স্নায়ু যুদ্ধের পর থেকে আসছে বছরগুলোতে প্রথমবারের মতো বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্র বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে আর এ ধরনের অস্ত্রের ব্যবহারের ঝুঁকিও কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, বলেছে সংঘাত ও অস্ত্র বিষয়ক শীর্ষস্থানীয় একটি থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক।
প্রায় ৮০ বছর ধরেই পারমাণবিক অস্ত্র আছে পৃথিবীতে, এবং একে এক ধরণের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে দেখা হয়, মানে এটি রাষ্ট্রসমূহের জাতীয় নিরাপত্তার নিশ্চয়তা হিসেবে কাজ করে।
তবে আগামী কয়েক বছরে বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণে বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। স্নায়ুযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো সবচেয়ে বেশিসংখ্যক পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত হতে পারে। এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের ঝুঁকিও কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।
আজ সোমবার সুইডেনভিত্তিক সংস্থা স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (সিপ্রি) নতুন এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন আভাস দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পারমাণবিক অস্ত্র রাশিয়ার হাতে বেশি আছে।
সিপ্রির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালের জানুয়ারি ও ২০২২ সালের জানুয়ারির মধ্যবর্তী সময়ে বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা কিছুটা কমেছিল।
কিন্তু ইউক্রেনে রুশ অভিযান আর কিয়েভের প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থনকে কেন্দ্র করে বিশ্বের ৯ পারমাণবিক অস্ত্রধর দেশের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে। অবিলম্বে পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো ব্যবস্থা না নিলে বিশ্বে পরমাণু অস্ত্র উদ্ভাবনের সংখ্যা দ্রুত বাড়বে।
সিপ্রির ২০২২ সালের বার্ষিক পর্যালোচনা-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটির গণবিধ্বংসী অস্ত্র কর্মসূচি-সংক্রান্ত পরিচালক উইলফ্রেড ওয়ান বলেন, ‘পারমাণবিক অস্ত্রধর দেশের সব কটি তাদের অস্ত্রের মজুত বাড়াচ্ছে কিংবা উন্নত করছে। বেশির ভাগই পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে বাগাড়ম্বর করছে, পারমাণবিক অস্ত্র তাদের সামরিক কৌশলে কী ভূমিকা রাখছে, তা নিয়ে কথা বলছে। এটি খুব উদ্বেগজনক প্রবণতা।’
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান শুরুর তিন দিন পর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পারমাণবিক অস্ত্রের দায়িত্বে থাকা বাহিনীকে উচ্চ সতর্কতায় রেখেছিলেন। যারা রাশিয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, সেসব দেশকে নজিরবিহীন পরিণতি ভোগ করার হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
রাশিয়ার কাছে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত আছে। দেশটির পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ৫ হাজার ৯৭৭, যা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ৫৫০টি বেশি।
এই দুই দেশের কাছে যে পরিমাণ অস্ত্রের মজুত আছে, তা বিশ্বের মোট পারমাণবিক অস্ত্রের ৯০ শতাংশের বেশি। তবে আরেক শক্তিধর দেশ চীন অস্ত্রের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। তিন শতাধিক নতুন ক্ষেপণাস্ত্র মজুত করেছে তারা।
সিপ্রির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালের জানুয়ারিতে বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্র মজুতের সংখ্যা ১৩ হাজার ৮০ ছিল। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে সে সংখ্যা কমে ১২ হাজার ৭০৫-এ দাঁড়িয়েছে।
ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমানের সঙ্গে ৩ হাজার ৭৩২টি ওয়ারহেড মোতায়েন রাখা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২ হাজার অস্ত্রকে উচ্চ সতর্ক অবস্থানে রাখা হয়েছে। এগুলোর প্রায় সবই যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার।
এসআইপিআরআইয়ের বোর্ড চেয়ারম্যান এবং সুইডেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্তিফান লুভেন বলেছেন, ‘এমন একসময় বিশ্বের মহাশক্তিধরগুলোর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে যখন মানবতা এবং গ্রহটি গভীর ও জরুরি সাধারণ চ্যালেঞ্জের একটি ধারার মুখোমুখি, যা শুধু আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে সমাধান করা যেতে পারে।’
