শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ খাদ্য সংকট তৈরি হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানিয়েছে, শ্রীলঙ্কার প্রায় ৫০ লাখ বা ২২ শতাংশ মানুষ খাদ্যের অভাবে ভুগছে। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকা এমন জনগোষ্ঠীর সহায়তা জরুরি বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)।
ডব্লিউএফপির সাম্প্রতিক সমীক্ষাগুলোয় উঠে এসেছে, পুষ্টিকর খাবার যেমন শাক-সবজি, ফলমূল এবং আমিষসমৃদ্ধ খাদ্যপণ্য এখন অনেক নিম্ন আয়ের পরিবারের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
২ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার দেশটির ৮৬ শতাংশ পরিবার নতুন এই খাদ্যসংকটের সঙ্গে অভ্যস্ত হতে চেষ্টা করছে। এদের অনেকে পরিমাণে কম পুষ্টিকর খাদ্য খাচ্ছেন, এমনকি দুই-এক বেলার খাবার বাদ দিচ্ছেন।
এর আগে শুক্রবার দেশটির প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে জানিয়েছেন, প্রায় ৪০ থেকে ৫০ লাখ মানুষ খাদ্যসংকটের কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
দেশটির ইংরেজি দৈনিক ডেইলি মিরর এ খবর প্রকাশ করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির এক বৈঠকে রনিল বিক্রমাসিংহে বলেন, ‘খাদ্যসংকট ৪ থেকে ৫ মিলিয়ন নাগরিককে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করার হুমকি থাকলেও তা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।’
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলবিষয়ক ডব্লিউএফপির উপপরিচালক অ্যান্থিয়া ওয়েব বলেন, ‘গর্ভবতী মায়েদের প্রতিদিন পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে, কিন্তু সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারের এমন মায়েদের জন্য মৌলিক জিনিসগুলোর জোগান দেয়া এখন অনেক কঠিনতর হয়ে উঠেছে। যখন তারা এক বেলার খাবার বাদ দেন তখন তাদের নিজেদের ও তাদের অনাগত সন্তানরা স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে।’
পুষ্টিকর খাবার যেমন শাক-সবজি, ফলমূল এবং আমিষসমৃদ্ধ খাদ্যপণ্য এখন অনেক নিম্ন আয়ের পরিবারের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে এই সংকট যেখানে দেশটি এরই মধ্যে আমদানি করা খাদ্যসামগ্রীর ঘাটতির সঙ্গে লড়াই করছে। এখন অভ্যন্তরীণ উৎপাদিত খাদ্যেরও ব্যাপক ঘাটতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে তারা। শ্রীলঙ্কার কাউন্সিল ফর এগ্রিকালচারাল রিসার্চ পলিসির প্রেসিডেন্ট গামিনি সেনানায়েকে বলেন, খাদ্যের দিক থেকে আগামী কয়েক মাসে খুব কঠিন সময় আসবে। খাদ্য ঘাটতি হবে… আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।
দুই কোটি ২০ লাখ মানুষের দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা এক সময় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। কিন্তু সার ও কীটনাশকসহ সব ধরনের কৃত্রিম কৃষি রাসায়নিক পণ্য নিষিদ্ধ করেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। দেশকে সম্পূর্ণরূপে জৈব কৃষিতে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা ছিল তার। এটিই শ্রীলঙ্কার খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। গত বছরের মে মাসে রাতারাতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল গোতাবায়ার সরকার।
দেশটির ২০ লাখ কৃষক তখন পর্যন্ত ভর্তুকিযুক্ত রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। তারা হঠাৎ করেই বিপাকে পড়েছেন। দেশের ৩০ শতাংশ শ্রমশক্তিই এই কৃষকরা। তারা বলছেন, সরকার জৈব সারের উৎপাদন বাড়ায়নি বা তাদের চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত মাটির পুষ্টি উপাদানও আমদানি করেনি। যার ফলশ্রুতিতে গত মার্চের শেষের দিকে কৃষি উৎপাদনে নাটকীয় পতন ঘটে। ফসলের জন্য সরকারি পরিসংখ্যান না পাওয়া গেলেও বিশেষজ্ঞরা ফলনের উপর নির্ভর করে ২০ থেকে ৭০ শতাংশ উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে বলে ধারণা করছেন।
