পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলায় মন্দিরে কোরআন রেখে পালিয়ে যাওয়ার সময় মো. ইদ্রিস (৫৫) নামে এক ব্যক্তিকে স্থানীয় লোকজন আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার (২৮ এপ্রিল) পুলিশ বাদী হয়ে ধর্মীয় অবমাননা আইনের ধারায় মামলা রুজু করেছেন।
আটক ইদ্রিস খান বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে কালী মন্দিরে পবিত্র কোরআন শরীফ রেখে পালানোর সময় স্থানীয়দের হাতে সে ধরা পড়ে। বৃহষ্পতিবার ভোরে ইদ্রিসকে বাউফল থানা পুলিশে সোপার্দ করা হয়েছে। পরে তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।
এঘটনায় ওই এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
ইদ্রিসের গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জের শাপলাখালি ইউনিয়নে। তবে তিনি পটুয়াখালীর দুমকীর জলিসা এলাকায় বসবাস করেন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার উত্তর পালপাড়া গ্রামের রাধাগোবিন্দ মন্দিরের অদূরে দিলীপ পালের বাড়িতে তিন দিন ধরে হিন্দু সম্প্রদায়ের নামযজ্ঞ অনুষ্ঠান চলছিল। বুধবার ছিল অনুষ্ঠানের শেষ দিন। ওই দিন রাত তিনটার দিকে অনুষ্ঠান চলাকালীন ইদ্রিস নামের ওই ব্যক্তি হাতে একটি ব্যাগ নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করেন। ওই সময় শুকরঞ্জন বৈরাগী নামের এক পুরোহিতের বাধার মুখে ওই ব্যক্তি চলে যান। ওই রাতেই অনুষ্ঠান শেষে সঞ্জয় পাল (৩৪), সজল পাল (৩০) ও কার্তিক পাল (৩৫) নামের তিন ব্যক্তি বাড়িতে ফেরার পথে রাত সাড়ে তিনটার দিকে দেখতে পান পাশের কালীমাতা মন্দির থেকে ওই ব্যক্তি বের হচ্ছেন।
সঞ্জয় পাল বলেন, গভীর রাতে মন্দির থেকে ওই ব্যক্তিকে বের হতে দেখে তার কাছে মন্দিরে ঢোকার কারণ জানতে চাইলে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন ইদ্রিস। পরে তাদের ডাক–চিৎকারে স্থানীয় লোকজন এসে ইদ্রিসকে আটক করে ফেলেন। পরে তারা দেখতে পান মন্দিরের কালীমাতা প্রতিমার সামনে ঘটের ওপর একটি ব্যাগ রাখা। ওই ব্যাগ খুলে দেখতে পান কোরআন শরিফ। একপর্যায়ে ইদ্রিস কোরআন শরিফ রাখার কথা স্বীকার করেন। পরে পুলিশে খবর দিলে ভোররাত চারটার দিকে পুলিশ গিয়ে ইদ্রিসকে আটক করে বাউফল থানায় নিয়ে যায়।
কীর্তন কমিটির সভাপতি দিলীপ পাল জানান, এঘটনায় কীর্তন আঙ্গিনায় সমবেত ভক্তদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ভোর সাড়ে ৫ টার দিকে কীর্তন অনুষ্ঠান শেষ করা হলেও ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী বৃহষ্পতিবার দিন ব্যাপী অনুষ্ঠান থাকলেও সেগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। ঘটনার পর থেকে হিন্দু অধ্যুষিত উত্তর রাজনগর পাল পাড়ার সকল পরিবারের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
দিলীপ পাল বলেন, ‘ভাগ্য ভালো যে হাতেনাতে ধরা পড়েছেন। তা না হলে বড় ধরনের অঘটন ঘটতে পারত। তখন এর দায় কে নিত? এমন ঘটনা ওই ব্যক্তি কেন এবং কী উদ্দেশ্যে করেছেন, তা প্রশাসনের অধিকতর তদন্ত করে বের করতে হবে।’
বাউফল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আল মামুন বলেন, প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, ওই ব্যক্তির বাড়ি বাকেরগঞ্জ উপজেলার নলুয়া গ্রামে। তিনি দুমকি উপজেলার আঙ্গারিয়া এলাকার কদমতলা আবাসনে থাকেন। তার এক স্বজন জানিয়েছেন, ইদ্রিস মাঝেমধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ করতেন। এরপরও এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ধর্মীয় অবমাননা আইনের ধারায় মামলা করেছে এবং তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে তোলা পর বিচারক কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
‘ভাগ্য ভালো যে হাতেনাতে ধরা পড়েছেন। তা না হলে বড় ধরনের অঘটন ঘটতে পারত। তখন এর দায় কে নিত? এমন ঘটনা ওই ব্যক্তি কেন এবং কী উদ্দেশ্যে করেছেন, তা প্রশাসনের অধিকতর তদন্ত করে বের করতে হবে।’
পটুয়াখালীর পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটনের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এলাকার পরিবেশ শান্ত রয়েছে। মন্দির এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
এদিকে মন্দিরে পবিত্র কোরআন শরিফ রেখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টার ঘটনায় পটুয়াখালী জেলা পুজা উদযাপন পরিষদ আহবায়ক স্বপন ব্যানার্জী ও সদস্য সচিব এ্যাড. সঞ্জয় খাসকেল, বাউফল উপজেলা পুজা উদযাপন পরিষদ সভাপতি সঞ্জিব সাহা ও সাধারণ সম্পাদক অতুল পাল গভীর উদ্বেক প্রকাশ করেছেন এবং তীব্র নিন্দা জানান। এ ঘটনার সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্ত শাস্তির দাবী জানান।
