কিছু দেশে তাকে সাম্যবাদী সন্ত চিত্রিত করা হয়, কিছু মানুষ তাকে ঘৃণা করে মার্কসবাদী খুনি বলে দাবী করে, অধিকাংশ মানুষ তার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু না জেনেও তাকে বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের প্রতীক বলেই মনে করে। তার নাম চে গেভারা। গত শতাব্দীর অন্যতম উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব তিনি এবং তার হত্যাকাণ্ডের চার দশক পরও তার ভূমিকা, তার আবেদন যেন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে প্রতি বছর।
এই কিংবদন্তিকে নিয়ে লেখা বইয়ের অভাব না থাকলেও বস্তনিষ্ঠ তথ্যসমৃদ্ধ নিরপেক্ষ বই অতি বিরল, আর সেই বিরলদের মাঝে শ্রেষ্ঠ স্থানটি দখল করে আছে আমেরিকান সাংবাদিক জন লি অ্যান্ডারসনের লেখা ‘চে গেভারা: আ রেভ্যুলুশনারি লাইফ’।
লেখক আশির দশকের শেষ দিকে সারা বিশ্বের নানা দেশের গেরিলা যোদ্ধাদের (বার্মা, এল সালভাদর, পশ্চিম সাহারার দেশগুলো এমনকি আফগানিস্তান) নিয়ে কাজ করার সময় লক্ষ্য করেন সবার কাছে চে গেভারা একজন আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হন, কেবলমাত্র চে’র গেরিলা যুদ্ধের নিয়ম কানুন নিয়ে লেখা ‘গেরিলা ওয়ারফেয়ার’ পুস্তিকার জন্য নয়, গেরিলা সংগ্রামের ব্যাপারে চে’র নিজস্ব কিছু নিয়ম-নীতি যেমন আত্মত্যাগ, সততা, এবং আদর্শের জন্য অটল থাকা ইত্যাদিই তাকে জাতি-ধর্ম-দেশ নির্বিশেষে করে তুলেছে তুমুল জনপ্রিয়।
তাই চে’র জীবন নিয়ে উৎসুক হয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং হতাশ হয়েই উপলব্ধি করেন চে গেভারার জীবন নিয়ে বাস্তবঘেঁষা বই নেই বললেই চলে, এমন একটা বই লেখার বাসনায় তিনি ১৯৯২ সালের প্রথমবারের মত কিউবা ভ্রমণ করেন, এবং পরবর্তীতে তথ্য সংগ্রহের জন্য একাধিকবার কিউবাসহ আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, মেক্সিকো, প্যারাগুয়ে, সুইডেন, মস্কো, ওয়াশিংটন ডিসি, লন্ডন ভ্রমণ করেন।
চে’র বিধবার স্ত্রী অ্যালাইদা মার্চ প্রথমবারের তার স্বামীর অসংখ্য ব্যক্তিগত নথি পরিবারের বাইরে কাউকে দেখবার অনুমতি দেন, কারণ তার বিশ্বাস ছিল লেখক জন হয়ত চে’র একটি পরিপূর্ণ জীবনী লিখতে সক্ষম হবেন, মানুষ জানতে পারবে সেই বিপ্লবের সূর্যসন্তানকে।
অবশেষে ৫ বছরের কঠোর পরিশ্রমের ফলে বইটি প্রকাশের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয়, ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হবার পর থেকেই এখন পর্যন্ত বইটিকে চে গেভারার বিপুল কর্মময় জীবন নিয়ে রচিত সবচেয়ে বাস্তবঘেঁষা তথ্যবহুল জীবনীগ্রন্থ বলে অ্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। সেখানে রচনা করা হয়েছে তার দোলনা থেকে শুরু করে কবরযাত্রা পর্যন্ত প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের ছবি।
এই লেখাটি সেই ৮০০ পৃষ্ঠার বইয়ের কিছু চুম্বক অংশ নিয়েই। বইয়ের শুরুতেই এক চমকপ্রদ বিষয়ের অবতারণা করেছেন লেখক, তার প্রাপ্ত তথ্যমতে চে যদি ১৯২৮ সালের ১৪ জুন আসলেই জন্মগ্রহণ করেন তাহলে তিনি মিথুন রাশির জাতক, চে’র মায়ের একজন ঘনিষ্ঠ জ্যোতীষ বন্ধু হিসাব কষে বলেছিল তার জীবন হবে আর দশটা সাধারণ জীবনের মতই, বর্ণহীন ম্যাড়ম্যাড়ে ঘটনায় পূর্ণ। চে-র মা সেলিয়া গেভারার সামনে সেই তথ্য উপস্থাপন বলা হয়েছিল তাহলে তার সেই জ্যোতিষ বন্ধু ভাগ্য গণনার কিছুই জানত না অথবা চে’র জন্মদিনটিই ছিল ভুল!
