তালিবান ক্ষমতা দখলের পর আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এছাড়া নারী ও মেয়েদের অনেক অধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছে।
তালিবান বলেছিল এবার তারা আগের চেয়ে একটু বেশি সহনীয় হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে নারীদের অনেক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। তারা মাধ্যমিক স্কুলে যেতে পারছে না, একা চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। প্রকাশ্যে পা থেকে মুখ পর্যন্ত ঢাকা পোশাক পরতে বলা হয়েছে। এসব নির্দেশ মানা হচ্ছে কিনা তা দেখতে চেকপয়েন্ট বসানো হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি নারী সাংবাদিক ও উপস্থাপকদের মুখ ঢেকে টিভিতে উপস্থিত হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
কাবুলের মতো আফগানিস্তানের অধিকতর উদার এলাকার কিছু নারীকে নতুন নিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে। বিক্ষোভে অংশ নেয়া একজন বলেন, ‘আমরা জীবিত প্রাণী হিসেবে পরিচিত হতে চাই, মানুষ হিসেবে পরিচিত হতে চাই, ঘরের কোণে বন্দি দাস হিসেবে পরিচিত হতে চাই না’।
আফগানিস্তানের টেলিভিশনে একটি পরিচিত মুখ মাহিরা। প্রতি রাতে তার উপস্থাপনা করা সংবাদ দেখতে অনেকেই টিভি চালু করেন। দেশটির সাম্প্রতিক উত্তাল ঘটনার সময়ও ২৭ বছর বয়সী এই নারী সংবাদ উপস্থাপনা করেছেন। কিন্তু সম্প্রতি তালিবান মুখ ঢেকে সংবাদ প্রকাশের নির্দেশ জারি করায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন তিনি। গতকাল মঙ্গলবার আল–জাজিরাকে তিনি বলেছেন, তালিবানের এই নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহত থাকবে।
তালিবানের নির্দেশে গত শনিবার মাহিরা মুখ কালো পর্দায় ঢেকে সংবাদ পাঠ করেন। ওই ঘটনা সারা বিশ্বে আলোচনার জন্ম দেয়। আল জাজিরাকে মাহিরা বলেন, ‘গত শনিবার ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন দিন। আমার তখন মনে হয়, আমাকে যেন জীবন্ত দাফন করা হয়েছে। আমার মনে হয়েছে আমরা যেন মানুষই না। আমার মনে হয়েছে, আমি আফগানিস্তানে নারী হিসেবে জন্মে বড় ধরনের কোনো অপরাধ করে ফেলেছি।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে মাহিরা আরও বলেন, ‘বিশ্বের কোনো দেশের আইন টিভিতে নারীকে মুখ ঢাকার প্রয়োজনীয়তার কথা বলে? ইসলামিক দেশগুলোতেও নারী সংবাদ উপস্থাপককে মাস্ক পরতে হয় না।’
মাহিরা বলেন, ‘ওই আদেশ খুবই হৃদয়বিদারক।’ নারীদের খারাপ পরিস্থিতির ওপর প্রতিবেদন প্রকাশ অব্যাহত রাখার কথা জানিয়ে ওই নারী সাংবাদিক বলেন, ‘এটাই প্রতিবাদ। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত আমি প্রতিবাদ চালিয়ে যাব।’
আমার তখন মনে হয়, আমাকে যেন জীবন্ত দাফন করা হয়েছে। আমার মনে হয়েছে আমরা যেন মানুষই না। আমার মনে হয়েছে, আমি আফগানিস্তানে নারী হিসেবে জন্মে বড় ধরনের কোনো অপরাধ করে ফেলেছি।’
মাহিরার মতোই ক্ষোভ প্রকাশ করেন ২৩ বছর বয়সী নারী উপস্থাপক সুজান। ২০১৯ সাল থেকে গণমাধ্যমে কাজ করা সুজান বলেন, ‘আমরা অনেক কিছু অর্জন করেছিলাম। প্রতিটি খাতে ক্রমবর্ধমান নারী উপস্থিতিসহ মুক্ত গণমাধ্যম পেয়েছিলাম। কিন্তু দেখুন, এখন কোথায় আমরা। এমন একটি দেশে আমরা এখন রয়েছি যেখানে নারী হিসেবে আমি কী পরব, কোন বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন করব তা পছন্দ করার অধিকার নেই।’
সুজান জানান, তালিবান সরকার সাংবাদিকদের জন্য ১১টি নিয়ম জারি করেছে। এর মধ্যে রয়েছে কোনো প্রতিবেদন টিভিতে প্রচারের আগে তালিবানের অনুমতি নিতে হবে। তালিবানের পক্ষ থেকে সম্প্রতি জারি করা সিদ্ধান্তকে অনেকেই নারীর স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ এবং ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালিবানের দমনমূলক শাসনে ফিরে আসার ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন।
এদিকে আফগানিস্তানের টেলিভিশনের নারী উপস্থাপকদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করতে মুখে ঢেকেছেন পুরুষ উপস্থাপকেরা। #ফ্রিহারফেস প্রচারণার আওতায় তারা এ কাজ করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার দ্য গার্ডিয়ান এসব তথ্য জানিয়েছে।
একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের এক উপস্থাপক দ্য গার্ডিয়ানকে জানিয়েছেন, গত দুই দিন তিনি ও তার অন্য পুরুষ সহকর্মীরা মাস্ক পরে কাজ করছেন।
