১৮৭৪ সাল। আধুনিক মানের বড় জাহাজ তখনও কেবল স্বপ্ন। সমুদ্রপথে যাতায়াতের জন্য পালতোলা এক ধরনের দ্রুতগতিসম্পন্ন ক্লিপার জাহাজই সেসময় ভাগ্যান্বেষী মানুষজনের একমাত্র ভরসা ছিল। ক্রুসেডার নামে তেমনই এক মস্ত বড় পালতোলা ক্লিপার জাহাজে করে একদল ডাকাবুকো ইউরোপীয় পাড়ি জমিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডের দিকে। দলে যাত্রীর সংখ্যা ছিল মোট ২১৪ জন। এছাড়া ক্যাপ্টেন আর নাবিক মিলে আরো জনা ৫০।
সেকালে পালতোলা জাহাজের গতি খুব বেশি ছিল না। ইংল্যান্ড থেকে নিউজিল্যান্ড যেতেই লেগে যেত কয়েক মাস। ক্রুসেডার তখন যাত্রী নিয়ে মাঝসমুদ্রে বেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। নিউজিল্যান্ডের কাছাকাছি উপসাগর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে প্রায়। সব ঠিক থাকলে আর মোটামুটি দিন তিনেকের মধ্যেই তাদের জাহাজ তীরে ভিড়বে। ভালোয় ভালোয় গন্তব্যে পৌঁছনো যাবে ভেবে খুশি ছিল সবাই। যাত্রী-নাবিক নির্বিশেষে খাওয়া-দাওয়া, গান বাজনার হল্লা চলছে ডেকের উপর। ঠিক এমনই সময় ঘটে যায় এক আচমকা বিপর্যয়।
উপসাগরে ঢোকার পরপরই নিচের ইঞ্জিনঘর থেকে চোখেমুখে আতঙ্ক নিয়ে ছুটে আসে নাবিকেরা। খবর গুরুতর। জানা যায়, কোনো এক অজানা কারণে জাহাজের তলা দিয়ে হু হু করে সমুদ্রের লোনা পানি ঢুকে আসছে জাহাজের পেটে। একটুও দেরি না করে জাহাজের ক্যাপ্টেন এবং তার সহযোগী মিস্ত্রি কারিগরেরা ছুটে যায় ঘটনাস্থলে। ততক্ষণে জাহাজের একতলার অংশ সমুদ্রের পানিতে পুরো ভরে গেছে। সেকালে কাঠ দিয়েই সমস্ত নৌকো, জাহাজের পাটাতন তৈরি হতো। নাবিকেরা অনুমান করলেন দীর্ঘদিন পানিতে ভাসমান থাকার ফলে ক্রুসেডার জাহাজের নিচের পাটাতনের কাঠ হয়তো পচে গিয়েছে, অথবা কোনো কারণে পানির তলায় শক্ত কিছুতে ধাক্কা লেগেছে, যার ফলে তৈরি হয়েছে বেশ বড় একটা গর্ত। আর সেই মস্ত বড় গর্ত দিয়েই হুড়মুড় করে জাহাজে ঢুকতে শুরু করেছে উপসাগরের ঈষৎ ঘোলাটে নোনা পানি।
একে গভীর সমুদ্র, আশেপাশে নোঙর ফেলার মতো একটুকরো জায়গাও নেই, তার ওপর জাহাজের তলদেশে ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় এমন এক ভয়ংকর ফাটল! চোখে অন্ধকার দেখলেন ক্যাপ্টেন। এ ফাটল সারানো যে দুঃসাধ্য ব্যাপার নিজের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় সে কথা তিনি শুরুতেই বুঝেছেন। আর যে পরিমাণ পানি ঢুকতে শুরু করেছে তাতে এক্ষুনি গর্ত বন্ধ করা না গেলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জাহাজ ডুবে যাবার সমূহ সম্ভাবনা। তবে উপায়!