এই কথায় সেলিয়া হেসে ফেলে ৩০ বছর ধরে লুকায়িত সত্যটি বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেন, চে’র জন্ম আসলে ১৪ই জুন না, ১৪ মে! কাজেই সে মিথুন নয় বৃষ রাশির জাতক! আসলে বিয়ের সময় সেলিয়া তিন মাসের গর্ভবতী ছিলেন, সেই পুরনো যুগে মানুষের কথা এড়ানোর জন্য বন্ধু ডাক্তার এক মাস কমিয়ে লিখে ছিল শিশু চে’র আগমন দিবস। (যদিও উইকিসহ নেটের প্রায় সব জায়গাতেই ১৪ জুন পাবেন)।
১৯২৭ সালে প্রথম বারের মত আর্নেস্তো গেভারা লিঞ্চ এবং সেলিয়া ল্য সেরনার প্রথম পরিচয় ঘটে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সে, আর্নেস্তো তখন ২৭ বছরের এক তরুণ আর সেলিয়া ২০ বছরের সদ্য কলেজ পাশ করা তরুণী। সেই বছরের ১০ নভেম্বর তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হযন, কিছুদিন পরই পরিবার আলো করে জন্ম নেয় নতুন শিশু।
কিন্তু ১৯৩০ সালের মে মাসে ঘটে যাওয়া আপাত দৃষ্টিতে একটি সামান্য ঘটনাতেই ঘুরে যায় পরিবারটির ভবিষ্যৎ- মা সেলিয়ার সাথে সাঁতার কাটতে যেয়ে দুই বছরের চে বাজে ধরনের ঠাণ্ডা লাগিয়ে বসেন, পরবর্তীতে তার হাঁপানি (অ্যাজমা) ধরা পড়ে, যা ছিল শেষমুহূর্ত পর্যন্ত জীবনসঙ্গী।
শিশুটির হাঁপানি সারানোর জন্য গেভারা পরিবার ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর জায়গায় বসবাস শুরু করে, তাতেও খুব একটা উপকৃত না হওয়ায় অবশেষে আলতা গার্সিয়া নামের এক ক্ষুদে শহরে চলে যান, পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই শহরটি ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত রোগীদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল, পরবর্তী ১১ বছর এখানেই কাটে তাদের।
হাঁপানির কারণে নয় বছর বয়স পর্যন্ত চে নিয়মিত স্কুলে যেতে পারতেন না, এই সময়ে মা সেলিয়া তাকে ধৈর্য ধরে অক্ষর চিনতে, পড়তে এবং লিখতে শেখান। কার্যত সেলিয়া তার জ্যেষ্ঠ পুত্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেন যা ১৯৬৫ সালে তার মৃত্যু পর্যন্ত বজায় ছিল, তিনিই ছিলেন চে’র সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা। মাঝে মাঝে শারীরিক দুর্বলতার জন্য হাঁটতে পর্যন্ত অক্ষম চে সময় কাটানোর মাধ্যম হিসেবে বই পড়া এবং বাবার সাথে দাবা খেলাকে বেঁছে নেন।
পরবর্তীতে বিশ্বব্যপী একজন পড়ুয়া হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া চে বাল্যকালের সেই একাকীত্বের দিনগুলিকেই তার বই পড়ার অভ্যেস গড়া উঠার অন্যতম কারণ বলে বর্ণনা করেন । (চে সবসময় মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন ‘Evertyhing began with Literature’ এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিবিষ্ট মনে বই পড়ার নেশা অব্যাহত রেখেছেন, টয়লেটেও তিনি বই ছাড়া প্রবেশ করতেন না! )
শারীরিক সক্ষমতা সামান্য ফিরে আসলে চে ফুটবল, টেবিল টেনিস, গলফে, ঘোড়ায় চড়া, সাঁতার ইত্যাদিতে মেতে থেকে স্বাস্থ্যের উন্নতির চেষ্টা করতে থাকেন অবিরত। সবকিছুর মাঝে ব্যস্ত থেকে ১৯৩৭ সালের (অন্য সব সহপাঠীর চেয়ে এক বছরের বেশি বয়স্ক) মার্চে সান মার্টিনের স্কুলে তিনি ২য় গ্রেডে প্রবেশ করেন।
এদিকে ১৯৩৯ সালে শুরু হয়ে যায় ২য় বিশ্বযুদ্ধ, গেভারা লিঞ্চ নাৎসি বাহিনীর অপতৎপরতা এবং তাদের নিষ্ঠুরতার শিকার নানা জনগোষ্ঠীর কথা বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতার মাধ্যমে বলা শুরু করেন একটি সংস্থার মাধ্যমে, এগার বছরের ক্ষুদে চে-ও বাবার এই আন্দোলনে নানা ভাবে জড়িয়ে থেকে একটি তরুণ পরিচয়পত্র পেয়েছিলেন, যা তিনি অত্যন্ত গর্বের সাথে অন্যদের দেখাতেন।
সেইসাথে স্বদেশ আর্জেন্টিনায় যেন নাৎসি তৎপরতা ছড়াতে না পারে সেই জন্য তারা নাৎসিবান্ধবদের উপরও কড়া নজরদারি করতেন। কিন্তু ১৯৪৩’র গ্রীষ্মে তাদের কর্ডোভা শহরের বাচ্চাদের উচ্চশিক্ষার জন্য চলে আসেন।
শুরু হয় চে-র নতুন জীবন নতুন বন্ধুদের সাথে, বিশেষ করে আলবার্তো গ্রানাদো এবং চে’র বন্ধুত্ব তো রূপকথায় পরিণত হয় তাদের জীবিত অবস্থাতেই। এইসময় নানা অভ্যাসের জন্য চে-র কপালে জুটে বিভিন্ন নাম, বিশেষ করে রাগবি মাঠে মারকুটে ভঙ্গীর জন্য তাকে বলা হতে থাকে ফুসের ( El Furibudo বা হিংস্র) আর আলবার্তোর নাম হয়ে যায় মিয়াল (mi Alberto বা আমার আলবার্তো! )।