প্রধান উৎপাদিত ফসল ধানের উৎপাদন ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে গেছে। যার ফলে চলতি বছর সরকার তিন লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি করেছে। যেখানে ২০২০ সালে আমদানি করা হয়েছে ১৪ হাজার মেট্রিক টন। তাছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে সরকার জ্বালানি ও ওষুধসহ প্রয়োজনীয় আমদানির জন্য অর্থ প্রদান করতে ব্যর্থ হয়। ঘাটতির কারণে আকাশছোঁয়া মূল্যস্ফীতি, ডিজেলের জন্য দীর্ঘ সারি, ১৩ ঘন্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন, এ ধরনের সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে দেশটিতে।
স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে ধুঁকতে থাকা দেশটিতে গত ১৯ এপ্রিল একযোগে বাড়ানো হয় চাল, পাউরুটি ও বিশেষ ধরনের কোট্টু রুটির দাম। একই সঙ্গে বাড়ানো হয় বাস ভাড়া।
সংবাদ মাধ্যম সিলন টুডের প্রতিবেদন বলা হয়, মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে কার্যকর হয়েছে নতুন এই মূল্য ও ভাড়া। কমপক্ষে ২০ থেকে ৩৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে এইসব নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য ও সেবার খরচ।
প্যাকেটজাত চাল ও জনপ্রিয় কোট্টু রুটির দাম বাড়ানো হয় ২০ শতাংশ।
দেশটির রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি আসেলা সম্পাথ বলেন, ‘জ্বালানি এবং গমের আটার দাম বৃদ্ধির পরে মূল্য সংশোধনের এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’
তবে তিনি বলেন, স্ন্যাকসজাতীয় অন্যান্য ছোট খাবারের দাম বাড়ানো হবে না।
দেশটির প্রভাবশালী সংগঠন অল সিলন বেকারি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন (এসিবিওএ) পাউরুটির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রতিটি পাউরুটির দাম ৩০ রুপি বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৪০ রুপি।
ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট কমিশন বলেছে যে ন্যূনতম বাস ভাড়া ২০ রুপি থেকে বাড়িয়ে করা হয় ২৭ রুপি।
এর আগে বাস ভাড়া সংশোধনের বিষয়ে পরিবহন মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাস মালিক ও অন্যান্য পক্ষের আলোচনার পর এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
দেশ স্বাধীনের পর সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে ধুঁকছে দেশটি। নিত্যপণ্যের লাগামহীন দামে দিশেহারা মানুষ। কাগজের সংকটে বন্ধ হচ্ছে সংবাদপত্রের প্রকাশনা, বাতিল হয়েছে স্কুলের পরীক্ষা। ভয়াবহ মন্দায় প্রাণ বাঁচাতে সাগর পাড়ি দিয়ে ভারতের তালিম নাড়ুতে আশ্রয় নিচ্ছেন অনেকে।
শ্রীলঙ্কার এমন দুর্দশার জন্য সরকারি অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে এবং রাজাপাকসে ও তার প্রতাপশালী ভাইদের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর দাবিতে কয়েক হাজার মানুষ রাস্তায় নামেন। বিক্ষোভের মুখে প্রেসিডেন্টের ভাই বাসিল রাজাপাকসে ও চামাল রাজাপাকসে, একই সঙ্গে নামাল রাজাপাকসে গত মার্চ মাসে মন্ত্রিসভা ছেড়ে দেন। এরপর আন্দোলনের চাপে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন প্রেসিডেন্টের ভাই ও প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। যদিও প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া বহাল তবিয়তে আছেন এবং তিনি এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। বরং অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য করোনা মহামারি, ঋণের বোঝা ও পর্যটন খাতে ধসের মতো অজুহাত দেখানো হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সামনে শ্রীলঙ্কার সংকট আরও তীব্র হচ্ছে। কারণ খাদ্য মূল্যস্ফীতি, যা বর্তমানে প্রায় ৩০ শতাংশে রয়েছে, তা আরও বাড়তে পারে।
শ্রীলঙ্কার পেরাদেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগের অধ্যাপক জিউইকা ওয়েরাহেওয়া বলেন, খাদ্য সংকট বড় আকার ধারণ করছে। শ্রীলঙ্কার এই খাদ্য সংকটকে ‘মানবসৃষ্ট’ বলেও অভিহিত করেন তিনি। পরবর্তী চার অথবা ছয় মাস শ্রীলঙ্কার জন্য আরও কঠিন সময় বলেও সতর্ক করেন এই অধ্যাপক।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪০
আপনার মতামত জানানঃ