যেকোনো দেশেরই নিজস্ব কিছু উৎসব থাকে। এই উৎসবগুলোর পেছনে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা জড়িয়ে থাকে। চীন যেহেতু পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দেশগুলোর একটি, স্বাভাবিকভাবে এই দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে সারা বছর ধরে অসংখ্য উৎসব-পার্বণ চলতেই থাকে। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত সভ্যতাগুলো একটি চৈনিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল বিখ্যাত হোয়াংহো নদীর তীরে, যেটি এখনও বহমান।
কথিত আছে, চীনের অধিবাসীরা মনে করে, তারা হচ্ছে সেই বিখ্যাত চৈনিক সভ্যতার অধিকারী। চৈনিক সভ্যতা হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র সভ্যতা যেটি হাজার হাজার বছর পরও এত সংগ্রাম, এত প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে টিকে আছে। প্রবল জাতীয়তাবোধসম্পন্ন চীনারা এই বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো গর্ব করে।
চীনা সভ্যতার হাজার বছরের ইতিহাসের পরিক্রমায় বিভিন্ন সময়ে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যেসব উৎসবের জন্ম হয়েছে, ‘ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যাল’ ঠিক সেরকমই একটি উৎসব। বর্তমানে এই বর্ণিল উৎসব পালনের গন্ডি কেবল চীনে সীমাবদ্ধ নেই, এশিয়ার অনেক দেশেই এই উৎসব বেশ ঘটা করে পালন করা হয়।
ইতোমধ্যে বলা হয়েছে, ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যাল হচ্ছে এমন একটি উৎসব, যার পেছনে জড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক ঘটনা। পুরো চীন এবং এশিয়াজুড়ে এই উৎসবের প্রচলনের পেছনে যেসব ঘটনার অবতারণা ঘটেছে, তার মধ্যে তিনটির গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি। এসবের প্রতিটিই ঘটেছিল প্রায় দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে। এ থেকে অনুমান করা যায় যে ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যাল পালন করা হচ্ছে দুই হাজারেরও বেশি সময় ধরে, এবং এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম উৎসবগুলোর একটি।
এই উৎসবের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, যে ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে এই উৎসবের জন্ম হয়েছিল, সেসবের প্রতিটি ছিল বিয়োগান্তক, বেদনায় পরিপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু বর্তমানে যে ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যাল পালন করা হয় পুরো এশিয়া জুড়ে, সেখানে থাকে আনন্দের আবহ। হাজার বছরের ব্যবধানে এই বিষয়ে বিশাল পরিবর্তন এসেছে। যা-ই হোক, যে তিনটি ঘটনা সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে জানা যাক।
তিনটি ঘটনার মধ্যে যেটি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত, সেই সম্পর্কে জানা যাক। চলে যাওয়া যাক ২,২০০ বছর আগে। তখনকার চীনে অনেকগুলো স্বাধীন রাজ্য ছিল, যেগুলো বিভিন্ন রাজপরিবারের মাধ্যমে শাসিত হতো। সারাবছর বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে সামরিক দ্বন্দ্ব লেগেই থাকতো। এমনই এক রাজ্য ছিল ছিল ‘চু’। এই চু রাজ্যের একজন ব্যক্তি ছিলেন কু ইউয়ান, যিনি সেসময়ে রাজসভার সদস্য ছিলেন। কু ইউয়ান ছিলেন তার সময়ে সবচেয়ে প্রতিভাবান কবি এবং তার লেখা ‘লিসাও, সাফারি থ্রোয়িস’ কবিতাকে চীনা ভাষায় লেখা সর্বকালের সেরা কবিতা হিসেবে গণ্য করা হয়। ব্যক্তি হিসেবে রাজকবি কু ইউয়ান ছিলেন খুবই ভালো। নিজের সারাজীবন তিনি উৎসর্গ করেছিলেন নিজ রাজ্যের উন্নয়নের জন্য। তখনকার সময়টা ছিল খুব অস্থির, চীনের অভ্যন্তরে চাইলেও কোনো রাজ্যের পক্ষে যুদ্ধবিগ্রহ থেকে দূরে থাকা সম্ভব ছিল না। কু ইউয়ান তার পুরোটা জীবন ধরে চেষ্টা করেছিলেন তার নিজ রাজ্য চু যেন বাইরের রাজ্যের আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়।
কিন্তু সময় বদলায়। একসময় একজন অজানা ব্যক্তি রাজার কানে এমন কিছু তথ্য পৌঁছে দিয়েছিল, যেগুলো শোনার পর ‘চু’র তৎকালীন রাজা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। তিনি সেগুলো যাচাই-বাছাই না করেই কু ইউয়ানকে কঠোর শাস্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত নেন। কু ইউয়ানকে কঠোর শাস্তি প্রদান করা হয়, তিনি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরই মধ্যে আবার যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে, প্রতিবেশী একটি রাজ্য আক্রমণ করে বসে ‘চু’ রাজ্যে। মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কু ইউয়ান শাস্তি পেলেও নিজ রাজ্যের প্রতি তার ভালোবাসা একটুও কমেনি। সেই সময়ে পঞ্চম চান্দ্র মাসের পাঁচ তারিখে তিনি তার শেষ কবিতা লেখেন। প্রতিবেশী রাজ্যের আক্রমণে ‘চু’ রাজ্যের দুর্দশা ও ধ্বংসলীলা আর সহ্য করতে পারছিলেন না কু ইউয়ান। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আত্মহত্যা করবেন। শেষ কবিতা লেখার পরই রাজ্যের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া মিলুও নদীতে লাফ দিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন। তার এমন করুণ মৃত্যুতে পুরো রাজ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। জেলেরা নৌকা চালিয়ে তার মৃতদেহ উদ্ধারের চেষ্টা চালায়, কিন্তু তারা সফল হয়নি। এক জেলে ভাত হাতের মুঠোয় নিয়ে গোলাকৃতির বানিয়ে নদীতে নিক্ষেপ করেছিল। সেই জেলে বলেছিল, যতক্ষণ মাছের খাবার দেয়া হবে, ততক্ষণ মাছগুলো রাজকবির মৃতদেহ স্পর্শ করবে না। ইতিহাস বলে, রাজকবির এমন দুঃখজনক মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ড্রাগন বোট উৎসবের সূচনা।
এবার আরেকটি ঘটনায় যাওয়া যাক। চীনের জিয়াংশু ও ঝেইজিয়াং অঞ্চলে এই ঘটনা খুব বেশি প্রচলিত। প্রায় দুই হাজার বছর আগে এক ব্যক্তি একটি রাজ্যে বসবাস করতো, যার বাবা ছিল রাজপরিবারের শিক্ষক। আগের ঘটনার মতোই রাজার কানে এমন কিছু তথ্য পৌঁছানো হয়, যার কারণে রাজা সেই শিক্ষকের উপর বেশ নাখোশ হন।
নাখোশ রাজা এরপর সেই রাজপরিবারের শিক্ষক ও তার বড় সন্তানকে ফাঁসির আদেশ দেন। রাজার আদেশ কার্যকর করা হয়। শিক্ষক ও তার সন্তানকে ফাঁসি দেয়ার পর তার ছোট সন্তান রাজার উপর প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু রাজার আক্রোশ থেকে বাঁচতে হলে সেই ক্ষোভ বাইরে প্রকাশের উপায় ছিল না। বাবা ও বড় ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ছোট সন্তান ফন্দি আঁটতে থাকে। কাউকে কিছু না বলে একদিন সুযোগমতো ছোট সন্তান রাজ্যের বাইরে পালিয়ে যায়। আসলে এটাই ছিল তার পরিকল্পনা। সুযোগমতো সে প্রতিবেশী এক উদীয়মান রাজ্যে আশ্রয় নেয়। পরবর্তীতে স্বীয় মেধা ও প্রজ্ঞার বলে সে রাজার প্রিয়পাত্রে পরিণত হয়, রাজা তাকে রাজসভার গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন করেন।