এই দুর্ঘটনার খবর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল সারা জাহাজে। আনন্দ হৈ-হল্লা থেমে গিয়ে যাত্রীদের মধ্যে শুরু হলো দমবন্ধ ভয় আর আর্তচিৎকার। নাবিকেরাও বুঝতে পারছিলেন, আর রক্ষা নেই। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজ নির্ঘাত ডুবে যাবে, আর সেইসঙ্গে সলিলসমাধি ঘটবে প্রায় তিনশো লোকের। তাও শেষ চেষ্টা তো করতে হয়! ক্যাপ্টেনের নির্দেশে জাহাজের কর্মীরা প্রাণপ্রণ চেষ্টা করতে লাগল ছিদ্র বন্ধ করার। কিন্তু অত বড় গর্ত অত অল্প সময়ে মেরামত করা কার্যত অসম্ভব। ফাটলটা হয়েছিল জাহাজের একেবারে তলদেশের মাঝখানে। উপচে আসা পানিতের ধাক্কা সামলে সেখানে গিয়ে গর্ত মেরামত করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।
কিন্তু হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে তো হবে না। অতঃপর নেওয়া হলো বিকল্প ব্যবস্থা। জাহাজে গোটা পাঁচেক হাতে চালানো পাম্প ছিল। পাম্প করে জাহাজের তলার পানি সেঁচে ফেলার নির্দেশ দিলেন ক্যাপ্টেন। যত পানি ঢুকবে ততই দ্রুততার সঙ্গে সে পানি টেনে বাইরে ফেলা হবে। এতে হয়তো শেষপর্যন্ত ডুবে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচানো যাবে যাত্রীসহ জাহাজটাকে। কিন্তু বিধি বাম। দেখা গেল হাতে চালানো পাঁচটি পাম্প থেকে যে পরিমাণ পানি সেঁচে ফেলা যাচ্ছে, জাহাজের তলার ফুটো দিয়ে পানি ঢুকছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। তাই পানি বের করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। কিছুতেই কমানো যাচ্ছেনা পাটাতনের পানি।
কথায় বলে না, বিপদ যখন আসে একসঙ্গে আসে। এক্ষেত্রেও হলো খানিকটা তাই। হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে পাম্প চালাতে গিয়ে তাড়াহুড়োয় দুটো পাম্প ভেঙে ফেলে নাবিকেরা। একে তো পাঁচটা পাম্প চালিয়েও পানি বের করা যাচ্ছিল না, তার উপর দুটো পাম্প নষ্ট হয়ে যাওয়ায় খুব ভয়ংকর অবস্থা তৈরি হলো। মাত্র তিনটে পাম্প দিয়ে আর কতটুকু পানিই বা সেচ করা যাবে? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের মৃত্যু দেখা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
ক্যাপ্টেন নির্দেশ দিলেন জাহাজে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা সমস্ত যাত্রীকে ডেকে তুলে আনতে। যাত্রীদের মধ্যে বেশ কিছু নারী আর শিশুও ছিল। প্রাথমিকভাবে শুরু হলো তাদের বাঁচানোর চেষ্টা। জাহাজে গোটা কয়েক লাইফবোট ছিল। পরিকল্পনা নেওয়া হলো অসহায় নারী আর শিশুদের এই লাইফবোটে করে সমুদ্রে নামিয়ে দেওয়া হবে। তারপর যা আছে কপালে…
নারী এবং শিশুদের তোলা হলো ডেকে। কিন্তু এর পরপরই ঘটল সেই অলৌকিক কাণ্ড! হঠাৎ করে জাহাজের একেবারে নিচের তলা থেকে ছুটে এল কয়েকজন নাবিক। তারা আনন্দে চিৎকার করে ক্যাপ্টেনকে ডাকতে লাগল। ক্যাপ্টেন তো অবাক! চারপাশের এই মৃত্যুর আবহে মাথাটা বিগড়েছে না কি নাবিকগুলোর! চিৎকারের কারণ জিজ্ঞেস করতে হলো না, তার আগেই প্রায় সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল তারা- ‘আমরা বোধহয় এ যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেলাম ক্যাপ্টেন!’ মনে মনে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন ক্যাম্পেন, ‘এই ভয়ংকর বিপদের মুহূর্তে রসিকতা করতে তোমাদের লজ্জা করছে না? না কি আসন্ন মৃত্যুর ভয়ে নিজেরাই পাগল হয়ে গেছ?’
