সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছর ১ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে রেলওয়ে। গত পাঁচ বছরে লোকসানের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। ধারাবাহিক এ লোকসানের জন্য রেলের অনিয়ম-দুর্নীতিকে দায়ী করেছে খোদ রেলপথ মন্ত্রণালয়।
প্রসঙ্গত, যাত্রী ও পণ্যবাহী মিলিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রতিদিন ৩৯৪টি ট্রেন পরিচালনা করে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করে যা আয় হয়, তার চেয়ে বেশি অর্থ ট্রেনগুলো পরিচালনায় ব্যয় হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটির।
রেলের দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধ করা না হলে, রেলের সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে এবং যাত্রীসেবার মান না বাড়ানো হলে লোকসান কমানো কষ্টকর হবে। সম্প্রতি রেল পরিষেবার মানোন্নয়ন ও রাজস্ব আয় বৃদ্ধি সম্পর্কিত এক আলোচনা সভায় এ পর্যবেক্ষণ দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, রেলে অনিয়ম বেশি হয় এমন খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যাত্রীবাহী ট্রেন পরিচালনা। টিকিট কালোবাজারি কিংবা টিকিটের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের ঘটনা নিয়মিতভাবেই ঘটছে। এসব কাজে রেলওয়েরই কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। একইভাবে টিকিট পরিদর্শকসহ রেলওয়ের রানিং স্টাফদের বিরুদ্ধে বিনা টিকিটের যাত্রীদের কাছ থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে টাকা আদায়ের অভিযোগও পুরনো।
যাত্রীবাহী ট্রেন পরিচালনায় বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি ছাড়াও বাংলাদেশ রেলওয়ের অনিয়ম-দুর্নীতির একাধিক খাত চিহ্নিত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। খাতগুলো হলো সম্পত্তি ইজারা ও হস্তান্তর, অবৈধ স্থাপনা তৈরি, কেনাকাটা, ভূমি অধিগ্রহণ, যন্ত্রাংশ নিলাম, টিকিট বিক্রি, ট্রেন ইজারা, ক্যাটারিং ইত্যাদি।
বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, দুর্নীতি বন্ধ করা গেলে ট্রেন পরিচালনার ব্যয় ও আয়ের মধ্যে ব্যবধান অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হতো। পাশাপাশি বিদ্যমান সম্পদগুলো সুষ্ঠু ব্যবহার করে রেলকে সহজেই লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা যেত। কিন্তু এসব শুধু আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। বাস্তবে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না।
ট্রেন পরিচালনায় মোটা দাগে ছয়টি খাতে টাকা খরচ হয় রেলওয়ের। এ খরচকে বলা হয় পরিচালন ব্যয়। খরচের খাতগুলো হলো প্রশাসনিক, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, স্টাফদের বেতন-ভাতা, জ্বালানি তেল ও স্টাফ বাদে অন্যান্য পরিচালন ব্যয় এবং বিবিধ খাত।
রেলপথ মন্ত্রণালয় বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রেনগুলো পরিচালনা করতে ২ হাজার ৮১২ কোটি টাকা ব্যয় করেছে রেলওয়ে। বিপরীতে যাত্রীবাহী ট্রেনের টিকিট বিক্রি ও পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে সংস্থাটি আয় করতে পেরেছে ১ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা। লোকসান ১ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা। তবে করোনা মহামারীর কারণে অর্থবছরের একটা বড় সময় দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। এ কারণে লোকসান তুলনামূলক কম হয়েছে।
পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ে সবচেয়ে বেশি লোকসান করেছে ২০১৯-২০ অর্থবছর। লোকসানের পরিমাণ ২ হাজার ৮৭ কোটি টাকা। ওই অর্থবছর রেলওয়ে সব মিলিয়ে ৬৩৭ কোটি যাত্রী পরিবহন করে। একইভাবে ৩১ লাখ ৭৭ হাজার টন পণ্য পরিবহন করে। যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রেন পরিচালনায় খরচ হয় ৩ হাজার ২৪১ কোটি টাকা। বিপরীতে সংস্থাটি আয় করে ১ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা লোকসান করেছে সংস্থাটি। লোকসান কাটিয়ে লাভে ফিরতে বাংলাদেশ রেলওয়েকে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এগুলো হলো যাত্রীসেবা, অনবোর্ড সেবা, ক্যাটারিং সেবার মান বৃদ্ধিসহ যাত্রীদের টিকিটপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা, পণ্যবাহী ও কনটেইনার ট্রেন পরিচালনায় গুরুত্ব দেয়া, কমিউটার ট্রেনকে আরো জনবান্ধব করে তোলা এবং বেদখলে থাকা জমি উদ্ধার করে সেগুলোর বাণিজ্যিক ব্যবহার করা।
উন্নত প্রযুক্তি আর অবকাঠামো, দ্রুতগতির ট্রেন, কঠোর সময়ানুবর্তিতার মতো বিষয়গুলোয় জোর দিয়ে উন্নত দেশগুলো যেখানে তাদের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার খোলনলচে বদলে দিচ্ছে, সেখানে এখনো পুরনো অবকাঠামোগুলোই ঠিকমতো ধরে রাখতে পারছে না বাংলাদেশ রেলওয়ে। সংস্কারের অভাবে দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে রেলপথ। জনবলের অভাবে বন্ধ থাকছে স্টেশন। যথাযথ পরিকল্পনা ছাড়াই নতুন নতুন ট্রেন নামিয়ে বাড়ানো হচ্ছে শিডিউল বিপর্যয়। রেলপথ, রোলিংস্টক, সিগন্যাল ব্যবস্থা, জনবল, ট্রেন পরিচালন ব্যবস্থা, যাত্রীসেবায় বছরের পর বছর ধরে কেবল লোকসানই গুনে যাচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
তবে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন মনে করছেন, বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়েতে যেভাবে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে আরো উন্নত হবে অবকাঠামো। সেই সঙ্গে লাভজনক হয়ে উঠবে সংস্থাটি। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, রেলকে আধুনিকায়নের লক্ষে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কাজ করে যাচ্ছে। নতুন নতুন রেলপথ, রেলসেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। বন্ধ থাকা স্টেশন চালু করা হচ্ছে। নতুন কোচ-ইঞ্জিন কেনা হচ্ছে। সিগন্যালিং ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো হচ্ছে। জনবল বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিদ্যুচ্চালিত, হাইস্পিড ট্রেন চালুর জন্য আমরা কাজ করছি।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় রেলপথ নির্মাণ, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণে যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, বাংলাদেশ রেলওয়েতেও সেগুলোর ব্যবহার শুরুর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ রেলওয়ের অবকাঠামোর মান আরো উন্নতি হবে এবং রেল লাভজনক অবস্থায় চলে আসবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫০৫
আপনার মতামত জানানঃ