১৯৪৩-এর নভেম্বরে আলবার্তো আর্জেন্টিনার ব্যাপক ধরপাকড়ের রাজনীতির শিকার হয়ে গ্রেপ্তার হন, এবং দুই মাস জেলে থাকার পর মুক্তি পান। ১৫ বছরের চে তার বন্ধুর একটি মিছিলের প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে বলেন একটি রিভলবার পেলে তবে তিনি সেই মিছিল যেতে রাজি আছেন, যা আলবার্তোকে যথেষ্ট ক্রুদ্ধ করে তোলে, যদিও জেল থেকে মুক্তির পরে তাদের মানিকজোড় বন্ধুত্ব অব্যাহত থাকে।
আর্জেন্টিনার টালমাটাল রাজনীতিতে তখনো হুয়ান পেরন নামে সেনাশাসকটির আবির্ভাব ঘটেনি, সেই কেবলমাত্র দেশে ফিরেছে মুসোলিনীর ইতালি থেকে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব পালন করে, শুরু হয় তার নতুন খেলা।
এদিকে কিশোর চে আস্তে আস্তে টোকা দেন তারুণ্যের দরজায়, আরব্য রজনীর গল্প যেমন তাকে বড়দের নিষিদ্ধ জগৎ সম্পর্কে ধোঁয়া ধোঁয়া ধারণা দেয়, তেমনি বাল্যপ্রেমে পড়ে নানা কবির কবিতায় আকণ্ঠ ডুবে থেকে নিজেও কবিতা লেখা শুরু করেন। এই প্রসঙ্গে তার ১৭ বছর বয়সের সহপাঠিনী মিরিয়াম উরুশিয়ে স্মৃতি হাতড়িয়ে বলেন- আসলে, আমরা মেয়েরা সবাই কম বেশি আর্নেস্তোর প্রেমে পড়েছিলাম, হয়ত তার আকর্ষণীয় বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, একহারা গড়ন এবং কথা বলার সহজাত ভঙ্গির জন্য।
যে বয়সে কিশোরেরা মেয়েদের চোখে প্রভাব বিস্তারের জন্য মুখিয়ে থাকে, চে সেখানে হয়ত এত জনপ্রিয়তার মাঝে যথেষ্টই নির্লিপ্ত ছিলেন। একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন তার বন্ধু রিগাত্যুসো, তিনি পারবারিক অনটনের কারণে কিশোর বয়সেই সিনেমা হলের সামনে মিষ্টান্নজাতীয় দ্রব্য ফেরি করতেন। চে একবার আর্জেন্টাইন হাই সোসাইটির এক মেয়ের সাথে ডেটিংয়ে এসে বন্ধুকে দেখে সহাস্যে এগিয়ে এসে কুশল বিনিময় করেন, তখন তার প্রেমিকা একাকী দাঁড়িয়ে ছিল। (এই অবস্থায় অধিকাংশ কিশোরই বন্ধুকে এড়িয়ে যেত, বিশেষ করে তার যে একজন ফেরিওয়ালার সাথে বন্ধুত্ব আছে তা ধনীর দুলালী প্রেমিকার সামনে জানাতে ব্যস্ত হত না!)।
স্কুল জীবনে গড়পড়তা ভাল ফলাফলেরই অধিকারী ছিলেন চে, কিন্তু জ্ঞান ও সাহিত্যে সর্বগ্রাসী ক্ষুধার কারণে পাঠ্য বইয়ের বাহিরেই সময় দিতেন অনেক বেশি, শুরু করেছিলেন ফ্রয়েড, জ্যাক লন্ডন, নেরুদা, অ্যানাতোলে ফ্রঁসে পড়া, এর ফাঁকে অবশ্য কার্ল মার্কসের ডাস ক্যাপিটাল তার হাতে আসে। (এর অনেক বছর পরে কিউবাতে চে স্বীকার করেন প্রথমবার পড়ার সময় মার্কস ও এঙ্গেলসের দর্শনের কিছুই বুঝতে পারেননি)।
১৯৪৫ সালে চে নতুন ধরনের রোজনামচা লেখা শুরু করেন, ১৬৫ পাতার সেই নোট বুকটি ছিল তার পরবর্তী এক দশকে লেখা ৭টি নোটবুকের প্রথমটি, সেখানে ধারাবাহিকভাবে ক্রমানুসারে যত্ন করে লিপিবদ্ধ করা ছিল তার পঠিত নানা বিষয় নিয়ে, নানা মানুষের, বিশেষত লেখক-দার্শনিকদের চিন্তা ও মতামত। চে সবার কাছে থেকেই রেফারেন্স নিতেন, সেখানে হিটলারের মাইন ক্যাম্ফের লাইন যেমন ছিল তেমন ছিল বুদ্ধ, অ্যারিস্টটল, রাসেল, এইচ জি ওয়েলস, বিশেষ করে সিগমুণ্ড ফ্রয়েডের রচনা থেকে।
পরবর্তীতে চে’র পড়ার বিষয় পাল্টাতে থাকে, পরের নোটবুকগুলো ভরে উঠে নেহেরু, কাফকা, ফকনার, কামু, সাত্রে, লেনিন, মার্কসের চিন্তাধারায়। কবিদের মধ্যে তার বিশেষ প্রিয় ছিল লোরকা, আলবার্তি, হুইটম্যান, কিটস, রবার্ট ফ্রস্ট এবং সবচেয়ে প্রিয় পাবলো নেরুদা। ( বলিভিয়ার জঙ্গলের মৃত্যুবরণ করার সময়ে চে-র সঙ্গী ছিল নেরুদার ক্যান্টো জেনারেল এবং নিজের সংকলিত একটি সবুজ নোটবই, যেখানে পছন্দের কবিতা এবং উক্তিগুলো সযত্নে লিপিবদ্ধ ছিল)।
১৯৪৬-এ পেরন দেশের ক্ষমতা দখল করে আর পরের বছরই চে’র জীবনে ঘটে অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা, তার দাদী অ্যানা ইসাবেলের মৃত্যু। এর পরপরই কোন অজ্ঞাত কারণে চে পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক প্রকৌশলবিদ্যা অধ্যয়নের চিন্তা বাদ দিয়ে ডাক্তারিবিদ্যার দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং বুয়েন্স আয়ার্স বিশ্ব-বিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অফ মেডিসিনে ভর্তির আবেদন দাখিল করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষেই তার বাধ্যতামূলক মিলিটারিতে যাবার ডাক আসে, কিন্তু হাঁপানি ধরা পড়ায় রেহাই দেওয়া হয়, জীবনে প্রথমবারের মত রোগাক্রান্ত দুর্বল ফুসফুসজোড়াকে উপহাস করে ধন্যবাদ দেন চে। এই সময়ে তার নতুন দুই ভালোবাসা একসাথে দেখা দেয়- ভ্রমণ এবং কাব্য চর্চা।
