পূর্ব আফ্রিকার দেশ সোমালিয়ায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে দুর্ভিক্ষ। সেখানে প্রতিদিন শতাধিক শিশু মারা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ভিক্ষকবলিত অঞ্চলগুলো যদি জরুরি সাহায্য না পায় তাহলে অনাহারে আরও হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটবে৷ শিশুদের মৃত্যুর প্রধান কারণ তাদের মায়ের পুষ্টিহীনতা ও খাদ্যের অভাব।
সোমালিয়ায় ৭৭ লাখ মানুষের জন্য মানবিক সহায়তা ও নিরাপত্তা প্রয়োজন। ২০২১ সালে এ সংখ্যা ছিল ৫৯ লাখ। মঙ্গলবার জাতিসংঘের সহায়তা সংস্থা এ তথ্য দিয়েছে বলে জানিয়েছে এএনআই।
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয়-বিষয়ক কার্যালয় (ওসিএইচএ) বলছে, ক্রমবর্ধমান খরায় সোমালিয়ার বিভিন্ন অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনাবৃষ্টির ফলে দেশটিতে অনেক জীবন শেষ হয়ে গেছে।
ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলো অভাবের চূড়ান্ত পর্যায়ের কাছাকাছি পৌঁছেছে। মানবিক তহবিল বরাদ্দ নিয়ে তৈরি সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে ওসিএইচএ এ তথ্য দিয়েছে।
জাতিসংঘ বলছে, কয়েক দশক ধরে চলা সংঘাত, নিরাপত্তাহীনতা, অনাবৃষ্টিসহ জলবায়ুগত নানা আঘাত এবং রোগের প্রাদুর্ভাবে সৃষ্ট তীব্র অভাবের সঙ্গে তীব্র খরা সোমালিয়ার পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে।
ওসিএইচএ জানিয়েছে, ২৫ মিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ বরাদ্দ খরায় তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে দুর্গম এলাকার লোকজনের জন্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় সহায়ক হবে।
জাতিসংঘ বলছে, সোমালিয়ায় খরা-দুর্গত এলাকায় হাজার হাজার শিশু স্কুল থেকে ঝরে যাচ্ছে, কেননা তাদের বাবা-মায়েরা পড়াশোনার খরচ চালাতে পারছেন না। সেসব অঞ্চলে খাদ্য অনিরাপত্তা ও অপুষ্টির মাত্রাও অনেক বেশি।
কয়েক দশক ধরে চলা সংঘাত, নিরাপত্তাহীনতা, অনাবৃষ্টিসহ জলবায়ুগত নানা আঘাত এবং রোগের প্রাদুর্ভাবে সৃষ্ট তীব্র অভাবের সঙ্গে তীব্র খরা সোমালিয়ার পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে।
দীর্ঘদিন ধরে চলা গৃহযুদ্ধ ও ইসলামপন্থী জঙ্গিদের তৎপরতার কারণে গত কয়েক বছরে হাজার হাজার পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে সোমালিয়ায়। গ্রাম ছেড়ে বিভিন্ন শহরের অস্থায়ী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন তারা।
সোমালিয়ায় টানা চার বছর ধরে বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। হলেও একেবারে কম। দেশটির আবহাওয়াবিদদের মতে, গত ৪০ বছরে এমন ভয়াবহ খরা দেখেনি সোমালিয়া। পানির অভাবে দেশটির কৃষি ব্যাবস্থা প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে, বিপুল সংখ্যক গবাদি পশু মৃত্যুও হয়েছে এই খরার কারণে। গৃহযুদ্ধ ও খরাজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত হয়ে সোমালিয়ার বিভিন্ন শহরে বর্তমানে আশ্রয় নিয়েছেন অন্তত ৬০ লাখ মানুষ। জরুরি ভিত্তিতে আর্থিক ও মানবিক সহায়তা প্রয়োজন তাদের।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। গোটা বিশ্বের মনযোগ এখন ইউক্রেনের দিকে, কিন্তু আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও জাতিসংঘ সোমালিয়ার দুর্গতদের জন্য বিশ্বের মনযোগ আকর্ষণ করতে প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
