আফগানিস্তানের মাজার-ই-শরিফে আলাদা দুটি মিনিবাসে থাকা বোমা বিস্ফোরণে অন্তত ৯ জন নিহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১৩ জন।
বৃহস্পতিবার (২৮ এপ্রিল) এ হামলার ঘটনা ঘটে। শহরটিতে একটি শিয়া মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণের এক সপ্তাহ পর এ ফের ঘটনা ঘটলো।
গত আগস্টে তালিবান ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে আফগানিস্তানে জনসাধারণের বিরুদ্ধে হামলার ঘটনা কমেছে। কিন্তু শিয়া জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্যবস্তু করে হামলা করেই চলেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট। মূলত শিয়াদের ধর্মদ্রোহী বলে মনে করে থাকে ইসলামিক স্টেট।
আফগানিস্তানের বালখ প্রদেশের প্রাদেশিক পুলিশের মুখপাত্র আসিফ ওয়াজিরি এএফপিকে বলেছেন, বৃহস্পতিবারের মাজার-ই-শরীফের পৃথক জেলায় একে-অপরের ঠিক কয়েক মিনিটের ব্যবধানের মধ্যে বিস্ফোরণগুলো ঘটে। এই মিনিবাসের যাত্রীরা রোজা ছিলেন এবং ইফতারের জন্য বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন।
তিনি জানান, শিয়া যাত্রীদের লক্ষ্য করে এই হামলা চালানো হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। হামলায় আরও ১৩ জন আহত হয়েছেন। তার অভিযোগ, ‘আফগানিস্তানের শত্রুরা আমাদের জনগণের মধ্যে উত্তেজনা ও বিভেদ সৃষ্টি করছে।’
হামলার কয়েক ঘণ্টা পর জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস এর দায় স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে এএফপি।
আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তালিবানের দাবি, তারা জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসকে পরাজিত করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি আফগানিস্তানের নতুন শাসকদের কাছে এখনও একটি প্রধান নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। অবশ্য গত আগস্টে তালিবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে আফগানিস্তানে বোমা হামলার ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
সপ্তাহখানেক আগে হওয়া এক হামলার পর পাকিস্তান থেকে বিবিসির সেকেন্দার কেরমানি বলেছিলেন, আফগানিস্তানে আইএস কোনো এলাকা বা অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে না, কিন্তু তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী তালিবান গোষ্ঠী ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকে জঙ্গিগোষ্ঠীটি এমন সব এলাকায় হামলা চালাচ্ছে যেখানে আগে কখনোই তাদের উপস্থিতি ছিল না।
শিয়া জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্যবস্তু করে হামলা করেই চলেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট। মূলত শিয়াদের ধর্মদ্রোহী বলে মনে করে থাকে ইসলামিক স্টেট।
আইএস মাজার-ই শরিফে হামলার দায় স্বীকার করলেও কুন্দুজে হামলা বা কাবুলের স্কুলে হামলার দায় স্বীকার করেনি। এর আগে বৃহস্পতিবার (২১ এপ্রিল) আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় শহর মাজার-ই-শরিফে একটি শিয়া মসজিদে শক্তিশালী বিস্ফোরণে অন্তত ২৫ জন নিহত হন। এ হামলায় আহত হয়েছেন আরও ৪০ জন। পরে হামলার দায় স্বীকার করে জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস। একইদিনে কুন্দুজে আরেকটি হামলায় নিহত হন ৪ জন এবং আহত হন ১৮ জন। কুন্দুজের পুলিশ প্রশাসন জানিয়েছে, দুই হামলার ঘটনা খতিয়ে দেখছে তারা।
এসব হামলার ঘটনায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তালিবান সরকার। আফগানিস্তানের তালিবান সরকার জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের খোরাসান শাখাকে (আইএস-কে) পরাজিত করেছে বলে দাবি করলেও তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
আইএস তালিবানের মতো একটি সুন্নি দল কিন্তু দুটি গোষ্ঠীই তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। উভয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় আদর্শগত পার্থক্য হলো তালিবানরা শুধু বিদেশি বাহিনী মুক্ত আফগানিস্তান চেয়েছিল, যেখানে আইএস একটি ইসলামি খেলাফত চায়।
গত বছর তালিবানের ক্ষমতা দখলের পর আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রান্তে ধারাবাহিকভাবে আক্রমণের শিকার হচ্ছে শিয়া জনগোষ্ঠীর মানুষ। পাশাপাশি হাজারা, তাজিক, উজবেকসহ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপরও ক্রমাগত হামলার ঘটনা ঘটছে।
তালিবানের ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন আফগানিস্তানে বসবাসরত শিয়া মতাবলম্বী সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের শঙ্কা ছিল, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ শাসনামলের মতো যদি তারা আবার জাতিগত নিগ্রহের শিকার হয়!