সেই সাথে বই পড়া তো ছিলই, বিশেষ করে ভ্রমণজনিত অ্যাডভেঞ্চারের কারণে জুল ভার্ন বিশেষ প্রিয় লেখকে পরিণত হয়, তার প্রকাশিত সমস্ত লেখা বুভুক্ষুর মত পড়ে ফেলেন চে, সেই সাথে দর্শনের প্রতি আগ্রহের কারণে চলে আদি গ্রীক থেকে অ্যালডাস হ্যাক্সলি পর্যন্ত পাঠ। এবং নতুন করে মার্কসের বই এবং লেনিনের দর্শন।
অনেক পরে ১৯৬৫ সালে আফ্রিকায় অবস্থানের সময়ে মার্কস নিয়ে নিজেরই একটি জীবনী গ্রন্থ লিখবার চিন্তা করেছিলেন। সেই সাথে এক বইয়ের পাতায় দেখে নিজে এঁকেছিলেন লেনিনের একটি ছবি- তার মতে এই মানুষটিই সত্যিকার অর্থে নিজের জীবনে সোশ্যালিস্ট ছিলেন।
১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি চে প্রথমবারের মতো তার ভ্রমণময় জীবনের একা ভ্রমণ শুরু করেন, একটি সাইকেলের সাথে ছোট ইঞ্জিন জুড়ে শুরু হয় তার স্বদেশকে আবিষ্কার। কয়েকশ’ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে পৌঁছান সান ফ্রান্সিসকো দেল চানিয়ার শহরে, যেখানকার কুষ্ঠরোগের চিকিৎসাকেন্দ্রে কর্মরত ছিলেন প্রাণের বন্ধু আলবার্তো গ্রানাদো। এই ঘটনার পর চে’র জীবনের দুইটি জিনিস যোগ হয় যা তিনি প্রায় উপাসনার মত পালন করে গেছেন বাকী জীবন- ভ্রমণ এবং রোজনামচা লেখা।
এমন নানা ভ্রমণের ফাঁকেই তার কাহিনী প্রথমবারের মত ছাপা হয় এক স্থানীয় খবরের কাগজে, যা চে’র জন্য উৎসাহদায়ক ছিল, সেই সাথে যাত্রাপথে মিলিত হন বিভিন্ন রকমের মানুষের সাথে , চিত্র-বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ভরে উঠতে থাকে তার অভিজ্ঞতার ঝুলি। অবশেষে ১৯৫২ সালের ৪ জানুয়ারি আর্নেস্তো গেভারা এবং আলবার্তো গ্রানাদো শুরু করেন মহাদেশব্যাপী তাদের বিখ্যাত মোটরসাইকেল যাত্রা, যার দিনবিবরণী অমর হয়ে আছে মোটরসাইকেল ডায়েরিজ নামে, এটি পরিণত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় এবং পঠিত রোজনামচায়, একে নিয়েই নির্মিত হয়েছে অসাধারণ চলচ্চিত্রও।
যদিও দুই বন্ধুর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল চিলি পৌঁছে বিখ্যাত ইস্টার দ্বীপের কুষ্ঠআশ্রমে কাজের জন্য যাওয়া, কিন্তু সেটি না হওয়ায় তারা যাত্রা অব্যাহত রাখেন। ল্য গিওকোন্দা শহরে অবস্থানের সময় ডাক্তার হিসেবে একজন অসুস্থ মৃত্যুপথযাত্রী বয়স্কা মহিলাকে দেখতে যান চে, সেই রোগীর হতদরিদ্র অবস্থা এবং বাসস্থানের শোচনীয় পুঁতিগন্ধময় পরিবেশ তার মনে তৈরি করে এক অভূতপূর্ব অনুভূতির, বিশেষ করে সেই বৃদ্ধার দৃষ্টি যেন তাড়া করে ফিরে তরুণ অভিযাত্রীদের পরবর্তী অনেক দিন। ঐতিহাসিক যাত্রা অব্যাহত থাকে তাদের, মোটর সাইকেলটি অকেজো হয়ে পড়ে পথের মাঝে। পরিকল্পনা মোতাবেক আলবার্তো বিদায় নেন ভেনেজুয়েলা থেকে, আর চে চলে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামিতে।
এর পরে তার স্বদেশে ফিরে আসার মাত্র ৫ দিন আগে পেরণের স্ত্রী এভিটা পেরন মাত্র ৩৩ বছর বয়সে ক্যান্সারে মারা যান, সাধারণ জনগনের শোক প্রকাশের জন্য দুই সপ্তাহের জন্য বিশেষ স্থানে রাখার পরে নিয়ে যাওয়া হয় বিশেষ পদ্ধতিতে পূর্ণ সংরক্ষণের জন্য, এমনকি স্ট্যাচু অফ লিবার্টির চেয়েও বিশাল এক মূর্তি তার সম্মানে গড়ার পরিকল্পনা করছিল পেরন সরকার, সেই সাথে ভ্যাটিকানের পোপ তাকে সেইন্টের মর্যাদা দিতে পারে এমন কানাঘুষোও চলছিল।
এই সমস্ত ডামাডোলে চে তার ডাক্তারিবিদ্যার শেষ পরীক্ষাগুলো দেবার জন্য কোমর বেঁধে লেগে পড়েন এবং নিজের রোজনামচায় লিখেন- আমি আর আগের মানুষটি নেই, ল্যাতিন আমেরিকার সেই উদ্দেশ্যহীন ভবঘুরেমি আমাকে আমার কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি পরিবর্তন করে ফেলেছে।
১৯৫৩ সালের ১১ এপ্রিল চে প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্রজীবনের শেষ পরীক্ষাটি দেন, তার বাবার মনে আছে- চে তাকে টেলিফোন করেই বলেছিল ডা. আর্নেস্তো গেভারা দ্য ল্য সেরনা বলছি! (আমি একাধিক জায়গায় বিশেষ করে রিপ্লেস বিলিভ ইট অর নটে পেয়েছিলাম চে পৃথিবীতে সবচেয়ে কম সময়ে এম বি বি এস পরীক্ষায় সবচেয়ে ভাল ফলাফল করে পাশ করে বিশ্বরেকর্ডধারী ডাক্তারে পরিণত হয়েছিলেন, যে রেকর্ড এখন পর্যন্ত টিকে আছে) ।
সেই সময়ে ক্যারিবিয়ান দ্বীপদেশ কিউবাতে ঘটে চলেছে অন্য ঘটনা প্রবাহ, স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধাচারণ করে বিপ্লবের চেষ্টা করার জন্য ৬৯ জন বিপ্লবীকে নির্মম অত্যাচার করে হত্যা করা হয়, বাকি কয়েকজনকে নানা হস্তক্ষেপের কারণে আদালতে প্রহসনের বিচারের মুখোমুখি করা হয়, যাদের অন্যতম ছিলেন ছাত্রনেতা আইনজীবী ফিদেল কাস্ত্রো এবং তার ছোট ভাই রাউল কাস্ত্রো।
