প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে যুগে যুগে অনেক শহর, সভ্যতা বিলুপ্ত। সেই রকমই একটি শহর বা সভ্যতার মধ্যে অন্যতম হল আটলান্টিস। হারিয়ে যাওয়া শহরের বিষয়ে সবাই নিশ্চয় শুনে থাকবেন! তবে কোথায় ছিল সেই শহর তার কোনো প্রমাণ মিলেনি।
গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর বর্ণনায় খ্রিষ্টপূর্ব ৩৬০ অব্দে সর্বপ্রথম আটলান্টিসের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্লেটো রচিত ডায়লগ ‘টিমিয়াস’ এবং ‘ক্রিটিস’এ আটলান্টিসের কাহিনী বর্ণিত হয়েছিল। প্রাচীনকালে রচিত এই গ্রন্থ দুটিতেই আটলান্টিসের বর্ণনা আছে।
বর্তমানে এর সম্পর্কে অসংখ্য গ্রন্থে বর্ণনা পাওয়া গেলেও প্রাচীনকালের ‘টিমিয়াস’ এবং ‘ক্রিটিস’ ছাড়া অন্য কোনো গ্রন্থে এর উল্লেখ পাওয়া যায় না। প্লেটোর মতে, প্রায় নয় হাজার বছর আগে আটলান্টিস ছিল হারকিউলেসের স্তম্ভের পাদদেশে একটি দ্বীপ। তাদের নৌবিদ্যা এবং শক্তি ছিল অপরিসীম।
আটলান্টিস তাদের নৌ-বাহিনী দ্বারা ইউরোপার সিংহভাগ অঞ্চল দখল করেছিল। তবে এথেন্স জয় করতে তারা ব্যর্থ হয়। এরপর এক রাতের মহাপ্রলয়ে আটলান্টিস সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। সেটা হয়তো ভূমিকম্প জাতীয় দুর্যোগ ঘটিত প্রলয়। অনেকের মতেই বড় কোনো ভূমিকম্প বা সুনামির কারণে এই শহর ধ্বংসের পথে চলে যায়।
প্লেটোর বর্ণনার পূর্বে আটলান্টিস সম্পর্কে কোনো লিখিত তথ্য না থাকলেও এ সম্পর্কে লোককাহিনী প্রচলিত ছিল বলে ধারণা করা হয়। প্লেটো এই কাহিনীর সূত্র পেয়েছিলেন বিখ্যাত এথেনীয় গ্রিক আইন প্রণেতা সোলোনের (খ্রিষ্টপূর্ব ৬৩৮-৫৫৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) কাছ থেকে।
সোলোন ছিলেন একাধারে আইন প্রণেতা, কূটনীতিজ্ঞ এবং কবি। তিনি প্লেটোর জন্মেরও প্রায় ১৫০ বছর পূর্বে মিশর ভ্রমণ করেছিলেন। প্রাচীন মিশরের প্যাপিরাসের কাগজে এথেন্স এবং আটলান্টিস সম্পর্কে হায়ারোগ্লিফিতে কিছু নথি ছিল। যা গ্রিক ভাষায় অনুবাদ করা হয়।
সোলোন সেখান থেকেই আটলান্টিস সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন। অন্য সূত্র থেকে জানা যায়, তিনি একজন প্রাচীন মিশরীয় পুরোহিতের কাছ থেকে আটলান্টিস সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন। পুরোহিত এই কাহিনী নিজের কাছে লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন। যা পরবর্তীতে প্লেটো পায়।
ধারণা করা হয়, প্লেটো এই নথিগুলোর উপর ভিত্তি করেই আটলান্টিস সম্পর্কে বর্ণনা করেছিলেন। বর্তমান সময়ের প্রচলিত কিংবদন্তী অনুযায়ী আটলান্টিসকে একটি শান্তিপূর্ণ স্থান মনে হতে পারে। তবে প্লেটোর বর্ণনা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
পুরাতত্ত্বের অধ্যাপক কেন ফেডার তার ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব ডিউবিয়াস আর্কিওলজি’ গ্রন্থে লিখেছেন, প্লেটোর বর্ণনা অনুযায়ী আটলান্টিস মোটেও শান্তির কোনো স্থান ছিল না। তারা সম্পদশালী, প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত এবং সামরিক শক্তির ফলে আগ্রাসী হয়ে উঠেছিল।
মার্ক অ্যাডামস তার ‘মিট মি ইন আটলান্টিস: অ্যাক্রস থ্রি কন্টিনেন্টস ইন সার্চ অব দ্য লেজেন্ডারি লস্ট সিটি’ গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে এই গ্রিক কিংবদন্তী এতো বেশি পরিচিত হয়েছিল। তিনি মনে করেন, আমেরিকান একজন সাবেক কংগ্রেস সদস্য এবং ইতিহাস বিষয়ক লেখক ইগনাটিউস ডোনেলি (১৮৩১-১৯০১) এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছেন।
ডোনেলি তার ১৮৮২ সালে প্রকাশিত ‘দ্য অ্যান্টিডিলিউভিয়ান ওয়ার্ল্ড’ গ্রন্থে দাবি করেছিলেন, প্লেটোর উল্লিখিত হারিয়ে যাওয়া দ্বীপ আটলান্টিসে সভ্যতা এবং প্রযুক্তির অগ্রগতি হয়েছিল। ডোনেলি মূলত প্লেটোর বর্ণনা, পৌরাণিক কাহিনী এবং নিজের ধারণা যুক্ত করে কাহিনীটা অরো জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন।
পরবর্তীতে এ নিয়ে আরো অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। আবার কেউ কেউ আবিষ্কার হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণীও করেছিলেন তবে তা হয়নি এখনো। আটলান্টিসের অস্তিত্ব অনেকেই কল্পকাহিনী হিসেবে উড়িয়ে দিলেও শত শত বছর ধরে বহু মানুষের বিশ্বাস পৌরাণিক কাহিনীর অবশ্যই বাস্তবতা ছিল।
এই যুক্তির উপর ভিত্তি করে অসংখ্য বিশেষজ্ঞ হারিয়ে যাওয়া দ্বীপটির সন্ধান করেছেন বিশ্বজুড়ে। বিশ্বাস কিংবা ধারণা অনুযায়ী অনেকেই বিভিন্ন অবস্থানের নাম বলেছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আটলান্টিক মহাসাগর, এন্টার্কটিকা, বলিভিয়া, তুরস্ক, জার্মানি, মাল্টা এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চল।
প্লেটোর বর্ণনা অনুযায়ী, আটলান্টিক মহাসাগরই এর অবস্থান নির্দেশ করে। তবে উন্নত সমুদ্রবিদ্যার মাধ্যমেও প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের বর্ণিত আটলান্টিস শহরের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই শহরের অস্তিত্ব কল্পকাহিনী হিসেবে উড়িয়ে দিলেও অনেকেই বিশ্বাস করেন। হয়তো একদিন সমুদ্র তলে হারিয়ে যাওয়া আটলান্টিসের সন্ধান মিলবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯২০
আপনার মতামত জানানঃ