পরিবেশ ও প্রকৃতি সবসময়ই পৃথিবীর মানুষের কাছে রহস্যময়তার সৃষ্টি করে। কখনো কখনো এমন অনেক ঘটনার প্রদর্শন করে যা হঠাৎ আমাদের চিন্তাভাবনাকে নতুন মাত্রা দেয় কিংবা এমন ঘটনার জন্ম দেয় যার ব্যাখ্যা করা হয়ে পড়ে দুষ্কর।
কারণ এসব ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়া যায় না বা গেলেও অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণের পরই সেটা সম্ভব হয়। আর যদি সেটা করা না যায় তবে তা ব্যাখ্যাতীত ঘটনার খেতাব পায় এবং রহস্যে আবৃতই থেকে যায়।
এমনই এক ঘটনা আকাশ থেকে ঝরে পড়া ‘রক্তবৃষ্টি’! তা-ও কি কখনো সম্ভব! তবে এই ঘটনা সত্যিই ঘটেছে ভারতে। তাও একাধিকবার।
২০০১ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণ ভারতের কেরালা প্রদেশে লাল বর্ণের বৃষ্টিপাত ঘটে থাকে। ভারী বর্ষণের এই সময়ে যে পানি পতিত হয়েছিলো তা বাইরে শুকাতে দেয়া কাপড়কে রক্তবর্ণে রঙিন করে ফেলে।
এই বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছিলো মূলত জুলাই মাসের ২৫ তারিখ থেকে। তবে এর আগেও ১৮৯৬ সালে এরকম বৃষ্টি হয়েছিলো বলে জানা যায়। সর্বশেষ রেকর্ড অনুযায়ী ২০১২ সালেও এরকম ঘটনা ঘটেছে।
তথ্য অনুযায়ী, ১৮৯০ সাল থেকেই কেরালা এবং শ্রীলঙ্কাতে বিক্ষিপ্তভাবে এই লাল বৃষ্টি দেখা গিয়েছিল।
কেরালার রক্তবৃষ্টি ঘটনার পর প্রাথমিকভাবে যে গবেষণা করা হয় তাতে বলা হয় যে খুব সম্ভবত কোনো উল্কাপিণ্ডের বিস্ফোরণের কারণে এবং সেসময় বৃষ্টিপাতের কারণে বৃষ্টির পানির বর্ণ লাল হয়েছিলো।
পরবর্তীতে ভারত সরকারের একটি সমীক্ষার পর জানা যায়, স্থানীয় শেওলা জাতীয় উদ্ভিদের বায়ুবাহিত কণা বৃষ্টির জলের সঙ্গে মিশে এই রঙ তৈরি হয়েছিল। তবে অনেকেই এই তত্ত্বে খুশি হননি।
কিছু মানুষ দৃঢ়বদ্ধ ছিলেন, রক্তবৃষ্টির কারণ একেবারেই অন্য। অনেকের মতে, পৃথিবীর মাটিতে ভিনগ্রহীদের অবতরণই না কি এই বৃষ্টিপাতের নেপথ্যে!