১৯৫৩ সালে চে মধ্য আমেরিকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন, সেখানকার দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে চলছিল স্বৈরাচারিতা এবং বহুজাতিক কোম্পানিরগুলোর স্বেচ্ছাচারিতার মোচ্ছব, যাদের উপহাস করে বলা হত বানানা রিপাবলিক। গুয়াতেমালা, নিকারাগুয়া, এল সালভাদর সবখানেই একই অবস্থা! সেই সাথে এমনটি চলছিল ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জেও।
গুয়াতেমালায় অবস্থানের সময় চে প্রথম বারের মত রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন, স্থানীয় বামপন্থীদের সাথে, এই সময়ে জনাকয়েক নির্বাসিত কিউবান বিপ্লবীর সাথে তার পরিচয় ঘটে, যাদের অন্যতম ছিলেন অ্যান্তনিও নিকো লোপেজ, যার সাথে অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্বের বন্ধনে জড়িয়ে পড়েন চে। আসলে এই নিকোই আর্নেস্তো গেভারাকে এল চে আর্জেন্টিনো ( El Che Argentino) বলে সম্বোধন শুরু করেন, যা পরবর্তীতে চে’তে পরিণত হয়, এর মানে এইযে তুমি (hey you)।
এদের কাছেই কিউবান বিপ্লবের স্বরূপ এবং এর প্রাণপুরুষ ফিদেল সম্পর্কে সম্মক জ্ঞান লাভ করেন চে, অপেক্ষা করতে থাকেন এই বিপ্লবে অংশ গ্রহণের জন্য। এর মাঝে গুয়াতেমালায় সিআইএ’র সহযোগিতায় ক্যু ঘটিয়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে, বাধ্য হয়ে চে আগে মধ্য আমেরিকার অন্যান্য দেশগুলোর অবস্থা চাক্ষুষ করার জন্য আবার পথে বেরিয়ে পড়েন, এবং ধার করা ২০ ডলার নিয়ে যান এল সালভেদর।
এবং শেষ পর্যন্ত তিনি পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক মেক্সিকো সিটি পৌঁছাতে সক্ষম হন।
চে’র জানা ছিল না, গুয়েতেমালার সেনা ক্যুর পরে সিআইএ’র তালিকায় একজন সন্দেহভাজন হিসেবে তাকে তালিকাভুক্ত করা হয়। ডেভিড অ্যাটলি ফিলিপস নামের এজেন্ট তার নামে সিআইএ’র বিশেষ ফাইল খোলার সিদ্ধান্ত নেন, যা এক পর্যায়ে সিআইএ’র ইতিহাসের সবচেয়ে মোটা ফাইলগুলোর একটিতে পরিণত হয় !
মেক্সিকোতে চে মার্কসবাদী আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, সেই সাথে নতুন নেশা হিসেবে তুষারাবৃত ৫৪০০ মিটার উচ্চতার পপকাটেপেটল আগ্নেয়গিরিতে আরোহণ করেন।
অবশেষে রাউল কাস্ত্রো সেই শহরে আসলেন, চে এবং তার প্রেমিকা হিলডা গার্সিয়া তাকে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানান। হিলডার মতে চে এবং রাউল প্রথম সাক্ষাতেই পরস্পরের অকৃত্রিম বন্ধুতে পরিণত হন।
এই সময়ে রাশান এজেন্ট নিকোলাই লিওনভের সাথে চে’র সাক্ষাৎ হয়য়, যে ছিল রাউলের পূর্ব পরিচিত (১৯৯২ সালে লিওনভ কেজিবির ডেপুটি চিফ হিসেবে অবসরে যায়, যার কর্মক্ষেত্র ছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং ল্যাতিন আমেরিকা)। যদিও তার এসপিওনাজ জীবন নিয়ে তাদের কিছুই জানা ছিল না, কিন্তু চে ব্যপক উৎসাহ প্রকাশ করেন সোভিয়েত জীবনধারা নিয়ে, জনগণের দৈনন্দিন জীবন নিয়ে।
ফিদেলের সাথে প্রথম সাক্ষাতের পরপরই ফিদেল, রাউল এবং চে নৈশভোজের জন্য একসাথে যান, এবং পরবর্তী টানা কয়েক ঘণ্টা আলাপচারিতার পরে ফিদেল চে’কে তার গেরিলা সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানান, যা চে সাথে সাথে গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্ত হয়- চে হবেন গেরিলাদের ডাক্তার।
এখানে লেখক জন লি অ্যান্ডারসন ফিদেল এবং চে-কে উপস্থাপন করেছেন দুইজন সম্পূর্ণ ভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মানুষ হিসেবে, যদিও মানুষের সমান অধিকারের প্রতি বিশ্বাসই তাদের দ্রুত বন্ধুত্বে সহায়ক হয়।
এর মাঝে হিলডা গর্ভবতী হয়ে পড়ে, ১৯৫৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কন্যা সন্তানের জনক হন চে। মার্কস, এঙ্গেলস এবং লেনিন নিয়ে তার লেখা-পড়া চলতে থাকে পূর্ণ গতিতে, এদিকে ঘনিয়ে আসে কিউবা যাবার সময়। যাত্রার আগে মায়ের কাছে লেখা চিঠিতে সেই আলোভরা স্বপ্নের কথা লিখে জানান তিনি, যার জন্য এত ত্যাগ, এত তীতিক্ষা।
ফিদেলের গেরিলা দলে লুকিয়ে মেক্সিকো থেকে মোটর চালিত নৌকা গ্রান-মায় করে কিউবায় অবতরণ হয়েছিল সত্যিকার অর্থে এক বিশাল কেলেঙ্কারিতে, কারণ এটি পৌঁছেছিল সম্পূর্ণ ভুল স্থানে, অধিকাংশ বিল্পবী গুলিতে মারা যান, মাত্র কয়েকজন লুকিয়ে ঘাঁটিতে মিলিত হতে সক্ষম হন।
গেরিলা ক্যাম্পের দিনগুলোতে যখন স্থানীয় জনগণ এবং গুপ্তচরদের সাহায্যে খাদ্য ও নানা অস্ত্রশস্ত্রের চালান আসছিল, এর মাঝেও চে চেয়ে পাঠান ৩ টি বই- কিউবার ইতিহাস, কিউবার ভূগোল এবং অ্যালজেবরা নিয়ে!