আফগানিস্তানের প্রতাপশালী পশতুন জনগণ হাজারাদের কখনো তাদের সমতুল্য মনে করতে পারেনি। হাজারারা শিয়া। পশতুনরা সুন্নি। ধর্মকেন্দ্রীক এ মতভেদ এবং হাজারাদের নিজস্ব জীবন ব্যবস্থার কারণে কখনো আফগানিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রে আসতে পারেনি সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়।
বেসামরিক সরকার হাজারাদের কথা শোনার চেষ্টা করলেও ১৯৯০-এর দশক থেকে জঙ্গিদের কিলিং মিশনের টার্গেটে পরিণত হয় হাজারারা। তালিবান থেকে শুরু করে যেকোনো সুন্নি উগ্রবাদীরা হাজারাদের মুসলমান মনে করে না।
১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে তালিবান কমান্ডার মাওলানা মোহাম্মদ হানিফ সমবেত সুন্নি জনতার উদ্দেশে বলেন, ‘হাজারারা মুসলিম নয়, তাদের হত্যা কর।’ এরপর তাদের ওপর চরম নিপীড়ন চলতে থাকে। তালিবান সরকারের সময় হাজারাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
হত্যা-নির্যাতনের ভয়ে অনেক হাজারা শিয়াপ্রধান দেশ ইরানে পালিয়ে যায়। আর যারা মাটির মায়া ছাড়তে না পেরে থেকে যায়, তাদের ভাগ্যে জোটে নির্মম অত্যাচার। ১৯৯৮ সালে মাজার-ই শরিফে ষড়যন্ত্র করে কয়েক হাজার হাজারাকে হত্যা করা হয়। তালিবান ও আল-কায়েদার জঙ্গিরা সুযোগ পেলে হাজারাদের রক্তে হাত রাঙাতে দ্বিধা করে না।
বর্তমানে হাজারাদের নতুন শত্রু আইএস। পথে, বাসে, প্রতিষ্ঠানে যেখানে সুযোগ পাচ্ছে, সেখানে হামলা চালাচ্ছে তারা। চারদিক থেকে নির্যাতনের শিকার হাজারা সম্প্রদায়ের লোকজন প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তারা আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত জঙ্গিপ্রবণ আফগানিস্তানে হাজারারা নিষ্পেষিত— এ কথা প্রমাণ দিয়ে বলা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে এমন আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে যে, আফগানিস্তানে আসলে কারা সুরক্ষিত? কেউ নয়। জোর দিয়ে বলা যায়, যত দিন ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষ হত্যা বন্ধ না হবে, ততদিন শান্তি ফিরবে না আফগান মুল্লুকে। আর ততদিন শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না হাজারারা। ফলে শান্তির জন্য আফগানিস্তানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বহু বিভক্ত আফগানিস্তানে সেই সম্প্রীতি কবে হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ হামলা তালিবান সরকারের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ। বিদেশী বাহিনী চলে যাওয়ার পর গত আগস্টেই তারা ক্ষমতা বুঝে নেয়। এর মধ্যেই বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটেছে। তালিবান সরকার-সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে বেশ কয়েকজন আইএস নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরো অনেক সন্দেহভাজনকে হত্যা করা হয়েছে। তার প্রতিশোধ হিসেবে এ হামলার ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে এখনো প্রকাশ্যে কোনো অভিযোগ করা হচ্ছে না।
তালিবানরা এবার ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি আগের চেয়ে শান্ত হবে বলে প্রত্যাশা করেছিলেন অনেক আফগান নাগরিক। কিন্তু পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে তালিবান সরকারের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ইসলামিক স্টেট অব খোরাসান বা আইএস-কে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৩৫
আপনার মতামত জানানঃ