এই কথা অতিরঞ্জিত বা কল্পবিজ্ঞানের গল্প মনে হলেও এই ঘটনা বৈজ্ঞানিক মহলকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে বৃষ্টিপাত হওয়ার সময় তারা অদ্ভুত আওয়াজও শুনেছিলেন।
যারা এই বৃষ্টির পেছনে ভিনগ্রহীদের ‘হাত’ দেখেছিলেন, তাদের বক্তব্য ছিল এই ঘটনা ছিল ‘ঐশ্বরিক অভিশাপ’-এর নিদর্শন। আবার অনেকের মতে এই ঘটনা পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার সূত্রপাত।
তবে এই সব তত্ত্বের মধ্যে সব চেয়ে প্রশংসনীয় ছিল পদার্থবিদ গডফ্রে লুই-এর আনা তত্ত্ব।
২০০৮ সালের এপ্রিলে গডফ্রে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এই গবেষণাপত্রে তিনি উল্লেখ করেন যে, বায়ুমণ্ডলে ধূমকেতুর বিস্ফোরণের ফলে মহাকাশ থেকে অনেক জীবাণু কেরালাের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে। আর তার ফলেই এই রক্তবৃষ্টি।
এই গবেষণাপত্র সংবাদ মাধ্যমের বিশেষ নজর কেড়েছিল। তবে অনেক বিজ্ঞানীই গডফ্রের তত্ত্ব নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন।
এই লালবৃষ্টির জলে অনেক মৌলেরও সন্ধান মিলেছিল। পরীক্ষা করার পর অ্যালুমিনিয়াম, ক্যালসিয়াম, কার্বন, ক্লোরিন, লোহা, ম্যাগনেসিয়াম-সহ বহু মৌল এই বৃষ্টির জলে পাওয়া গিয়েছিল। এতেই আরো সন্দেহ জাগে বিজ্ঞানীদের মনে।
সাধারণ বৃষ্টির জলে এত বেশি পরিমাণ মৌলের উপস্থিতি লক্ষ করা যায় না। তবে শেষ পর্যন্ত অনেক পরীক্ষা করার পরও এই ঘটনার কোনো সঠিক এবং প্রমাণসাপেক্ষ কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
গবেষণায় দেখা যায় যে, এই রক্তবৃষ্টির প্রতি মিলিমিটার পানিতে প্রায় নয় মিলিয়ন লাল বর্ণের কণিকা উপস্থিত আছে। গণনা করে আরো দেখা যায়, প্রতি লিটার পানিতে প্রায় ১০০ মিলিগ্রাম কঠিন পদার্থ বিদ্যমান।
এই গণনা থেকে বিজ্ঞানীগণ জানান, কেরালায় যে পরিমাণ রক্তবৃষ্টিপাত হয়েছে, তাতে সব মিলিয়ে প্রায় ৫০,০০০ কিলোগ্রাম পরিমাণ লাল কণিকা ভূমিতে পতিত হয়েছিলো।
বৃষ্টির পানি থেকে আলাদা করা এসব কঠিন পদার্থের নমুনা পরীক্ষা করে জানা যায় যে এদের বর্ণ বাদামী-লাল বর্ণের। এসব কণিকার প্রায় ৯০ শতাংশ পরিমাণই গোলাকার (অনেকটা প্রাণীর রক্তের লোহিত কণিকার মত) এবং বাকি অংশ কোনো বস্তুর ধ্বংসাবশেষ বলে মনে হয়।
এছাড়াও সবুজ বা হলুদ বর্ণের অল্প কিছু পরিমাণ কণিকার উপস্থিতিও পাওয়া যায় এই পানিতে। মূলত লাল কণিকার উপস্থিতির কারণেই বৃষ্টির বর্ণ এরূপ হয়েছে বলে জানান গবেষকগণ।
এখন আরেকটা প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক- কোথা থেকে এলো এসব গোলাকার লাল বর্ণের কণিকা? কীভাবে এলো? বা শুধু কেরালার এই নির্দিষ্ট অঞ্চলেই কেন?
এই ঘটনায় যাওয়ার আগে আরো একটা রহস্যময় ঘটনার কথা বলে নেয়া উচিৎ, যা কেরালার ঐ একই এলাকায় ঘটেছিলো। রক্তবৃষ্টি পতিত হওয়ার কয়েকদিন পূর্বে কোত্তায়াম এবং ইড়ুক্কি অঞ্চলের মানুষেরা হঠাৎ প্রচণ্ড জোরালো শব্দ শুনতে পায় এবং সেই সাথে প্রচণ্ড আলোর ঝলকানিও দেখা যায়।
এরকম শব্দ কেবল সুপারসনিক বিমানের দ্বারাই তৈরী করা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু ভারতের বিমান বাহিনী থেকে জানানো হয়, ওই কয়েকদিন কোনো প্রকার বিমান মহড়া করা হয়নি। কাজেই এটি একটি রহস্যময়তার সৃষ্টি করেছিলো তখন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮২৫
আপনার মতামত জানানঃ