জাতিসংঘের বক্তব্য অনুযায়ী, বর্তমানে সোমালিয়ায় খাদ্য সংকটজনিত কারণে যে দুর্যোগ দেখা দিয়েছে, তার সঙ্গে দেশটির ২০১১ সালের মহা দুর্ভিক্ষের তুলনা করা চলে। ওই দুর্ভিক্ষে সোমালিয়ায় আড়াই লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এবং তাদের অধিকাংশই ছিল ৫ বছরের কম বয়সী শিশু।
জাতিসংঘ অবশ্য ইতোমধ্যে সোমালিয়ার দুর্গত লোকজনের জন্য কিছু আর্থিক বরাদ্দ দিয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই তহবিলের মাত্র ১৫ শতাংশ পৌঁছেছে দেশটিতে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে এ পর্যন্ত ২৮ লাখ দুর্গত মানুষ সেই তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়েচেন, আর এখনও কোনো সহায়তা পাননি অন্তত ৩১ লাখ মানুষ।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, সোমালিয়ার ৬ টি এলাকার প্রায় দেড় কোটি মানুষ খরার কারণে ব্যাপক সংকটে পড়েছেন। তাদের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ লাখ মানুষ বিভিন্ন শহর ও তার আশপাশের এলাকাগুলোতে থাকেন, বাকিরা থাকেন দেশটির অন্যান্য দুর্গম অঞ্চলে। সেসব অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ করছে জঙ্গি গোষ্ঠী আল শাবাব।
সাহায্যের পরিবর্তে অনেক পরিবার এক মুঠো খাবার কিংবা সামান্য কিছু পয়সা ভিক্ষাও চাইছে, কিন্তু তাও মিলছে না ঠিকমতো। ক্ষুধা-অপুষ্টির পাশাপাশি রোগে ভুগেই ত্রান শিবিরে মারা যাচ্ছে অনেক শিশু।
জাতিসংঘ সতর্ক করেছে যে, সংঘাতে বিপর্যস্ত সোমালিয়ায় খরার কারণে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। সেখানে বিগত তিন ঋতু কম বৃষ্টিপাতের পরে চতুর্থ দফা বৃষ্টিপাত কম হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জাতিসংঘ বলেছে, বিগত ৩০ বছরে দেশটিতে কখনো টানা তৃতীয়বার বৃষ্টিহীন বর্ষাকাল দেখা যায়নি। পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, সংঘাত নয় বরং প্রাকৃতিক দুর্যোগ সোমালিয়ায় বাস্তুচ্যুতির প্রধান কারণ। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
সোমালিয়া সংক্রান্ত জাতিসংঘ মানবিক সমন্বয়ক অ্যাডাম আবদেলমৌলা এক সাক্ষাৎকারে এএফপিকে বলেছেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে পাঁচ বছর বা তার কম বয়সী ৩ লাখ শিশু গুরুতর অপুষ্টির ঝুঁকিতে পড়বে।
আফ্রিকার ছোট্ট দেশ সোমালিয়া। কিছুটা প্রাকৃতিক হলেও দেশটিতে দুর্ভিক্ষের অধিকাংশই মানবসৃষ্ট। স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই জাতি ও অঞ্চলগত দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে দেশটি। ফলে সরকার ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার কোনো কাজ বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি ত্রাণ নিয়ে বেশ কিছু অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারেনা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। আন্তর্জাতিক সংস্থার পর্যবেক্ষণে বেরিয়ে এসেছে এ তথ্য।
সর্বশেষ ২০১১ সালে সংগঠিত দুর্ভিক্ষে ২ লাখ ৬০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা দেয়ার আগেই অর্ধেক মানুষের মৃত্যু হয়। যার অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু। বর্তমানে দেশটির প্রায় জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ বা ৩০ লাখ লোক খাদ্য নিরাপত্তায় ভুগছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬১৪
আপনার মতামত জানানঃ