তিনি বলেন, ‘মাস্ক পরে কাজ করা বিরক্তিকর। আমি যখন মাস্ক পরে কাজ করি, তখন মনে হয় কেউ যেন আমার গলা চেপে ধরেছে এবং আমি কথা বলতে পারছি না।
লিমা স্পেসালির বয়স ২৭। দেশটির ওয়ানটিভির একজন সংবাদ উপস্থাপক। তিনি গার্ডিয়ানকে বলেছেন, ‘গত রোববার সকালে অফিসে তালিবানের সর্বশেষ ডিক্রির জারি খবর আমাকে দেওয়া হয়েছিল। দুজন তালিবান সদস্য আমাদের অফিসে এসে বললেন, নারী সঞ্চালক ও উপস্থাপকদের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে মুখ ঢেকে রাখার সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে হবে।
এরপর আমরা অফিস মিটিং করেছি। তালিবানের আদেশ মেনে নিতে হয়েছিল। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে পুরুষ সহকর্মীদেরও মুখোশ পরতে হবে এবং নারী সহকর্মীদের পাশে দাঁড়াতে হবে।’
লিমা স্পেসালি বলেন, ‘নয় মাসের তালিবান শাসনের সময় উপস্থাপককে পছন্দের রঙিন পোশাকগুলো পরতে বাধা দেওয়া হয়েছে। আমি হতাশ ও হতবাক। আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না। আমি অক্সিজেন পেতে পারি না। এর মধ্য আমাদের সঠিকভাবে শব্দ উচ্চারণ করতে হবে। মাস্ক পরে খবর পড়া খুব কঠিন।’
নারীদের জন্য পৃথিবীতে নরক হয়ে উঠেছে আফগানিস্তান। হত্যা, নির্যাতন, বাল্যবিবাহ, ধর্ষণ, চাকরির সুযোগ হারানোর পর এবার বিক্রি করা হচ্ছে দাস হিসেবে। ১৯৯৬ সাল থেকেই আফগানিস্তানের নারীদের পথচলা অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বেশি বন্ধুর। এক পা এগোলে দশ পা পিছিয়ে যেতে হয় তাদের। দেশের শাসনব্যবস্থা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় আফগান নারীর জীবনযাত্রা। চলার পথের প্রতিবন্ধকতাও বেড়ে যায়।
গত আগস্টে কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়া তালিবান দাবি করেছিল, তারা পাল্টেছে অনেকটায়। নব্বইয়ের দশকের কট্টর অবস্থান থেকে বেশ উদার হবে এবার।
তবে গোটা আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ পোক্ত করার পর নারীদের নব্বইয়ের দশকের সেই শাসনের মতোই ঘরবন্দি করে ফেলেছে তারা।
তালিবানের সবশেষ শাসনামলে (১৯৯৬ থেকে ২০০১) নারীরা কাজ করতে পারত না। মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। নারীরা বাড়ির বাইরে বের হলে চেহারা ঢেকে ও পুরুষ সঙ্গীকে নিয়ে বের হতে হতো।
যারা এই আইন অমান্য করতেন ইসলামি শরিয়া আইনের কট্টর ব্যাখ্যার অধীনে তাদের জনসমক্ষে পেটাত তালিবানের ধর্মীয় পুলিশ।
রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যর্থ আলোচনা চালানো তালিবান পশ্চিমাদের কথা দেয়, নারীরাও ‘ইসলামী আইন’ অনুযায়ী কাজ করা ও শিক্ষা গ্রহণের সমান অধিকার পাবেন।
২০ বছর পর গত ১৫ আগস্ট আফগানিস্তান দখলে নেয় তালিবান। এরপর সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে তালিবান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার ঘোষণা দেয়। অবশ্য সরকার গঠন করলেও বিশ্বের কোনো দেশই এখনও পর্যন্ত তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। এর জেরে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ও এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দাতা সংস্থাও আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তাসহ অর্থ সাহায্য পাঠানো বন্ধ করে দেয়।
অধিকাংশ দেশ তালিবান শাসনাধীন আফগানিস্তানকে স্বীকৃতি না দিলেও তারা বারবার মানবধিকার ও নারী অধিকারের বিষয়টি তুলেছে। তাদের অন্যতম দাবি ছিল, মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তালিবান সরকারের স্বীকৃতি এবং আফগানিস্তানকে ত্রাণসাহায্য দেওয়ার ক্ষেত্রেও নারী অধিকার ও শিক্ষার বিষয়টি তারা সামনে এনেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তালিবানের আফগান দখলের পর থেকেই দেশটিতে নারীদের অবস্থান নিয়ে নানা ধরনের শঙ্কা ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে। অত্যাচার নিপীড়নের পাশাপাশি বাড়ি থেকে কম বয়সী নারীদের জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া এমনকি মৃতদের ধর্ষণের অভিযোগও উঠেছে তালিবানের বিরুদ্ধে। আফগানিস্তানে নারী শিক্ষার অগ্রযাত্রা থমকে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বলে অনেকের ধারণা। কর্মজীবী নারীদের উপর নেমে আসছে নিয়মের খড়গ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০৫
আপনার মতামত জানানঃ