ইতোমধ্যেই আমেরিকার ১৯টি রাজ্য এবং ওয়াশিংটন ডি.সি আমোদপ্রমোদের উদ্দেশ্যে গাঁজা সেবনকে বৈধতা দিয়েছে। চলতি বছরে আরো কয়েকটি রাজ্যের নাম এই তালিকায় যুক্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গাঁজা সেবনকে বৈধতা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পাশাপাশি গাঁজা নিয়ে সমাজের মানুষের উষ্মাও কমতে শুরু করেছে। চলতি মাসে পরিচালিত হ্যারিস পোল অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকানদের তিনভাগের প্রায় দুই ভাগেরও বেশি (৬৮%) এখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গাঁজা সেবনকে সমর্থন করে।
এদের মধ্যে প্রতি এক হাজারের অর্ধেক মানুষই জানিয়েছেন, অবকাশযাপন-গন্তব্য খোঁজার ক্ষেত্রে আমোদপ্রমোদের উদ্দেশ্যে গাঁজা সেবনে বৈধতা দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া, প্রতি ১০ হাজারে চারজনেরও বেশি মানুষ (৪৩%) জানিয়েছেন, তারা ছুটি কাটাতে এমন সব জায়গাই খোঁজেন যেখানে গাঁজা বৈধ।
এমারাল্ড ফার্ম ট্যুরস-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ভিক্টর পিনহো এই পুরো বিষয়টিকে ‘গাঁজা পর্যটন’ নামে আখ্যা দিয়েছেন। তার ভাষ্যে, এখনো পর্যন্ত আমেরিকার পর্যটন শিল্প ও পরিষদ ‘গাঁজা পর্যটন’কে গুরুত্ব দিচ্ছে না বললেই চলে, অথচ এই বিশেষ ঘরানার পর্যটন শিল্পের মাধ্যমেই তাদের পকেটে আসছে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার।
পিনহো বলেন, তারা পর্যটক এবং তারা এই গাঁজার দুনিয়ায় আসে টাকা খরচ করতে। তিনি আরো ব্যাখ্যা করেন, এখানে ভ্রমণের সময় তার ক্রেতারা সাধারণত ডিসপেন্সারিতে ৩০০ থেকে ৪০০ ডলার খরচ করেনই।
কিন্তু বর্ধনশীল এই গাঁজা পর্যটন শিল্প ভবিষ্যতে কতখানি বিস্তার লাভ করবে বা যুক্তরাষ্ট্রের ১.২ ট্রিলিয়ন ডলারের পর্যটন খাতে এর অর্থনৈতিক প্রভাব কী হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে বর্তমান ডেটা কিন্তু উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথাই বলছে।
মহামারির আগে ২০২০ সালে দেশের অভ্যন্তরে বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান এমএমজিওয়াই ট্রাভেল ইন্টেলিজেন্স ইনসাইটস পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি পাঁচজনে একজন (১৮ শতাংশ) আমেরিকান পর্যটক অবকাশযাপকালে গাঁজা সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা নিতে আগ্রহী।
এই জরিপ যখন ২১ বছরের উর্ধ্বে গাঁজা সেবনকারী প্রাপ্তবয়স্কদের (যাদের বার্ষিক আয় ৫০,০০০ ডলারের বেশি) মধ্যে করা হয়, তখন সংখ্যাটা এক লাফে ৬২ শতাংশে গিয়ে পৌঁছায়।
গাঁজাকে বৈধতা দেওয়ার ফলে অন্যান্য ব্যবসায়ও সমৃদ্ধি ঘটেছে। ২০২১ সালে বৈধভাবে ২৫ বিলিয়ন ডলার গাঁজা বিক্রি হয়েছে, যার মধ্যে ৪.৫ বিলিয়ন ডলারই ছিল পর্যটকদের পকেট থেকে আসা।
এছাড়াও রেস্টুরেন্ট, হোটেল, পর্যটন কেন্দ্র, বিভিন্ন দোকান এবং রাজ্যের মিউনিসিপ্যালিটি করসহ পর্যটকেরা ব্যয় করেছে আরো ১২.৬ বিলিয়ন ডলার। কারণ খুচরা গাঁজা বিক্রেতাদের পেছনে খরচ করা প্রতিটি পয়সার একাধিক প্রভাব রয়েছে স্থানীয় অর্থনীতিতে, জানান হুইটনি ইকোনোমিকসের প্রধান অর্থনীতিবিদ বিউ হুইটনি, যিনি গাঁজার ব্যবসায়ে একজন কনসালটেন্টও বটে।
বেশিরভাগ পর্যটন গন্তব্যের ক্ষেত্রে গাঁজাই তাদের নিয়মিত আয়ের এমন একটি উৎস, যেখানে কোনোরকম প্রচারণাই চালাতে হচ্ছে না তাদের। কলোরাডোর কথাই ধরা যাক, সেখানে আমোদপ্রমোদের উদ্দেশ্যে গাঁজা সেবন-বিক্রি বৈধ করা হয়েছে প্রায় এক দশক আগে।
গত বছর গাঁজা থেকে তাদের আয় ৪২৩ মিলিয়ন ডলার। কলোরাডো পর্যটন কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে গাঁজা সেবন সংক্রান্ত সুরক্ষা টিপস, আইনি নির্দেশিকা এবং অন্যান্য ব্যবহারিক উপদেশও দেওয়া আছে।
কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা মেইলের মাধ্যমে জানান, “গাঁজা আমাদের পর্যটনের সমৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি নয়, সে তুলনায় আউটডোর বিনোদনের ব্যবস্থা থেকে বেশি আয় হয়।”
