ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের জেনিন শহর। বুধবার সকালের শান্ত পরিবেশ হঠাৎই রূপ নেয় আতঙ্কে। স্নাইপারের গুলিতে নিহত হন আল-জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ। ঘটনার ভয়াবহতায় হতবিহবল হয়ে পড়েন তার সঙ্গী। ভিডিওতে দেখা যায়, উপুড় হয়ে পড়ে থাকা শিরিনের মরদেহের সামনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন তিনি। সাহায্যের জন্য আশপাশে তাকাতে থাকেন।
ফিলিস্তিন তো বটেই ওই এলাকার খোঁজ-খবর রাখেন বিশ্বজুড়ে এমন অনেকেরই পরিচিত অনুসন্ধানী সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ। ওই দিন অফিসের অ্যাসাইনমেন্টে জেনিনে গিয়েছিলেন তিনি। গায়ে ছিল প্রেস লেখা জ্যাকেট, মাথায় হেলমেট। কিন্তু কানের পাশে যে অরক্ষিত জায়গা ছিল, সেখানেই গুলি করে হত্যা করা হয়। যাকে ইসরায়েলের টার্গেট কিলিং বলে মনে করা হচ্ছে।
আল-জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহর হত্যা নিয়ে একটি গল্প তৈরি করেছে ইসরায়েলি গণমাধ্যম। তারা বলছে, ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসীদের হামলার পর আত্মরক্ষায় গুলি চালায় তাদের বাহিনী। দুপক্ষের গোলাগুলিতে মৃত্যু হয়েছে শিরিনের। এ বিষয়ক একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে তারা।
তবে, ওই ভিডিও’র জায়গা আর শিরিন হত্যার ঘটনাস্থল এক নয়। এছাড়া, শিরিনকে হত্যার আগে ও পরে কোনো ধরনের গোলাগুলির কোনো তথ্য-ফুটেজ নেই। তারপরও, এই নিজেদের মিথ্যাচারকে সত্য বানাতে তদন্তের ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল। যাতে ফিলিস্তিনের শামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
কিন্তু ফিলিস্তিনিরা বলছেন, হত্যাকারী নিজেই যদি তদন্তকারী হয়, তার নেতৃত্বে তদন্ত মানে তো একটি উপহাস। এই উপহাসে শামিল হয়েছে আন্তর্জাতিক মহলও। জাতিসংঘসহ বিশ্ব সংস্থাগুলো তদন্তের কথা বলছে। কিন্তু পরিষ্কার তথ্য-প্রমাণ থাকলেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করার সাহস পাচ্ছে না।
নিহত ব্যক্তি মার্কিন নাগরিক ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কর্মী হওয়ায়, যা একটু আলোচনা চলছে। নইলে, এ সবও নসিবে জোটে না হত্যার শিকার ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের।
কিন্তু তাকে হত্যায় কেন এত বেপরোয়া হয়েছিল ইসরায়েল? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য বর্তমানে জেনিনে চলা ইসরায়েলি বর্বরতার খবর জানা দরকার।
ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের সংগঠন বলছে,ইসরায়েলি হামলায় গত দুই দশকে ৪৭ জন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক মারা গেছেন। আর নিউ ইয়র্কভিত্তিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট ১৭ জন সাংবাদিকের মৃত্যুর কথা বলছে গত তিন দশকে। এর মধ্যে ১৫ জন সরাসরি ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংগঠনটি।
সংবাদ সংগ্রহ করতে দিয়ে পশ্চিমতীরে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে মারা গেছেন আল জাজিরার ফিলিস্তিনি সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ। রাম্মালায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে সমাহিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
তবে শিরিন আবু আকলেহ ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে মারা যাওয়া একমাত্র সাংবাদিক নন। আনাদুলু এজেন্সির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের সংগঠন জানিয়েছে, ২০০০ সাল আল-আকসা ইন্তিফাদা শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েল ৪৬ জন ফিলিস্তিনি সাংবাদিককে হত্যা করেছে।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের দায়মুক্তি অবসানের আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে গাজা উপত্যকায় জাতিসংঘের আঞ্চলিক সদর দপ্তরের বাইরে আয়োজিত এক সমাবেশে সাংবাদিকদের সংগঠনের পক্ষ থেকে এমনটা জানানো হয়।
সংগঠনের উপপ্রধান তাহসিন আল-আস্তাল সাংবাদিকদের সুরক্ষা এবং ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি অপরাধের বিচার করার জন্য জাতিসংঘকে তার দায়িত্ব গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি দাবি করেন, ইসরায়েল সাংবাদিক হত্যার কারণ তাদেরকে নিশ্চুপ করা এবং বাস্তব সংবাদের চিত্র বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিতে বাঁধা প্রদান করা।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু বানানোর দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। নিউ ইয়র্ক-ভিত্তিক কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট ১৯৯২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েল ও অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভুখন্ডে ১৭ জন সাংবাদিক নিহত হওয়ার নিশ্চিত ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। এর মধ্যে ১৫ জন সাংবাদিক সরাসরি ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে নিহত হন।
২০১৯ সালে হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল কমিশনের রিপোর্ট বলছে, সাংবাদিকদের পরিকল্পিতভাবে গুলি করে ইসরায়েলি স্নাইপাররা। কারণ এ সব সাংবাদিকদের শরীরে থাকা জ্যাকেটে পরিষ্কার করে প্রেস শব্দ লেখা ছিল। তবে এই প্রতিবেদনকে পক্ষপাতদুষ্ট ও বিকৃত দাবি করে নাকচ করে দিয়েছে ইসরায়েল।
রিপোর্টার্স উইথাউট বর্ডার্স বলছে, শুধু টার্গেট কিলিংই নয়, ২০১৮ সালের গ্রেট মার্চ অব রিটার্ন প্রটেস্টসের পর থেকে ইসরায়েলি রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস ও গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন ১৪৪ সাংবাদিক। গেল বছর পূর্ব জেরুজালেমের শেখ জাররাহতে ইসরায়েলের অবৈধ বসতি ও আরব-ইসরায়েলিদের ঘর দখল ইস্যুতে প্রতিবাদের খবর সংগ্রহের সময় আল-জাজিরার সাংবাদিক গিভারা বুদেরিকে টেনে-হিচড়ে পুলিশ ভ্যানে তুলে নেয় ইসরায়েলি বাহিনী। বিশ্বজুড়ে সমালোচনার পর তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় দেশটি।
এসডব্লিউ/এসএস/১০০৫
আপনার মতামত জানানঃ