ভারত, ইসরাইল ও পাকিস্তান কখনো পরমাণু অস্ত্র-বিস্তার রোধ চুক্তি বা এনপিটিতে সই করেনি। উত্তর কোরিয়া সই করেও ২০০৩ সালে চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়। এই চুক্তি অনুযায়ী স্বীকৃত পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হচ্ছে মাত্র পাঁচটি স্বাক্ষরকারী দেশ যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স ও চীন। এই চুক্তিতে অস্বীকৃত দেশগুলোর পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা, বেলারুস, কাজাখস্তান ও ইউক্রেন তাদের পরমাণু কর্মসূচি পরিত্যাগ করেছে।
অন্যদিকে চীন, পাকিস্তান, ভারত ও উত্তর কোরিয়া তাদের পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যা বাড়াচ্ছে বলে মার্কিন বিজ্ঞানীদের একটি ফেডারেশন বলেছে। প্রায় আশি বছর ধরেই পারমাণবিক অস্ত্র আছে পৃথিবীতে এবং একে এক ধরনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে দেখা হয়, মানে এটি রাষ্ট্রসমূহের জাতীয় নিরাপত্তার নিশ্চয়তা হিসেবে কাজ করে।
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পর দেশ প্রতি পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমে গেছে। ৩৫০টি নিয়ে চীন তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের এক দশমাংশেরও কম। দেশটি প্রথম স্নায়ুযুদ্ধের সময় পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করেছিল এবং ২০২০ সাল থেকে আরও ৩০টি যোগ করে তার পারমাণবিক অস্ত্রাগার সম্প্রসারণ অব্যাহত রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।
গত নভেম্বরে, পেন্টাগনের একটি প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছিল যে, চীনের পারমাণবিক শক্তি এক বছর আগে মার্কিন পূর্বাভাসের চেয়ে অনেক দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের আশঙ্কা, ২০৩০ সালের মধ্যে বেইজিংয়ের কাছে এক হাজারের বেশি অস্ত্র থাকতে পারে।
এদিকে ফ্রান্সের পরমাণু অস্ত্রের সরবরাহ ২৯০টি পারমাণবিক অস্ত্রসহ চতুর্থ স্থানে রয়েছে, যা পশ্চিম ইউরোপের বৃহত্তম সংখ্যা। এই অস্ত্রগুলোর বেশির ভাগই সাবমেরিনের ওপর ভিত্তি করে, বাকিগুলো বায়ুচালিত ক্রুজার ক্ষেপণাস্ত্রের ওপর ভিত্তি করে। দেশটি প্রথম ১৯৬০ সালে পারমাণবিক হামলার ক্ষমতা পরীক্ষা করে।
সংখ্যার হিসাবে এর পরই যুক্তরাজ্যের ২২৫টি, পাকিস্তানের ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৬৫টি, ভারতের ১৫৬টি এবং ইসরাইলের ৯০টিসহ উত্তর কোরিয়ার কাছে ৫০টির মতো পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।
২০১৭ সালে উত্তর কোরিয়া এখন পর্যন্ত তার সবচেয়ে বড় পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছে, যার আনুমানিক ওজন ১০০-৩৭০ কিলোটন। তুলনামূলকভাবে, হিরোশিমায় ফেলা মার্কিন বোমাটির ওজন ছিল প্রায় ১৫ কিলোটন।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া ও ফ্রান্স। এক নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নিল যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। ক্ষমতাধর এই পাঁচ দেশই পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক, যারা সংক্ষেপে ‘পি-৫’ নামে পরিচিত। এবার এই দেশগুলোর শীর্ষ নেতারা যৌথভাবে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা এড়াতে পারমাণবিক অস্ত্রের দৌরাত্ম্যে লাগাম টানার প্রয়োজনীয়তার কথা জানালেন। রাশিয়ার প্রশাসনিক কেন্দ্র ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ভবিষ্যৎ বিশ্বে পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি এড়ানোর দায় এই পাঁচ দেশের।
পারমাণবিক অস্ত্র কতটা বিধ্বংসী?
পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিই করা হয়েছে সর্বোচ্চ ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য। তাই ধারণা করা যায় পারমাণবিক অস্ত্র কতটা ক্ষতির কারণ হতে পারে।
তবে কোন অস্ত্র কতটা বিধ্বংসী হবে সেটি নির্ভর করে বেশ কয়েকটি বিষয়ের ওপর। এর মধ্যে রয়েছে ওয়ারহেডের আকার, ভূমির কতটা ওপরে এটি বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম এবং স্থানীয় পরিবেশ।
কিন্তু সবচাইতে ছোট ওয়ারহেডও ব্যাপক প্রাণহানি এবং দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি ঘটাতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমায় যে বোমাটি এক লাখ ৪৬ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছিল, তার ওজন ছিল ১৫ কিলোটন।
যেখানে বর্তমান সময়ের ওয়ারহেডগুলো এক হাজার কিলোটনের বেশি হতে পারে। কোন পারমাণবিক বিস্ফোরণ হলে তার চারপাশের এলাকায় কোন কিছু অবশিষ্ট থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৪০
আপনার মতামত জানানঃ