শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে ও প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে আসছেন আন্দোলনকারীরা।
এদিকে দেশের টালমাটাল অর্থনীতি ও তার ফলে সৃষ্ট জনরোষ সামাল দিতে অবশেষে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে তার বড়ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসেকে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণে রাজি হয়েছেন। পাশাপাশি, একজন নতুন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব সর্বদলীয় সরকার গঠনের পক্ষেও মত দিয়েছেন তিনি।
শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান জোট সরকারের অন্যতম শরিক দল ফ্রিডম পার্টির নেতা মাইথ্রিপালা সিরিসেনার বরাত দিয়ে শনিবার এ তথ্য জানিয়েছে দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলো। খবর আল-জাজিরার।
শুক্রবার(২৯ এপ্রিল) মাইথ্রিপালা সিরিসেনার বরাতে শ্রীলঙ্কার স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরে বলা হয়, গোতাবায়া রাজাপাকসে নতুন একজন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিয়ে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠনে সম্মত হয়েছেন।
গতকাল সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট কার্যালয় থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করতে প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সব রাজনৈতিক দল যদি যেসব প্রস্তাব সমর্থন করে, সেগুলোতে প্রেসিডেন্টও সম্মতি দেবেন বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকেও অবশ্য এ তথ্য জানা গেছে। দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ইতোমধ্যে পার্লামেন্টের বিরোধী দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে একটি সর্বদলীয় মন্ত্রিপরিষদ গঠন বিষয়ক খসড়া প্রস্তাব দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বিরোধী দলগুলো এই খসড়া পাঠালে তার ভিত্তিতে দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করবেন প্রেসিডেন্ট।
এদিকে নিজের মুখে পদত্যাগ করার বিষয়ে মাহিন্দা রাজাপাকসে বলেছেন, তার প্রধানমন্ত্রী থাকা না থাকার বিষয়ে প্রেসিডেন্ট যে সিদ্ধান্ত নেবেন তা তিনি মেনে নিতে প্রস্তুত।
শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে বলেন, যদি প্রেসিডেন্ট তাকে অপসারণ করে অন্য কোনো ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী করেন এতে তার আপত্তি নেই। এটি মেনে নিতে প্রস্তুত আছেন তিনি। প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা জানানো উচিত বলেও মন্তব্য করেন মাহিন্দা রাজাপাকসে।
বিদ্যুৎ বিভ্রাট, গ্যাস ও পানির তীব্র সংকট, খাদ্য সংকট, প্রয়োজনীয় পণ্যের আকাশচুম্বী দামসহ নানা সমস্যার বেড়াজালে আটকা পড়েছে শ্রীলঙ্কা। সম্প্রতি সাধারণ মানুষের তোপের মুখে একসঙ্গে পদত্যাগ করেন ২৬ মন্ত্রী। শুধু পদত্যাগ করেননি দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের বড় ভাই ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। পরে মন্ত্রী পরিষদ ভেঙে জাতীয় ঐক্য সরকারের ডাক দেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। এরপর ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসেকে প্রধানমন্ত্রী রেখেই নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন তিনি।
মাহিন্দা রাজাপাকসে বলেছেন, তার প্রধানমন্ত্রী থাকা না থাকার বিষয়ে প্রেসিডেন্ট যে সিদ্ধান্ত নেবেন তা তিনি মেনে নিতে প্রস্তুত।
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা। করোনা মহামারি, জাতীয় অর্থনীতি পরিচালনায় সরকারের অদক্ষতা, বিশ্বজুড়ে জ্বালানির মূল্য বেড়ে যাওয়া ও রাষ্ট্রীয় কোষাগারে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ তলানিতে নেমে যাওয়া এই সংকটের প্রধান কয়েকটি কারণ।
২০২২ সালে শ্রীলঙ্কাকে প্রায় ৬০০ কোটি ডলার বিদেশি ঋণ শোধ করতে হবে, অথচ দেশটির বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে মাত্র ১৫ কোটি ডলার, যা তাদের ইতিহাসে সর্বনিম্ন।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়ায় বাইরের দেশ থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করতে পারছে না শ্রীলঙ্কার সরকার। ফলে, ভয়াবহভাবে ব্যহত হচ্ছে দেশটির বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং গত বেশ কিছুদিন ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় থাকতে বাধ্য হচ্ছেন শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষ।
বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংকটের সঙ্গে যোগ হয়েছে দ্রব্যমূল্যর উর্ধ্বগতি। শ্রীলঙ্কার পরিসংখ্যান দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ মাসে দেশটিতে খাদ্যপণ্যের মূল্য বেড়েছে ৩০ শতাংশেরও বেশি।
এই পরিস্থিতিকে অর্থনৈতিক সংকটে অতিষ্ঠ শ্রীলঙ্কার সাধারণ জনগণ গত মার্চের মাঝামাঝি থেকে সরকার পতন আন্দোলন শুরু করেন। জনগণের ক্ষোভ প্রশমন করতে গত ৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী রাজাপাকসে ব্যতীত কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদের ২৬ সদস্যের সবাই একযোগে পদত্যাগ করেন।
তবে তারপরও থামছে না জনতার বিক্ষোভ। তাদের দাবি, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী— উভয়কেই পদত্যাগ করতে হবে।
এদিকে, নিত্যপ্রয়োজনীয় ও জরুরি পণ্য আমদানি করতে গত ২৭ এপ্রিল শ্রীলঙ্কাকে ৬০ কোটি ডলার আর্থিক সহায়তা দিতে রাজি হয়েছে বিশ্বব্যাংক। এই সহায়তার ৪০ কোটি ডলার দ্রুত ছাড় দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও শ্রীলঙ্কার সরকারকে দিয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম আর্থিক সহায়তা ও ঋণদানকারী সংস্থা।
এছাড়া চলতি মাসের শুরুতে আর্থিক সহায়তা পেতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে শ্রীলঙ্কা। তবে আইএমএফ জানিয়েছে, সহায়তা পেতে হলে প্রথমে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে হবে।
ভারত ইতোমধ্যে শ্রীলঙ্কাকে ১৯০ কোটি ডলার দিয়েছে। এর বাইরে জ্বালানিসহ নিত্যপণ্য আমদানির জন্য আরও ১৫০ কোটি ডলারের তহবিল পেতে দিল্লির সঙ্গে কথা বলছে কলম্বো।
পাশাপাশি চীনের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলারের একটি সিন্ডিকেটেড ঋণ পাওয়ার জন্যও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে দেশটির সরকার।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন ও প্রবাসী আয়ে ধাক্কা লাগলে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ধসে পড়ার বিষয়টি সামনে আসে। দেশটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির অর্থ জোগাতে ব্যর্থ হয়। এতে চাল, গুঁড়া দুধ, চিনি, ময়দা ও ওষুধের সরবরাহ কমে যায়। লাগামহীন মূল্যস্ফীতি দুর্ভোগ আরও বাড়ায়।
জ্বালানি–সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় দিনের অধিকাংশ সময় লোডশেডিং হচ্ছে। সময় ভাগ করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রতিদিন সকালে পেট্রল ও কেরোসিনের জন্য মানুষকে সার্ভিস স্টেশনে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অচলাবস্থার ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। এদিকে দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের বিরুদ্ধে অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি অভিযোগ এনে তার পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ চলছে দেশজুড়ে। বিক্ষোভে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
সরকার এ পরিস্থিতির জন্য করোনা মহামারিকে দায়ী করছে। সরকার বলছে মহামারির কারণে পর্যটন ব্যবসায় ধ্বস নেমেছে। তাছাড়া তিন বছর আগে দেশটিতে ভয়াবহ বোমা হামলার কারণেও পর্যটক কমে গেছে। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছে, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাই বর্তমান সঙ্কটের জন্য দায়ী।
এক দশক আগেও শ্রীলঙ্কা ছিল অন্য রকম; তামিল টাইগাররা পর্যুদস্ত, গৃহযুদ্ধের অবসানে দেশটি যেন উড়ছিল। পর্যটননির্ভর দ্বীপরাষ্ট্রটির অর্থনীতি ফুলে-ফেঁপে উঠছিল; আসছিল বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার; তা রোশনাই ছড়াচ্ছিল দোকানগুলোতে, আর সড়কে দেখা মিলছিল চকচকে সব গাড়ির।
আর দশককাল বাদে সেই শ্রীলঙ্কায় সড়কে এখন বাতি জ্বলছে না, গাড়ি চালাতে মিলছে না জ্বালানি তেল, কাগজের অভাবে পরীক্ষা নেওয়া যাচ্ছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী।
বিশাল অঙ্কের ঋণ, তার সঙ্গে মহামারীর খাঁড়ার পর ইউক্রেইন যুদ্ধ একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছে সোয়া ২ কোটি মানুষের দেশ শ্রীলঙ্কাকে। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এতটাই কমেছে যে তা দিয়ে এক মাসের আমদানি ব্যয়ও মেটানো যাবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৫৫
আপনার মতামত জানানঃ