করোনা মহামারি যখন বিশ্বসম্প্রদায় প্রায় কাটিয়ে উঠেছিল, তখনই শুরু হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের জেরে জ্বালানি ও খাদ্যের দাম সারা বিশ্বেই হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। এর জেরে এখন যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশের মানুষের এখন নানা সংকট ভোগ করতে হচ্ছে।
এদিকে বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে দেশ জুড়ে রেল ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে যুক্তরাজ্যের রেল, নৌপথ ও পরিবহন কর্মীদের সর্বোচ্চ সংগঠন ইউনিয়ন ফর রেল, মেরিয়টাইম অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স (আরএমটি)।
সোমবার এক বিবৃতিতে আরএমটির রেল ইউনিয়ন বিভাগ জানিয়েছে, আগামী মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যজুড়ে সর্বাত্মক রেল ধর্মঘট হবে এবং আরএমটির নেতৃত্বে ৫০ হাজারেরও বেশি রেলকর্মী সেই ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করবেন।
যুক্তরাজ্যে সর্বশেষ দেশজুড়ে রেল ধর্মঘট হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। তার ৩৩ বছর ফর ফের দেশটিতে ঘটছে এই ঘটনা।
বার্তাসংস্থা এএফপিকে আরএমটি নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন, করোনা মহামারির ২ বছর ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ব্রিটেনে মুদ্রাস্ফীতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে এবং তার প্রভাবে প্রতিদিনই বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম। বর্তামনে যুক্তরাজ্যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি গত ৪০ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে; কিন্তু রেলকর্মীদের বেতন এক পয়সাও বাড়েনি।
আরএমটির সেক্রেটারি মাইক লিঞ্চ ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজকে রোববার এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, রেলকর্মীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবি দীর্ঘদিনের। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সরকারের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আরএমটি নেতাদের বৈঠক হয়েছিল; এবং সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে, চলতি বছরের শুরু থেকে রেলকর্মীদের বেতন ৭ দশমিক ১ শতাংশ বাড়ানো হবে।
‘কিন্তু বছরের ছয় মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও আমরা সরকারের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন দেখতে পাইনি। এদিকে, প্রতিদিনই বাড়ছে দ্রব্যমূল্য। জীবন-যাপন ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে এবং ন্যায্য মজুরির দাবি আদায়ের জন্য এই মুহূর্তে ধর্মঘটে যাওয়া ছাড়া রেলকর্মীদের সামনে আর কোনো বিকল্প পথ খোলা নেই।’
বর্তামনে যুক্তরাজ্যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি গত ৪০ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে; কিন্তু রেলকর্মীদের বেতন এক পয়সাও বাড়েনি।
ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো যুক্তরাজ্যের যোগাযোগ ব্যাবস্থাও ব্যাপকভাবে রেল ও পাতালরেলনির্ভর। তার ওপর করোনা মহামারির দু্ই বছরে বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকায় দেশটির অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল খাতের বিপুল সংখ্যক শ্রমিককে ছাঁটাই করায় বর্তমানে দেশটির অভ্যন্তরীণ বিমান পরিষেবাও হয়ে পড়েছে সীমিতি।
এ কারণে মহামারি পরবর্তী অর্থনীতি সচল করার যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, তাতে রেলের ওপর সাধারণ জনগণের নির্ভরতা আগের চেয়ে বেড়েছে কয়েকগুণ।
উপরন্তু যুক্তরাজ্যের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে এখন চলছে বার্ষিক পরীক্ষা। টানা তিন দিনের রেল ধর্মঘটে পুরো এলোমেলো হয়ে পড়বে পরীক্ষার সময়সূচি, যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশটির লাখ লাখ স্কুল শিক্ষার্থী।
ব্রিটেনের পরিবহন মন্ত্রী গ্র্যান্ট শ্যাপস এএফপিকে বলেন, ‘রেলকর্মীদের বেতন বাড়ানো যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল—তা অবশ্যই মানা হবে, তবে এ জন্য আরও কিছু সময়ের প্রয়োজন; কারণ, দেশের অর্থনীতি সবেমাত্র সচল হয়েছে।’
‘আমরা এ ব্যাপারে আলোচনার জন্য গত ছয় মাসে একাধিকবার আরএমটি নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি, কিন্তু তারা সেই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছেন,’ এএফপিকে বলেন গ্র্যান্ট শ্যাপস।
মূল্যস্ফীতির প্রেতাত্মা ভর করেছে প্রায় সব দেশেই। বাদ পড়েনি ব্রিটেন। বর্তমানে ব্রিটেনসহ পুরো যুক্তরাজ্যে মূল্যস্ফীতি ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে মার্গারেট থ্যাচার প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ে এত বেশি পণ্যমূল্যের চাপ দেখা গিয়েছিল সেখানে।
বিশ্লেষকের বলছেন, এই মুদ্রাস্ফীতি দেশটির নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ জীবনধারণের ক্ষেত্রে সব ধরনের খরচ বাড়াতে পারে।
গত এপ্রিল মাসে দেশটিতে বার্ষিক ভোক্তা মূল্যস্ফীতি পৌঁছেছে ৯ শতাংশে। ১৯৮২ সালের পর থেকে এই হার সর্বোচ্চ। একইসঙ্গে আশির দশকের শেষের দিকে ব্রিটেনে সরকারি ভাবে মূল্যস্ফীতির হিসাব রাখা শুরু হওয়ার পর থেকেও এই হার সর্বোচ্চ।
এরমধ্যেই জীবনযাপনের খরচ এতটা বেড়েছে যে গ্যাস/বিদ্যুৎ বিল বাঁচাতে ঘর উষ্ণ রাখার হিটিং সিস্টেম পারতপক্ষে বন্ধ রাখছেন প্রতি তিনজনের মধ্যে দুজন ব্রিটিশ। গাড়ি চালানো কমিয়েছেন ৫০ শতাংশ এবং প্রতি ২৫ শতাংশ কোনো কোনো বেলা না খেয়ে খরচ বাঁচানোর চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছেন।
নিম্ন আয়ের নাগরিকদের এক-তৃতীয়াংশ জানিয়েছেন, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির কারণে তারা কোনো কোনো বেলার খাবার খেতে পারেননি। জরিপ সংস্থা ইপসোসের এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে দেশটিতে উদ্বেগ এখন গত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। জরিপে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ ব্রিটিশ আগামী ছয় মাসে নিত্যপণ্যের মূল্য আরও চড়া হওয়ার শঙ্কা ব্যক্ত করেন।
ইপসোসের রাজনৈতিক গবেষণা বিষয়ক প্রধান গিডন স্কিনার বলেন, “অর্থনৈতিক পূর্বাভাসের ভিত্তিতে আগামী দিনগুলোয় আরও উদ্বেগজনক পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে তা হয়তো বলাই যায়। এতে মানুষের জীবনযাপনে উচ্চ ব্যয়ের সংকট দূর করতে সরকারের ওপর আরও বেশি পদক্ষেপ নেওয়ার চাপ বাড়বে।”
মূলত তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণেই এই হারে মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ ইউরোপের অনেক দেশ তেল ও গ্যাসের ক্ষেত্রে রাশিয়ার ওপর প্রবলভাবে নির্ভরশীল। ফলে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরেই সেসব দেশের জ্বালানিখাতে ব্যয় বাড়তে থাকে। আর তারই প্রতিফলন ঘটছে সার্বিক অর্থনীতিতে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১১২
আপনার মতামত জানানঃ