এর মাঝে বাতিস্তা বাহিনীর সাথে নিয়মিত সংঘর্ষ হতেই থাকে তাদের, এমন এক খণ্ড লড়াইয়ে চে মুখোমুখি যুদ্ধে রাইফেলের গুলিতে বিপক্ষের একজনকে নিহত করতে সক্ষম হন, জানামতে এটিই ছিল তার হাতে প্রথম কোনো মানুষের মারা যাবার ঘটনা।
এই সংগ্রামরত সময়েই হিলডা এবং তার শিশু কন্যা চে’র পরিবারকে দেখার জন্য আর্জেন্টিনায় যায়, এদিকে গেরিলা যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই ফিদেল তার প্রেমিকা সেলিয়া সানচেজের দেখা পান এবং রাউল ঘনিষ্ঠ হন ভিলমা এস্পিনের সাথে, যে পরবর্তীতে তার স্ত্রীতে পরিণত হয়।
সম্মুখ সমরে অসাধারণ ভুমিকার জন্য চে’কে ফিদেল কমানদান্তে উপাধিতে ভূষিত করেন, যে খেতাব একমাত্র ফিদেলেরই ছিল। অথচ ২য় যে ব্যক্তি এই বিশেষ সন্মান পেল তিনি ছিলে গেরিলা দলের একমাত্র বিদেশি সদস্য, একজন আর্জেন্টাইন।
পর্বত-জঙ্গলের সেই গেরিলা যুদ্ধের দিনগুলিতে চে’র ভিন্ন ভিন্ন মানসিকতা ধরা পড়ে, তার কড়া নির্দেশ ছিল যুদ্ধবন্দীদের হত্যা করা যাবে না, এমনকি নিজেই অনেক যুদ্ধবন্দীর চিকিৎসা করতেন। আবার নিজের দলের লোক বেইমানি করলে, বিশেষ করে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে কোন ক্ষতিকারক কাজ করলে বিল্পবের স্বার্থে মৃত্যুদণ্ড দিতে বাধ্য হয়েছেন, বিশেষ করে এক গেরিলার কথা বলা হয়েছে যে নিজেকে ডাক্তার চে পরিচয় দিয়ে রোগী হিসেবে আগত এক কিষাণীকে ধর্ষণের প্রচেষ্টা চালায়। তাকে চে নিজেই গুলি করেন। এই নিয়ে পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে ফিদেল জানান সেই ২৫ মাসের যুদ্ধে এমন ১০জনের মৃত্যুদণ্ড পালন করতে হয়েছে সংগ্রামের তাগিদে।
এক পর্যায়ে আসে চে’র জীবনের সেরা প্রেম অ্যালাইদা মার্চের কথা, কিউবার সান্তা ক্লারা শহরের ( চে’র দেহাবশেষ এই শহরেই সংরক্ষিত, তার আকাশ ছোঁয়া মনুমেন্টের নিচে)। এই তরুণী বাতিস্তা সরকারের অন্যায়ের প্রতিবাদে গেরিলাদের সাথে জড়িয়ে পড়েন। এবং যুদ্ধের নানা ঘনঘটার মাঝেই তারা প্রণয়ে জড়িয়ে পড়েন। এই ব্যাপারে অ্যালাইদার স্মৃতিচারণ ছিল সারা রাত ঘুম না আশায় ভোরে তিনি হাঁটতে বেরিয়েছিলেন, হঠাৎ চে’র জিপগাডড়ি পাশে এসে থামে, একটি অভিযানে যাচ্ছিলেন চে। ঘুম না আসলে আক্রমণে অ্যালাইদাকেও সাথে যাবার আমন্ত্রণ জানান, ব্যস সেই থেকেই সম্পর্কের শুরু! অ্যালাইদার মতে- সেই থেকে আমি কখনো তার পাশ ছাড়িনি, এবং তাকে চোখের আড়ালও করি নি!
যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে চে’র রোজনামচায় উঠে এসেছে সেই বারুদমাখা ঝাঁঝালো সময়ের বর্ণনা, একসময়ের তার নেতৃত্বে সান্তা ক্লারা শহর দখল করতে সক্ষম হয় গেরিলারা, অন্যদিকে দেশে ছেড়ে আমেরিকায় পালিয়ে যায় স্বৈরাচার বাতিস্তা।
হাভানায় বীরের বেশে প্রবেশ করে ফিদেল, রাউল, ক্যামিলো। যদিও চে ছিলেন দৃষ্টিপটের আড়ালে, ফিদেল যথেষ্ট সাবধানে ছিলেন যেন কেউ এই বিপ্লবকে সাম্যবাদীদের বিপ্লব না বলতে পারে, যেখানে চে’র মতো একজন আন্তর্জাতিক মার্কসবাদে দীক্ষিত গেরিলা সবার সামনে আসলে সেই উদ্দেশ্য বানচাল হয়ে যাবে।
শুরু হল নতুন কিউবার যাত্রা, হাভানা বিমান বন্দরে পেরু থেকে এসে তিন বছরের কন্যা সন্তান নিয়ে হাজির হল হিলডা, যাকে সরাসরি আনতে আনতে যেয়ে বন্ধুকে পাঠিয়েছিলেন চে। এরপরে দুইজনের সমঝোতায় ডিভোর্স হয়ে যায় তাদের, যদিও হিলডা হাভানাতেই ছিলেন এবং অ্যালাইদার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন চে।
পরবর্তীতে কায়রো-মাদ্রিদ হয়ে যাত্রার সময় ফিদেল চে’কে অনুরোধ করেন অ্যালাইদাকে সাথে নিয়ে যাবার জন্য, যাতে রাষ্ট্রীয় কাজের সাথে সাথে তাদের হানিমুনটাও হয়ে যায়, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনের সাধ-আহ্লাদের চেয়ে রাষ্ট্র সবসময়ই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল চে’র কাছে। নেতাদের কাছে এটি আরেকবার প্রমাণ করে চে একাই গেলেন সেই সফরে।
এদিকে মার্কিন প্রশাসন রীতিমত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল কিউবা নিয়ে, বিশেষ করে ফিদেলের চেয়ে তাদের মাথা ব্যাথা বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছিল রাউল এবং চে, সিআইএর এজেন্টদের মতে এরা কট্টর মার্কিন বিরোধী এবং সাম্যবাদী, তারা কিউবাতে সোভিয়েত ব্যবস্থা চালু করতে আগ্রহী এবং মার্কিন পণ্য বর্জন করতে জনগণকে উৎসাহিত করছে!
