বিশ্বে বেশ কিছু কারাগার আছে; যেখানকার অত্যাচারের বর্ণনা গা শিউরে ওঠার মতো এবং সবই প্রকাশ্যে! এমনই এক কারাগার ‘তাদমোর’। বিশ্বের সবচেয়ে জঘন্য কারাগার হিসাবেই বিবেচিত ‘তাদমোর’। মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক বেসরকারী সংস্থা ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’-এর মতে এই কারাগারটিকে নরক বললেও কম বলা হবে। এই কারাগারে বন্দিদের ওপর এতটাই নির্যাতন করা হয়, তারা যেন মারা গেলেই বেঁচে যান!
তাদমোর কারাগারের অবস্থান সিরিয়ার পালমিরায়। এটি মূলত এক সময়ে সামরিক বাহিনীর সেনাছাউনি হিসাবে ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীতে কারাগারে রূপ নেয়। ইতিহাস বলছে, ফরাসিরা ১৯৩০-এর দশকে আরবের মরুভূমির কেন্দ্রে তৈরি করে এই কারাগারটি। কিন্তু ১৯৮০-এর পর এই জায়গার ব্যবহারে বদল আসে।
তাদমোর কারাগারের বন্দিদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলার নেপথ্যে যে মানুষের হাত ছিল বলে মনে করা হয়, তিনি সিরিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল-আসাদ। ১৯৮০ সালে আল-আসাদের ওপর প্রাণঘাতী আক্রমণ করা হয়। কিন্তু তিনি প্রাণে বেঁচে যান। আল-আসাদের উপর আক্রমণের দায় বর্তায় ‘দ্য সোসাইটি অব দ্য মুসলিম ব্রাদার্স’-এর ওপর। এর পরই আল-আসাদের ভাই রিফাত গণহত্যার আদেশ দেন। মনে করা হয় এই গোষ্ঠীর প্রায় হাজার সদস্যকে মেরে তাদের মৃতদেহ তাদমোর কারাগারের বাইরে কবর দেওয়া হয়।
তাদমোর কারাগারের বন্দিদের বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়। এখানে থাকা বন্দিদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করার স্বপ্ন দেখাই যেন পাগলের প্রলাপ! এই কারাগারে একে অপরের সঙ্গেও দেখা করার সুযোগ দেওয়া হত না। একে অপরের সঙ্গে কথা বললে যে কোনো সময়ে দেওয়া হত মৃত্যুদণ্ডের আদেশ।
তাদমোর কারাগারটি বৃত্তাকার। এই কারাগারটি এমন ভাবেই তৈরি করা হয়েছিল, যাতে প্রহরীরা যে কোনো সময়ে সমস্ত বন্দির উপর নজর রাখতে সক্ষম হন। তাদমোর কারাগারে বন্দিদের মাথা তোলার, উপরে তাকানোর বা একে অপরের দিকে তাকানোর অনুমতি পর্যন্ত দেওয়া হত না।
১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার মানুষকে এই কারাগারে বন্দি হিসেবে রাখা হয়েছিল, যাদের মধ্যে একটি বড় অংশ ছিলেন রাজনৈতিক কর্মী। এক সময়ে তাদমোর কারাগার বন্দিদের সংখ্যা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, বন্দিদেরকে পালা করে ঘুমানোর সুযোগ দেওয়া হত। যখন কিছু বন্দি ঘুমাতেন, তখন বাকিদের দাঁড় করিয়ে রাখা হতো।
কারারক্ষী ও কারাগার কর্তৃপক্ষ কখনোই কোনো বন্দিদের প্রতি দয়া দেখাতেন না। দয়া দেখানো হয়নি সিরিয়ার কবি ফারাজ বায়রাকদারকেও। তাকেও চার বছর এই কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। ফারাজ নিজের লেখা বইয়ে এই কারাগারকে ‘মৃত্যু ও উন্মাদনার রাজ্য’ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন।
ফারাজ ব্যাখ্যা করেন, সব বন্দিকে সারাদিন অবরুদ্ধ রাখা হতো। কোনো বন্দি যদি শ্বাসকষ্ট হচ্ছে বলে জানাতেন, তাহলে তাদের কারাগার চত্বরের উঠানের চারপাশে দৌড়াতে বলা হতো। এর ফলে শ্বাস আটকে মারাও যেতেন অনেকে। কখনও কখনও আবার শুধু পিটিয়ে হত্যা করা হত কারাগারের বন্দিদের।
ফারাজের বইতে বন্দিদের জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় নির্যাতনের কিছু পদ্ধতির উল্লেখ রয়েছে। কারাগারে ঢোকার পরপরই বন্দিদের নিষ্কাশনের জন্য ব্যবহৃত একটি ড্রেনের পানি খেতে বলা হতো। অন্য এক বন্দি মোস্তফা খলিফার মতে, যারা এই পানি খেতে অস্বীকার করতেন, তাদের সেখানেই মেরে ফেলা হত।
এই কারাগারে বন্দিদের ওপর এতটাই নির্যাতন করা হয়, তারা যেন মারা গেলেই বেঁচে যান। ছবি: সংগৃহীত
এই কারাগারে বন্দিদের ওপর এতটাই নির্যাতন করা হয়, তারা যেন মারা গেলেই বেঁচে যান। ছবি: সংগৃহীত
বইয়ে উল্লেখ রয়েছে যে, এক কারাবন্দিকে এক দল প্রহরী একবার মৃত ইঁদুর গিলে খেতে বাধ্য করে। ওই ব্যক্তি মৃত ইঁদুরটি খেয়ে মারা না গেলেও কিছু মাস পর তিনি পাগল হয়ে যান। এক বয়স্ক বন্দিকে এক বার মাটিতে শুইয়ে সারাদিন ধরে এক জন কারা অফিসারের বুট (বিশেষ জুতা) চাটতে বলা হয়েছিল।
নিয়মিত বেত্রাঘাত তো ছিলই। পাশাপাশি বন্দিদের একই জায়গায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করা হত যত ক্ষণ না তাঁরা মারা যান। তবে ফারাজের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর স্মৃতি একজন বন্দিকে ‘মানব ট্রামপোলিন’ হিসাবে ব্যবহার করা। এই প্রক্রিয়ায় বন্দিকে মাটিতে শুইয়ে প্রহরীরা তার ওপর দাঁড়িয়ে লাফাতেন। যতক্ষণ না ওই বন্দি ঘাড় বা মেরুদণ্ড ভেঙে মারা যান, ততক্ষণ এই প্রক্রিয়া চলতে থাকত।
২০১৫ সালে ইসলামিক স্টেট (আইসিস) এই কারাগারটি দখল করে নেয়। এর পর এই কারাগারের ভেতরের ছবি প্রকাশ পায়। অধিগ্রহণের নয় দিন পরে আইসিস এই কারাগার বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়।
এসডব্লিউ/এসএস/২০৩৩
আপনার মতামত জানানঃ