ইউরোপ বা আমেরিকার কোনো দেশ নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইয়েমেনের শিবাম শহরে গড়ে উঠেছিল বিশ্বের প্রাচীনতম আকাশচুম্বী অট্টালিকার শহর। শিবামের দালানগুলো তৈরির ক্ষেত্রে কোনো পাথর বা পোড়া ইট ব্যবহার করা হয়নি। কাদামাটির তৈরি ইট মরুভূমির তপ্ত রোদে শুকিয়ে কাঠের গুঁড়ার মিশ্রণ দিয়ে পরপর সাজিয়ে গড়ে তোলা হয় এই বহুতল অট্টালিকাগুলো। মাটির তৈরি সুউচ্চ ভবনগুলোর উচ্চতাও কিন্তু কম নয়। এগুলোর একেকটির উচ্চতা বর্তমান সময়ের একটি ১১ তলা উঁচু ফ্ল্যাট বাড়ির সমান। যা সত্যিই অবাক করার মতো বিষয়।
আমেরিকার ম্যানহ্যাটান শহর গগনচুম্বী অট্টালিকার জন্য সুপরিচিত। সেই হিসেবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাজানো গোছানো অসংখ্য অট্টালিকার কারণে শিবাম হাদরামাউত শহরকে ‘মরুভূমির ম্যানহ্যাটান’ বলা হয়। ঐতিহাসিকদের তথ্যমতে, এই শহরের গোড়াপত্তন হয় প্রায় ৩০০ সালের দিকে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এই অট্টালিকাগুলো কিন্তু কারো শখ বা বিলাসিতার মানসিকতা থেকে গড়ে ওঠেনি।
মরুভূমির বেদুঈন ডাকাতের হাত থেকে বাঁচতেই একদল মানুষ এই বহুতল অট্টালিকাগুলো বানিয়েছিল। এই বাড়িগুলোর প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় কোনো মানুষ বসবাস করতো না। সেখানে মূলত গবাদিপশু ও বিভিন্ন জিনিসপত্র মজুদ করে রাখা হতো। বেদুঈন ডাকাতের হাত থেকে বাঁচতে তিন তলা থেকে উপরের তলাগুলোতে বসবাস করতো মানুষজন। এ কারণে এক তলা ও দোতলায় কোনো জানালাও থাকতো না। তিন তলা থেকে যেহেতু মানুষজন বসবাস করতো, তাই উপরের সব ফ্ল্যাটে জানালা ছিল। তবে গবাদিপশুর শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়ার ব্যবস্থা ছিল।
এছাড়াও এক বিল্ডিং থেকে অন্য বিল্ডিং এ যাতায়াতের অভিনব ব্যবস্থাই প্রমাণ করে তারা কতটা আধুনিক ছিল। অট্টালিকাগুলোর গঠন প্রণালী, কারুকার্য আর সৌন্দর্য এক কথায় অসাধারণ। মাটির তৈরি এই অট্টালিকাগুলোর আভিজাত্য যেন হার মানিয়ে দেয় আমাদের কংক্রিটের তৈরি পাকা বাড়িকেও। বাড়িগুলোর অভ্যন্তরীণ পরিবেশের সঙ্গে আজকের দিনের কংক্রিটের তৈরি বাড়ির মধ্যে পার্থক্য করা বেশ মুশকিল।
প্রাচীন বিল্ডিং এ বর্তমান সময়ের টেকনোলোজিও ব্যবহার হচ্ছে আজকাল। মজার কথা হচ্ছে সেসময় প্রতিটি অট্টালিকার ছাদে গরম পানি ও পাথর মজুত করে রাখা হতো সবসময়। আর যখনি ডাকাতরা আক্রমণ করতো, ছাদ থেকে তখন সেগুলো তাদের দিকে নিক্ষেপ করতো ভবনের বাসিন্দারা।
শিবাম শহর তার স্বতন্ত্র স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যের জন্য ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের খ্যাতি অর্জন করেছে। ১৯৮২ সালে ইউনেস্কো প্রথম শিবামের এই প্রাচীন অট্টালিকাগুলোকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেয়। ছোট্ট এই শহরটিতে প্রায় ৫০০ এর বেশি অট্টালিকা রয়েছে। যেখানে সাত থেকে আট হাজার মানুষ বসবাস করছে। তবে শিবামের অধিবাসীরা এখন আর খুব একটা ভালো নেই।
যুদ্ধবিদ্ধস্ত ইয়েমেন যেমন ধ্বংসলীলায় পরিণত হয়েছে, তেমনি এর প্রভাব পড়েছে শিবাম শহরেও। হুথি বনাম সৌদিজোট বাহিনীর রোষানলে অনেক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। ২০০৯ সালে আল-কায়েদার বোমা বিস্ফোরণের ফলে এখানকার অনেকগুলো বাড়ি সম্পূর্ণ ধুলোয় মিশে যায়। এছাড়াও অতিবৃষ্টি আর বন্যার কারণেও শিবামের ভবনগুলো ভেঙে পড়েছে অনেকবার। তাই অট্টালিকাগুলো পুনঃনির্মাণ এবং মেরামত করা হয়েছে একাধিকবার।
শিবামের অট্টালিকাগুলো অতীতে মুসলিম সম্প্রদায়ের শক্তিশালী অবস্থান ও গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতির উত্থানের প্রতীক। ৯০৪ সালের দিকে শিবামে আল-মিহদার নামে একটি মসজিদ নির্মিত হয়। আল-মিহদার মসজিদের উচ্চতা প্রায় ১৭৫ ফুট, যা এখনো পর্যন্ত অক্ষত রয়েছে। ইয়েমেনের এই প্রাচীন অট্টালিকার শহর থেকেই বর্তমান সময়ের আধুনিক আকাশচুম্বী ভবনগুলোর জন্ম। অনেকেই আধুনিকতা মানে শুধু আমেরিকা বা ইউরোপকেই বুঝে থাকেন। ইয়েমেনের শিবাম শহরের ইতিহাস নিশ্চয়ই তাদের ভুল ভাঙ্গিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯০৫
আপনার মতামত জানানঃ