ধমক খেয়ে নাবিকেরা যা বলল তার মোদ্দা কথা এই, কার্যকারণ তারাও কিছু বুঝতে পারছে না, তবে অবাক কাণ্ড হলেও এটাই সত্যি যে জাহাজের তলায় কোনো এক অজানা কারণে পানি ঢোকা কমতে শুরু করেছে। যেখানে আগে পাঁচটা পাম্প চালিয়েও জাহাজের তলার পানি কমানো যাচ্ছিল না, সেখানে মাত্র তিনটা পাম্প দিয়েই সেঁচে ফেলা যাচ্ছে জাহাজের পেটের পানি। পাটাতনের পানি কমতেই জাহাজ আবার ধীরে ধীরে ভাসতে শুরু করেছে।
এমন অবিশ্বাস্য ঘটনাও কি সম্ভব! আর কালবিলম্ব না করে নাবিকদের সঙ্গে নিয়ে ক্যাপ্টেন নিজেই গেলেন ব্যাপারটা স্বচক্ষে দেখে আসতে। দেখলেন, তার নির্দেশ মতো তিনটি হস্তচালিত পাম্পে তখনও একটানা পানিসেচের কাজ চলছে। কিন্তু বিস্ময় অন্যত্র। ক্যাপ্টেন দেখলেন জাহাজের খোলে জমা পানির স্তর অবিশ্বাস্যভাবে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। যেভাবে পাম্প চলছে আর পানি নামছে তাতে আর ঘণ্টা কয়েক এভাবে টানতে পারলেই আর ডুবে যাওয়ার ভয় থাকবে না। প্রায় স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসবে পাটাতন। কিন্তু ক্যাপ্টেনের মনে তখন একটাই প্রশ্ন। এটা সম্ভব হলো কী করে? জাহাজের ফাটল কি ইতিমধ্যেই সারিয়ে বন্ধ করেছে কেউ? তাই বা কী করে সম্ভব! সমুদ্রের পানিতে নেমে স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জাহাজের তলার সেই গর্ত বন্ধ করা প্রায় অবিশ্বাস্য। তাহলে পানি ঢোকা বন্ধ হলো কোনো ম্যাজিকে?
কারণ যাই হোক, জাহাজের সবাই সম্ভবত বেঁচে যাচ্ছে এটাই এখন তাদের কাছে আনন্দের খবর। নির্ঘাত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার আবেগে তখন ক্যাপ্টেনের চোখেও পানি। দুহাত তুলে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালেন তিনি এই অযাচিত দয়ার জন্য।
আর কয়েকঘণ্টার মধ্যেই পাটাতনের পানি প্রায় নেমে গেল। যাত্রীদের নিয়ে আবার চলতে শুরু করল ক্রুসেডার। এমন অলৌকিকভাবে বেঁচে যাবে ভাবেনি কেউ। এ যেন দ্বিতীয় জীবন পাওয়া! তিনদিন পর জাহাজ বন্দরে ভিড়লে একে একে সব যাত্রী নিরাপদে নেমে গেল নতুন দেশের মাটিতে। কিন্তু তখনও কেউ জানতে পারেনি, কোনো অলৌকিক শক্তিবলে এই সমূহ সর্বনাশ থেকে রক্ষা পেল এতগুলো জীবন?