এদিকে কলোরাডো গাঁজার মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে পর্যটক আকর্ষণের চেষ্টা না করলেও, অন্যান্য রাজ্যের উদ্যোক্তারা কিন্তু করছেন। খুব শীঘ্রই ডেনভারের প্যাটারসন ইন নামক নয় বেডরুমের হোটেলটি শহরের প্রথম লাইসেন্সধারী গাঁজা সেবন লাউঞ্জ নির্মাণ করতে যাচ্ছে।
হোটেলের মালিক ক্রিস কিয়ারি জানান, ১১০০ বর্গফুটের এই লাউঞ্জের নাম হবে ‘৪২০ স্যুইট’ এবং বছরের শেষদিকে তা গ্রাহকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
ইতোমধ্যে আরো কিছু ভ্রমণ গন্তব্যও ‘গাঁজা পর্যটন’কে গ্রহণ করতে শুরু করেছে। ক্যানাবিস ট্রাভেল এসোসিয়েশন ইন্টারন্যাশনাল-এর প্রতিষ্ঠাতা ব্রায়ান অ্যাপলগার্থ বলেন, পর্যটন শিল্পের নেতাদের সংকীর্ণতার তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের পর্যটকদের গাঁজার সাথে সংশ্লিষ্টতা অনেক বেশি স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা হচ্ছে এখন।
ক্যালিফোর্নিয়ার সেন্ট্রাল ভ্যালির একটি পর্যটন তথ্য কেন্দ্র, ভিজিট মডেস্টো’র সিইও টড অ্যারনসনও তার কথার সাথে একমত। তিনি বলেন, কুকুরপ্রেমীরা গাঁজা সেবন করে। যারা ফুডি বা অনেক খেতে ভালোবাসে, তারাও গাঁজা সেবন করে। তাই সাধারণ পর্যটক ও ‘ক্যানাবিস ট্রাভেলার’ বা গাঁজা পর্যটকের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
গত বছর মডেস্টো অ্যাপলগার্থের প্রতিষ্ঠিত গাঁজা পর্যটন ফার্ম ‘কাল্টিভার’ এর সাথে অংশীদার হয়েছে। তারা দুজনে মিলে পাসপোর্ট ধরনের একটি প্রোগ্রাম চালু করেন, যার নাম ‘মো টাউন ক্যানাপাস’।
এই প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে, পাসপোর্টধারী পর্যটকেরা ওই অঞ্চলের রেস্টুরেন্ট, খুচরা গাঁজা বিক্রেতাসহ গাঁজা সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকান্ডে অংশ নিতে পারবেন এবং এই সবকিছুই হবে বৈধ প্রক্রিয়ায়। অ্যারনসনের মতে, একটা মদের বারে গিয়ে মানুষ যেভাবে উপভোগ করে, তারাও এখানে সেভাবেই গাঁজা সেবনের সুযোগ করে দিচ্ছেন। এখানে সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখা হয়, প্রতিটি পর্যটককেই স্বাগত জানানো হয়।
অ্যারনসন আরো জানান, মো টাউন ক্যানাপাস স্থানীয় খুচরা গাঁজা বিক্রেতাদের ব্যবসায়ে তাৎক্ষণিকভাবে ১১ শতাংশ লাভের কারণ হয়েছে। তাই এ সিদ্ধান্ত নিয়ে তার কোনো অনুশোচনা নেই, বরং এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হিসেবেই দেখছেন তিনি।
ক্যালিফোর্নিয়া গাঁজা পর্যটনের প্রধান কেন্দ্র হওয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য জায়গাগুলোতেও এটি বিস্তার লাভ করছে। মিডওয়েস্টে মিশিগান ক্যানাবিস ট্রেইল দর্শণার্থীদের সাহায্য করছে গ্রেট লেক এলাকায় বৈধ উপায়ে গাঁজা সেবনের সকল সুবিধা নিতে। কেন্টাকিতে আমোদপ্রমোদের উদ্দেশ্যে গাঁজা সেবন এখনো অবৈধ হলেও, হেম্প হাইওয়ে ব্লুগ্রাস স্টেটে ঠিকই সুবিধা নিচ্ছে।
পূর্ব উপকূলের দিকে ফ্লোরিডাতেও গাঁজা পর্যটন শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার পর সানশাইন স্টেট দেশটির পর্যটন খাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আয়ের অধিকারী। ফ্লোরিডাতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ মারিজুয়ানা বাজার, যার বার্ষিক বিক্রি ১ বিলিয়ন ডলার। যদিও ফ্লোরিডাতে আমোদপ্রমোদকালীন গাঁজা সেবন বৈধকরণের সিদ্ধান্তে রাজি হননি সরকারি নেতারা।
কিন্তু যদি বৈধ করা হয় তাহলে ফ্লোরিডার গাঁজা পর্যটন শিল্পের আকার কেমন হবে? ২০১৯ সালে অর্থনৈতিক প্রভাব সংক্রান্ত গবেষণায় আনুমানিক হিসাব করা হয় যে, ফ্লোরিডাতে গাঁজা পর্যটন বৈধ করা হলে বাড়তি ১৯০ মিলিয়ন ডলার বিক্রয় ট্যাক্স যুক্ত হবে রাজ্যের ভাণ্ডারে। গাঁজা শিল্পের হিসাবে অর্থের অংকটা বোধহয় খারাপ নয়!
এসডব্লিউ/এসএস/১২১৫
আপনার মতামত জানানঃ