সাম্প্রতিক সময়ে বিক্ষোভে উত্তাল শ্রীলঙ্কা। লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগ দাবি করছেন।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে ও প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে আসছেন আন্দোলনকারীরা।
গত মাসের শুরু থেকে চলছে এ আন্দোলন। দ্বীপরাষ্ট্রটির ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের জন্য সরকারকে দায়ী করে গোটা দেশেই চলছে এ আন্দোলন। দেশটির সরকারকে হটাতে এবার আন্দোলন শুরু হলো অনলাইনেও। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার হস্তক্ষেপ চেয়ে অনলাইনে আবেদন করা হচ্ছে দেশটির নাগরিকদের পক্ষ থেকে।
শ্রীলঙ্কার সংবাদমাধ্যম দ্য আইল্যান্ড–এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংক বরাবর পাঠানো হয়েছে একটি আবেদন। সেভ শ্রীলঙ্কা নামের ওই অনলাইন আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাজে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা শ্রীলঙ্কাকে দুর্দশার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ ছাড়া খারাপ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যাপক দুর্নীতির কথাও উল্লেখ রয়েছে এ আবেদনে।
ওই অনলাইন আবেদনে শ্রীলঙ্কার দুরবস্থার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শ্রীলঙ্কা ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে দেশটিকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। এই সংকট মোকাবিলায় দেশটির সরকার বর্তমানে বৈদেশিক ঋণ পুনর্গঠন ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছ থেকে অতিরিক্ত ঋণ পাওয়ার আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
ওই পিটিশনে আরও বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতি যদি এভাবে চলতেই থাকে, তাহলে নতুন করে বৈদেশিক বিনিয়োগ দেশটির অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে স্থিতিশীল করতে অবদান রাখতে পারবে না।
আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ছাড়াও অনলাইন আবেদনে শ্রীলঙ্কা সরকারের কাছে সংকট কাটাতে আবেদনে স্বাক্ষরকারীরা অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসকদের দায়িত্ব দিয়ে বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে ও তার বড় ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবি জানানো হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসকদের আশু করণীয় সম্পর্কেও বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয় আবেদনে। এর মধ্যে অন্যতম শ্রীলঙ্কার সংবিধানের ২০তম সংশোধনী বাতিল করা।
এদিকে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট আরও দুই বছর স্থায়ী হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন শ্রীলঙ্কার অর্থমন্ত্রী আলি সাবরি। গত বুধবার পার্লামেন্টে আলি সাবরি বলেন, ‘মানুষের সত্যিটা জানা উচিত। আমি জানি না মানুষ পরিস্থিতির গভীরতা সম্পর্কে বুঝতে পারছে কি না।’
অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতি যদি এভাবে চলতেই থাকে, তাহলে নতুন করে বৈদেশিক বিনিয়োগ দেশটির অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে স্থিতিশীল করতে অবদান রাখতে পারবে না।
শ্রীলঙ্কায় সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালে। নির্বাচনকে সামনে রেখে শুল্ক কমানোর প্রস্তাব করেন গোতাবায়া রাজাপাকসে। এটাকে তখনকার সরকার নির্বাচনী কৌশল হিসেবেই ধরে নিয়েছিল।
সে সময়ে অর্থমন্ত্রী মঙ্গলা সামারাবিরা মূল্য সংযোজন কর ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশ করা ও অন্যান্য শুল্ক বাতিল করার বিপজ্জনক প্রতিশ্রুতির বিষয়ে একটি ব্রিফিংয়ের আয়োজন করেছিলেন।
তখন তিনি বলেন, রাজাপাকসের এ প্রস্তাব যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে সারাদেশে মারাত্মক সংকট তৈরি হবে। দেশে ভেনেজুয়েলা ও গ্রিসের মতো সংকট হতে পারে বলেও পূর্বাভাস দেন তিনি।
তার ওই পূর্বাভাস সত্য হতে মাত্র ৩০ মাস সময় লেগেছে। এরই মধ্যে যুদ্ধ, নানা রকম রোগ এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে জর্জরিত হয়ে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। একই সঙ্গে চরম বেকায়দায় পড়েছেন শ্রীলঙ্কার পপুলিস্ট নেতা এবং দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে।
২০১৯ সালের নির্বাচনে জয়ের পরে রাজাপাকসে এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী রাজবংশকে পুনরুজ্জীবিত করেন। এসময় তিনি মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে শুল্ক আইন পাস করেন এবং প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা পুনর্বহাল করেন। তাছাড়া পরিবারের সদস্যদের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেন। জাতীয়তাবাদী মনোভাব কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
তবে খুব দ্রুতই তার কৌশলগুলো ব্যর্থ হতে থাকে। সম্প্রতি জ্বালানি তেল, প্রয়োজনীয় খাদ্য ও ওষুধ আমদানি করার মতো অর্থও শেষ হয়ে যায় দেশটিতে। তীব্র লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবিতে তার বাড়ির সামনে বিক্ষোভ ক্যাম্প স্থাপন করেছে দ্বীপ রাষ্ট্রের জনগণ।
অর্থনৈতিক সংকটে এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রাজাপাকসের পরিবার। হিমশিম খাচ্ছেন মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদা মেটাতে। ঋণের জন্য শরণাপন্ন হচ্ছেন আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, চীন ও ভারতসহ অন্যান্য দাতাদের কাছে। এরই মধ্যে ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে দেশটি। যা ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম ঘটনা। দেশের শেয়ারবাজারও শোচনীয় অবস্থায় রয়েছে।
গত ২০ বছরের মধ্যে ১২ বছরই শ্রীলঙ্কার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেছেন রাজাপাকসে পরিবারের সদস্যরা। এসময় তারা স্বৈরতন্ত্রের তকমা পেয়েছেন। এর আগে তার ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া তার অন্য দুই ভাই দেশটির বন্দর ও কৃষি ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছেন। এভাবে পাকসে পরিবারের কয়েক ডজন সদস্য সরকারের সর্বোচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
জানা গেছে, রাজাপাকসে ক্ষমতা গ্রহণের আগেও শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক সংকটে ছিল। তারপরও নতুন সরকার বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের জন্য চীনের কাছ থেকে ঋণ নেয়। সব মিলিয়ে ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দেশটির বৈদেশিক ঋণ দ্বিগুণ হয়ে যায়।
দেশটির অর্থনীতিতে প্রথম ধাক্কা আসে করোনা মহামারির পর। এসময় বিশ্বব্যাপী জারি হয় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা। বন্ধ হয়ে যায় এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত। এর সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে। কারণ দেশটির আয়ের সিংহভাগই আসে পর্যটনখাত থেকে। একই সঙ্গে কমে যায় রেমিট্যান্সের প্রবাহ। ফলে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমাণ ৭০ শতাংশ কমে যায়।
রাজাপাকসে সরকার ২০২১ সালে রাসায়নিক সার নিষিদ্ধ করে। তারপর দেশটির চাল উৎপাদন কমে যায়। যদিও পরবর্তী সময়ে সে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়। এসবের পাশাপাশি ছিল বিশাল অংকের বৈদেশিক ঋণের বোঝা।
এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে দেশটির বিশেষজ্ঞ ও বিরোধী নেতারা ঝুঁকি সত্ত্বেও সরকারকে আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়ার পরামর্শ দেয়। কিন্তু সে আহ্বানে সাড়া দেয়নি দেশটির সরকার। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর তেলের দাম লাফিয়ে বাড়তে থাকায় এপ্রিলে দাতা সংস্থাটির শরণাপন্ন হয় রাজাপাকসে প্রশাসন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১৯
আপনার মতামত জানানঃ