চে কিউবার শুভেচ্ছা দূত হয়ে নানা দেশ সফর করতে থাকেন, বিশেষ করে ভারতে তার তারুণ্যের নায়ক নেহেরুর সাথে সাক্ষাৎ এক তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে, যেখানে বিল্পব সম্পর্কিত যে কোন প্রশ্নই নেহেরু দৃষ্টিকটু ভাবে এড়িয়ে টেবিলের খাদ্যদ্রব্য নিয়ে কথা বলতে থাকেন (পাবলো নেরুদার স্মৃতিকথাতেও নেহেরুর এই শীতল আচরণের কথা আছে) ।
জাকার্তায় ইন্দোনেশিয়ার জাতির জনক খ্যাত সুকর্ণ তার চিত্রকর্মের বিশাল সংগ্রহ চে’কে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখান, এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে চে স্প্যানিশে বলে উঠেন- সুকর্ণ আপনি আমাদের সবকিছুই দেখালেন, কিন্তু আপনার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস- সেই সোনালীচুলো রাশান মেয়েটিকে দেখালেন না! (চে’র কানে গিয়েছিল সুকর্ণ একজন সম্রাটের মতই বিলাসবহুল জীবন যাপন করে এবং তার হারেম বিভিন্ন দেশের নারীতে পূর্ণ, এবং তার সবচেয়ে প্রিয় মেয়েটি রাশিয়া থেকে সদ্য আগত এক স্বর্ণকেশী যে ছিল স্বয়ং ক্রুশ্চেভের উপহার। (যদিও অনুবাদক আর এই কথা সুকর্ণকে সঙ্গত কারণেই বলতে সাহস করে ওঠেনি)।
এমন নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে চে আগুন ঝরা কিউবায় ফিরে আসেন, সেখানে তখন সমাজতন্ত্রের মুখোমুখি হবার ভয়ে দেশত্যাগী ধনিক শ্রেণী আর বিপ্লবীদের বিচার প্রক্রিয়া বিশেষ করে মাতোসকে নিয়ে সরগরম পরিস্থিতি।
তবে মস্কোর সাথে সম্পর্ক অনেক সুদৃঢ় হয় দ্বীপদেশটির মূলত চে-র কারণেই আর আমেরিকার সাথে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে কিউবা, তখন আইসেন হাওয়ারের হাত থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করছে তরুণ ডেমোক্র্যাট জন কেনেডি।
কিউবার শিল্পমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান চে, দায়িত্ব পালনের প্রথম দিনেই অফিস যাবার পথে আক্রমণের মুখোমুখি হয় চে-র গাড়ী, কিন্তু প্রাণে বেঁচে যান তিনি। ধারণা করা হয় সিআইএ’র যোগসাজসে হামলাটি ঘটে। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্বও পান চে, কিন্তু সেই কারণে অতিরিক্ত বেতন নিতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন।
মাঝে শিল্প মন্ত্রণালয় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের কাজ নিয়ে দিনে ১৮-২০ ঘণ্টা ব্যস্ত থাকতেন তিনি, আবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে, রোববারে, স্বেচ্ছা শ্রমের জন্য চলে যেতেন কোন আখ ক্ষেতে অথবা চিনির কলে। এক জন মন্ত্রী হয়ে সাধারণ মজুরের মতই চিনি পরিবহন করতেন। চে-র ধারণা ছিল এইভাবে তিনি আত্মত্যাগ এবং কঠোর পরিশ্রমের নিদর্শন গড়ে তুলে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে পারবেন।
কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই হিতে বিপরীত হল, অনেকেই বলাবলি শুরু করল একজন বিদেশি হয়ে এত কড়া আচরণ কারো পক্ষে মানানসই না, আর বিপ্লব যেহেতু হয়েই গেছে, এখন ক্ষমতা পাওয়া গেছে, একটু আরাম-আয়েশ করা যেতেই পারে!
তখন শুরু হয়ে গেছে আমেরিকার চোরাগোপ্তা হামলা, বিনা উস্কানিতে কিউবার নানা স্থাপনার উপরে। তারই একটিতে বিক্ষুদ্ধ চে-র চোখে জ্বলে ওঠা আগুন তার অজান্তেই ধারণ করেন আলোকচিত্রগ্রাহক আলবার্তো কোর্দা, যে ছবিটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রচার হওয়া ছবিগুলোর একটি। অথচ এই ছবিটি থেকে কোর্দা একটি পয়সাও উপার্জন করেননি, এবং চে-র জীবদ্দশায় ছবিটির কথাও এতটা জানা ছিল না। তার মতে এটি অন্যায়ের বিরুদ্ধ, অপশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের, প্রতিবাদের প্রতীক।
(তবে কোর্দা একবার এক অ্যালকোহল কোম্পানি ভদকার বোতলে এই ছবি ব্যবহার করলে তীব্র প্রতিবাদ করেন, তার মতে চে যেখানে মদ্যপান অপছন্দ করতেন, সেখানে তার ছবি ব্যবহার করে ভদকা বিক্রি চরম অন্যায়)।
এর পরপরই শুরু হয় কেনেডি প্রশাসনের বে অফ পিগসে হামলা, এবং সারা বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিয়ে কিউবা সেই অতর্কিত হামলা প্রতিরোধ করে, বিপুল সংখ্যক মার্কিন বাহিনীকে বন্দী করতে সক্ষম হয়।