যাত্রীদের নামিয়ে দিলেও ক্যাপ্টেনের কাজ শেষ হয়নি তখনও। খটকাও ছিল কিছু। অতঃপর জাহাজ মেরামত করার জন্য নিয়ে এলেন ক্যাপ্টেন। চক্র লাগিয়ে জাহাজটিকে যখন শূন্যে তোলা হলো তখনই বোঝা গেল আসল রহস্য। উপস্থিত সবাই লক্ষ করল জাহাজের তলা থেকে কী যেন ঝুলছে! প্রথমে অতিকায় বড় সামুদ্রিক মাছ মনে হলেও ওটা ছিল একটা বেশ বড় মাপের সামুদ্রিক হাঙরের মৃতদেহ। হাঙরের দেহ ওভাবে ঝুলতে দেখে বলাই বাহুল্য তখন বিস্ময়ে হতোবাক সবাই।
সত্যি কথা বলতে, হাঙর গহিন সমুদ্রের এক ভয়াল দানব। নাবিকদের ত্রাসও বটে। এরা যেমন বুদ্ধিমান, তেমনই হিংস্র শিকারি। রহস্যও কম জড়িয়ে নেই এদের ঘিরে। সমুদ্রের বুকে নিমেষে ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে এসে শিকারকে আক্রমণ করায় এদের জুড়ি মেলা ভার। কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই এদের ভয়াল দাঁতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় যেকোনো প্রাণীর শরীর। গভীর সমুদ্রে এরা অনেক সময় ছোট জাহাজকেও আক্রমণ করে বসে। বিশেষত যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, তখন সমুদ্রসফরে এসে হাঙরের মুখে পড়াকেই সবচেয়ে বেশি ভয় পেত নাবিকেরা।
যাহোক, জাহাজ পানি থেকে মাটিতে তুলতেই আবিষ্কৃত হলো প্রকৃত সত্য। জানা গেল, জাহাজের ফাটল বন্ধ হয়ে যাওয়ার মূলে আছে এই হাঙরই। আসলে জাহাজের পাটাতনে যে গর্তটা হয়েছিল সেটা আকারে বেশ বড়। জাহাজের পেটে হুড়মুড় করে পানি ঢুকছিল ঐ গর্ত দিয়েই। এর ফলে সেখানে একটা স্রোতের সৃষ্টি হয়। আর কাকতালীয়ভাবে ঠিক সেই সময় একটা বড় হাঙর যাচ্ছিল জাহাজের নিচ দিয়ে। স্রোতের অভিমুখ বুঝতে না পেরে পথ ভেবে ওই গর্ত দিয়ে শরীরের কিছুটা ঢুকিয়ে দেয় হাঙরটা। কিন্তু গর্তের তুলনায় তার শরীর বেশ বড় হওয়ায় কোনোমতে মাথাটা গলিয়ে দিলেও গোটা শরীর ওই গর্ত দিয়ে ঢোকাতে পারেনি বেচারা। পারলে কী হতো বলা মুশকিল। এভাবেই সে জাহাজের খোলে আটকে পড়ে। হাঙরের সুবিশাল শরীর বুজিয়ে দেয় জাহাজের ফাটল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ফুটো দিয়ে পানি ঢোকা কমে যায়। ওদিকে ওইভাবে বেকায়দায় আটকা পড়ে, পানিতের অভাবে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মারা পড়ে হাঙরটি। মরা শরীর আরো ফুলে ওঠে, তাতে জাহাজের গর্ত আরো শক্ত হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে পানিতের সম্পূর্ণ গতিরোধ করে মরা হাঙরের দেহটাই।
এমনি করেই এক সামুদ্রিক হাঙরের বোকামির জন্য সেদিন রক্ষা পেয়েছিল জাহাজের শতাধিক মানুষের অমূল্য জীবন। নিজের প্রাণ দিয়ে বাঁচিয়েছিল প্রায় ৩০০ নির্দোষ মানুষের প্রাণ।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে তৈরি হয়েছিল এক মজার পার্বণ। সেই হতভাগ্য জাহাজের যারা নাবিক ছিলেন তারা নিজেদের জীবনের এই অবিশ্বাস্য ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য গঠন করে বসেন একটি সমিতি। নাম দেওয়া হলো যে ক্রুসেডার স্পেশালাইজেশন সমিতি। এই সংঘের সদস্যরা প্রতি বছর সেই বিশেষ দিনটিকে স্মরণ করে মিলিত হতো নিউজিল্যান্ডের সেই বন্দরে এবং প্রার্থনা করত। দেবতার উদ্দেশ্যে না, দেবদূতের মতো নিজের প্রাণ দিয়ে এতগুলো মানুষের জীবন বাঁচানো সেই হাঙরের উদ্দেশ্যে।
এসডব্লিউ/এসএস/২০৩৫
আপনার মতামত জানানঃ