ছোট সন্তান নিজ রাজ্য থেকে পালিয়ে যে রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিল, সেটি একসময় যথেষ্ট সামরিক সক্ষমতা অর্জন করে। এরপর প্রতিবেশী রাজ্যের রাজা ছোট সন্তানের পরামর্শ অনুযায়ী তার সাবেক রাজ্যে আক্রমণ চালায় এবং দখল করে নেয়। এভাবে ছোট সন্তান তার সাবেক রাজ্যের রাজার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ করে। তবে ছোট সন্তানের সুখ খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
বাইরের রাজ্য থেকে এসে ছোট সন্তানের রাজসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হওয়াকে সেখানকার অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। তারা রাজার কাছে ছোট সন্তানের ব্যাপারে মিথ্যা অভিযোগ জানায়। তার বাবা ও ভাইয়ের সাথে যা ঘটেছিল, তার সাথেও একই ঘটনা ঘটে। তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। আগের ঘটনায় কু ইউয়ানের মৃত্যুতে যেমন পুরো রাজ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল, এবারও ছোট সন্তানের মৃত্যুতে পুরো রাজ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। ইতিহাস জানায়, তার মৃত্যুকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যালের সূচনা।
এবার একেবারে শেষ ঘটনায় আসা যাক। প্রাচীন হান রাজবংশের অধীনে যে রাজ্য ছিল, সেখানে এক ব্যক্তি পানিতে ডুবে মারা যান। বেশ কয়েক দিন ধরে খোঁজার পরেও তার মৃতদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তার মেয়ে তাকে প্রচন্ড ভালোবাসতো। সে মনে করেছিল যে তার বাবার মৃতদেহ উদ্ধার করা তার নৈতিক দায়িত্ব। সতের দিন পর, পঞ্চম চান্দ্র মাসের পাঁচ তারিখে মেয়েটি উপায়ান্তর না পেয়ে নিজেই নদীতে নেমে পড়ে এবং আশ্চর্যজনকভাবে তার বাবার মৃতদেহ নিয়ে পানির উপরে উঠে আসে।
এই দৃশ্য দেখার পর মানুষ বলাবলি করতে শুরু করে যে বাবার প্রতি মেয়ের এই ভালোবাসার ঘটনায় স্বর্গবাসীরাও অবাক হয়ে গিয়েছিল। মূলত মেয়ের এই ভালোবাসার ঘটনায় মেয়েটির নামে স্থানীয় ব্যক্তিরা একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করে এবং এরপর থেকেই ড্রাগন বোট উৎসবের প্রচলন ঘটে।
ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যালের প্রধান দিন হচ্ছে প্রতি বছরের পঞ্চম চান্দ্র মাসের পাঁচ তারিখ। এই দিনটি চীনে সরকারিভাবে ছুটির দিন হিসেবে পালন করা হয়। তবে এই দিনে একটি বিশেষ খাবার খাওয়া হয়। চটচটে ভাত দিয়ে তৈরি গোলাকৃতির এই খাবারের নাম ‘জংজি’। রাজকবি কু ইউয়ানের মৃতদেহ উদ্ধারের জন্য ‘চু’ রাজ্যের জেলেরা যেভাবে নৌকাচালনা করেছিল, সেই বিষয় স্মরণ করে বিভিন্ন রঙে রঙিন অসংখ্য লম্বা নৌকা নিয়ে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
যেহেতু চীনের জাতীয় প্রতীক ড্রাগন, তাই স্বাভাবিকভাবেই নৌকাগুলোর মধ্যে রঙ দিয়ে ড্রাগনের অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয়। এছাড়া আরও কিছু লোকাচার পালন করা হয়, এবং বিশ্বাস করা হয়- সেগুলো পালমে মাধ্যমে সামগ্রিক জীবন থেকে অশুভ শক্তিকে বিতাড়িত করা হয়। ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যালকে শুধু চীনের নয়, এশিয়ার সবচেয়ে বর্ণিল উৎসব হিসেবেও আখ্যায়িত করেন অনেকে।
এসডব্লিউ/এসএস/২০৪০
আপনার মতামত জানানঃ