কিউবায় নিয়ে এক অন্য ধরনের খেলায় মেতে উঠতে চেয়েছিল ক্রুশ্চেভের সোভিয়েত ইউনিয়ন, তারা বিপুল পরিমাণ সাহায্যের সাথে সাথে সেখানে নিরাপত্তার জন্য মিসাইল উৎক্ষেপন কেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু করে, যা মার্কিন গোয়েন্দা বিমানের ক্যামেরায় ধরা পড়ে, এবং বিশ্ব আসলেই মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায় ৩য় বিশ্বযুদ্ধের! এক পর্যায়ে সেই নির্মাণ কাজ বন্ধ হলে আমেরিকা তার রণতরী ফিরিয়ে নেয়, কিন্তু এখানে ক্রুশ্চেভ অনেক গুটি চেলেছিল কিউবা সরকারের অনুমতি না নিয়েই, এবং তাদের না জানিয়েই।
অন্যদিকে চে সোভিয়েত বড় বন্ধু বলে মনে করা হলেও চীন ভ্রমণের পরে চীনের বিপ্লবকে সোভিয়েতদের চেয়ে গণমানুষের কল্যাণে বেশি সফল মনে করায় সোভিয়েত কর্মকর্তারা তাকে র্যাডিকাল মাওয়িস্ট মনে করে নজরদারি শুরু করে।
কিন্তু চে তখন ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন ল্যাতিন আমেরিকার নানা দেশে বিপ্লব ছড়িয়ে দেবার জন্য, বিশেষ করে স্বদেশ আর্জেন্টিনায়।
(তার মাকে আর্জেন্টিনার জান্তা কোন কারণ ছাড়াই কারারুদ্ধ করে রাখে, অপরাধ ছিল কেন তিনি চে-কে দেখতে কিউবা এসেছিলেন! )
অবশেষে ১৯৬৪ সালের গ্রীষ্মে চে কিউবা ত্যাগ করেন বিপ্লব বাস্তবায়নের স্বপ্নে, সেই সাথে কিউবা নিয়ে পরিষ্কার মনোভাব ছিল সোভিয়েত নির্ভরতা নয়, তাদের মুখাপেক্ষী হিসেবে নয়, স্বকীয়তা নিয়ে বাঁচা সম্ভব একমাত্র ল্যাতিন আমেরিকায় বিপ্লব সাধন হলে।
আপাত আন্তর্জাতিকভাবে এই মন্ত্র ছড়িয়ে দেবার জন্য আফ্রিকা রওনা দেন তিনি, সেখানের প্রতিটি রাষ্ট্র তখন উপনিবেশিক প্রভুদের হাত থেকে স্বাধীনতার জন্য লড়ছে।
চে মিশরের গামাল আব্দুল নাসের, আলজেরিয়ার বেন বেল্লা, তাঞ্জানিয়ার জুলিয়াস নায়েরের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রাখেন, এবং পরিকল্পনা মাফিক সমস্ত আফ্রিকা মহাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম ছড়িয়ে দেবার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
যদিও আফ্রিকার গেরিলাদের সাথে বিশেষত কঙ্গো এবং তরুণ লরেন্ট কাবিলার প্রস্তুতি মোটেও সন্তোষজনক ছিল না। সেখানে বেশ কিছু দিন অতিবাহিত করে অনেকটা ব্যর্থ মনোরথেই চে কিউবায় ফিরে আসেন কিছু পরিকল্পনা পাকা করে আবার আফ্রিকায় ফিরে কাজ শুরু করার জন্য।
এরপরে চে চিরতরে কিউবা ত্যাগ করেন ছদ্মবেশে এবং যাওয়ার আগে স্ত্রী অ্যালাইদাকে বলে যান স্বপ্নের বিপ্লব সফল হলে তার কাছে চলে আসতে, আর যদি তিনি মারা যান তাহলে অ্যালাইদা যেন অবশ্যই অন্য পুরুষকে বিয়ে করে সুখী হয়।
নিরুদ্দেশে অবস্থানের সময় চে’র সবচেতে বড় আশ্রয়স্থল মা সেলিয়া সেরনা দেহত্যাগ করেন, মৃত্যুর আগে এক মর্মস্পর্শী চিঠি লিখে যান প্রিয়পুত্রের উদ্দেশ্যে যেখানে তিনি বলেছেন- পুত্র, তোমার জন্য কোন দেশের দরজা বন্ধ হয়ে গেলেও অন্য দেশের মানুষ তাদের বিপ্লব সাধনে তোমাকে স্বাগত জানাবে।
কিন্তু আফ্রিকায় তাদের সংগ্রাম নানা কারণে ব্যর্থ হয়, চে তাদের গেরিলাদের নিয়ে কঙ্গো ত্যাগ করার মাত্র ৩ দিন পরেই মবুতু ক্ষমতা দখল করে।
আফ্রিকা অবস্থানকালে চে ব্যপক চিন্তা ভাবনা করে তার ধারণাগুলো লিপিবদ্ধ করেন ডায়েরির পাতায়, সেখানে লেখা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসন ব্যবস্থায় এমন কিছু ত্রুটি আছে যার ফলে একদিন এই রাষ্ট্র আবার পুঁজিবাদের দিকেই ফিরে যাবে!
পরে কিউবাতে চে স্বল্প সময় অবস্থান করে উরগুয়ান ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে বলিভিয়া প্রবেশ করেন, এর পরের ইতিহাস সবারই কম-বেশি জানা, আর তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত লেখা বলিভিয়ার ডায়েরি তো আজ ক্ল্যাসিকের মর্যাদা পেয়েছে।
লেখক এখানে ফেলিক্স রডরিগেজ নামের এক কিউবান সিআইএ এজেন্টের কথা বলেছেন, যার উপর দায়িত্ব ছিল চে-কে হত্যা করার।
আহত চে যখন সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী তখন ফেলিক্স চে-র বন্দীশালায় প্রবেশ করে তার মৃত্যুদণ্ডের সংবাদ দেয়। চে শুধু বলেন আমার জীবিত ধরা পড়া উচিত হয়নি। ফিদেলকে বল সমগ্র আমেরিকায় সে নতুন বিপ্লবের যাত্রা দেখতে পারবে, আর আমার স্ত্রীকে বল, সে যেন আবার বিয়ে করে সুখী হয়।
এই পর্যায়ে ফেলিক্স পরে বলেছেন- সেটা ছিল একটি অন্য ধরনের আবেগময় মুহূর্ত, আমি আর চে-কে ঘৃণা করতে পারছিলাম না। সে মৃত্যুকে এক জন পুরুষের মত সাহসিকতার সাথে মোকাবিলা করল।
এরপর বলিভিয়ার একজন সেনাসদস্য মাতাল অবস্থায় চে-কে হত্যার জন্য সেই ঘরে ঢুকে, তার মতে চে-র শেষ কথা ছিল- গুলি কর কাপুরুষেরা, তোমরা তো খুন করছ কেবল একজন মানুষকে।
সূত্র: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৩০
আপনার মতামত জানানঃ