটার গভীরে।
ইএমএসসি জানিয়েছে, প্রায় ৫০০ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে এই ভূমিকম্পের প্রভাব অনুভূত হয়েছে। এতে আফগানিস্তানের পাশাপাশি কেঁপে ওঠে প্রতিবেশী পাকিস্তান এবং ভারতও।
ভোররাতে ভূমিকম্পটি আঘাত হানায় সেসময় ওই অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষই ঘুমিয়ে ছিলেন। ফলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধসে পড়া বাড়িঘরের নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারান অনেকে।
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে, ঘণ্টার মধ্যে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি অবনতি হচ্ছে।
সংস্থাটির কমিউনিকেশন, অ্যাডভোকেসি ও সিভিক এনগেজমেন্টের প্রধান সামান্থা মর্ট বলেন, প্রত্যন্ত প্রদেশগুলোতে প্রবেশ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ সেখানে সম্প্রতি ভারি বৃষ্টির ফলে ভূমি ধসের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ইউনিসেফের কিছু দল ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে।
তিনি বলেন, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া লোকজনকে উদ্ধার জন্য এই মুহূর্তে মরিয়া প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। এরপর তাদের হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। আহতদের জরুরি প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
এদিকেন ভয়াবহ ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আন্তর্জাতিক সহায়তার আবেদন জানিয়েছে আফগানিস্তানে শাসকগোষ্ঠী তালিবান।
তালিবানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আব্দুল কাহার বালখি বলেছেন আফগানিস্তান মানবিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রয়েছে এবং সরকার ‘আর্থিকভাবে জনগণকে প্রয়োজনীয় পরিমাণে সহায়তা করতে অক্ষম’। ত্রাণ সংস্থা, প্রতিবেশি দেশ এবং বিশ্ব শক্তিগুলোর কাছে সহায়তার আবেদন জানান তিনি। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘সাহায্যের পরিমাণ অনেক বড় আকারে বাড়ানো দরকার কারণ এটি একটি বিধ্বংসী ভূমিকম্প যা কয়েক দশকের মধ্যে ধরে দেখা যায়নি’।
আফগানিস্তান খুবই ভূমিকম্পপ্রবণ একটি দেশ। জাতিসংঘের তথ্যমতে, গত ১০ বছরে দেশটিতে ভূমিকম্পে সাত হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। ভূমিকম্পে প্রতি বছর আফগানিস্তানে গড়ে ৫৬০ জন মারা যান ।
আফগানিস্তানের ১৮ প্রদেশে বন্যা
বুধবার আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে ৬ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা এরই মধ্যে এক হাজার ছাড়িয়েছে। ভূমিকম্পের মতো ভয়াবহ এ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে বন্যার কবলে পড়েছে আফগানিস্তানের মানুষ।
আফগানিস্তানের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে দেশটির সংবাদমাধ্যম টোলো নিউজ জানিয়েছে, আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশের ১৮টিতেই দেখা দিয়েছে আকস্মিক বন্যা। এ বন্যায় সে দেশে এখন পর্যন্ত ৪০০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়।
আফগানিস্তানের বন্যাকবলিত প্রদেশগুলো হলো—কুনার, নানগারহার, নুরিস্তান, লাঘমান, পানশির, পারওয়ান, কাবুল, কাপিসা, ময়দান ওয়ার্দাক, বামিয়ান, গজনি, লোগার, সামানগান, সার-ই-পুল, তাখার, পাকতিয়া ও দাইকুন্দি।
কুন্দুজের অধিবাসী আহমাদুল্লাহ টোলো নিউজকে বলেন, কুন্দুজের শত শত একর জমি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে এবং এখনও বন্যা পরিস্থিতির দৃশ্যমান কোনো উন্নতি হয়নি।
নানগারহার প্রদেশেল আর্চিন জেলার বাসিন্দা হামিদুল্লাহ শিনওয়ারি বলেন, গত মঙ্গলবার রাত থেকে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। অতি বর্ষণে বাড়ির ছাদ ধসে আর্চিন জেলায় এক জনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন আরও পাঁচ জন।
আফগানিস্তানের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী মাওলাউই শরফুদ্দিন মুসলিম টোলো নিউজকে বলেন, অতি বর্ষণ ও আকস্মিক বন্যায় আহতদের বেশির ভাগকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বন্যার কারণে যাদের ঘরবাড়ি ভেঙে পড়েছে, তাদের সরকারের পক্ষ থেকে তাঁবু দেওয়া হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০০
আপনার মতামত জানানঃ