এর আগে গত বছর দুর্গাপূজায় সারা দেশে উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্যে ১৩ অক্টোবর ভোরে কুমিল্লার একটি মণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ পাওয়া যায়। এর জেরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে সহিংসতা। পরে মন্দিরে কোরআন রাখার অভিযোগে ইকবাল নামে এক যুবক শনাক্ত হন।
ইকবাল এখন কারাগারে আছেন।
সাধারণত বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে সংখ্যালঘুদের উপরে আক্রমণ বা নির্যাতন পরিচালিত হয় না। বাংলাদেশে যেটি হয় তা হচ্ছে ‘সংখ্যালঘু রাজনীতি’। ইংরেজিতে বলা যায়, ‘দ্য মাইনোরিটি কার্ড’। নানাকারণে সংখ্যালঘুরা এই রাজনীতির শিকার হচ্ছে কয়েক দশক ধরে।
কয়েক দশক ধরে একের পর এক সাম্প্রদায়িক হামলা, নির্যাতন ঘটলেও তার বিচার হয় না। মূল অপরাধী বা ইন্ধনদাতার পরিচয় প্রকাশ বা তাদেরকে বিচারের সম্মুখীন না করার ফলে বেড়ে চলেছে নির্যাতন। এর পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর দায় স্বীকার না করা ও ক্ষেত্রবিশেষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদত রয়েছে বলেও দাবি করে আসছে মানবাধিকার সংগঠনের নেতারা।
দেশে বিভিন্ন ধরনের সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও সহিংসতার ঘটনায় সামাজিক স্তরে নিন্দা-প্রতিবাদ উঠলেও মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোকে নীরব থাকতে বা দৃশ্যমান ভূমিকায় না আসতে দেখা যাচ্ছে। বাম-প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ছোট দলগুলো প্রতিবাদ-প্রতিরোধে সোচ্চার হলেও কিছুই যেন করার নেই বড় দলগুলোর।
বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও সরকারবিরোধী প্রধান দল বিএনপির ভূমিকা দৃশ্যমান নয়, সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও তাই। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর এ ক্ষেত্রে নিষ্ফ্ক্রিয় ও নীরব অবস্থান সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে সাহসী করে তুলছে বলে আশঙ্কা করছে দেশের বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজ।
বিশ্নেষকরা বলছেন, কেবল সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোই নয়, নিকট অতীতে দেশে যতগুলো সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক দলগুলোর এমন নীরব-নিস্ক্রিয় ভূমিকা দেখা গেছে। সহিংসতার শিকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য ও তাদের পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি নেতাকর্মীদের।
এমনকি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বিশেষ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য, উপজেলা-ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বার-কাউন্সিলররা কয়েকটি ক্ষেত্রে ঘটনাস্থল পরিদর্শনেও যাননি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু হওয়ায় মূলত ভোটের হিসাব মাথায় থাকার কারণেই রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা নীরব অবস্থান নিচ্ছেন, এমন অভিযোগ তুলেছেন অনেকেই।
তারা আরও বলছেন, দেশে যে কোনো সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনার পর তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও রাজনীতি হয়, কিন্তু বিচার হয় না। ফলে থামছে না নির্যাতনের ঘটনাও।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনায় প্রথম ও প্রধান শিকার হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। রাজনীতির হিসাব-নিকাশে বড় হয়ে ওঠে কারা তাদের ভোট পাবে, কারা পাবে না। নিরাপত্তা নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে। নব্বই ও বিরানব্বইয়ের পর ২০০১ সালে এবং রামু, সাথিয়া, নাসিরনগরের ঘটনায় এর প্রমাণ মিলেছে। নির্বাচিত দল বা সরকার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ঐ সময়ের বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বিশ্বসম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করতে হয়েছে।
আমাদের দেশে যে কোনো সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় রাজনৈতিক মাঠ গরম থাকে বেশ কিছু দিন। পক্ষে-বিপক্ষে, অভিযোগ পাল্টা-অভিযোগ চলতেই থাকে। সকল সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন, সুশীল সমাজ রাস্তায় নামে এবং প্রতিকার খোঁজার চেষ্টা করে। তেমন সমাধান পাওয়া যায় না। মামলা হয়; কিন্তু বিচার হয় না। ফলে থামছে না নির্যাতনের ঘটনাও। অভিযোগ, নেপথ্যে ক্ষমতাসীনরা জড়িত থাকায় তাদেরকে আইনের আওতায় আনা যায় না। এবারের ঘটনাতেও ক্ষমতাসীনদের জড়িত থাকার অভিযোগ এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, এ দেশের সকল ধর্মের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্য। এ দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটি যুদ্ধ করে অর্জন করা। সেই মাটির অধিকার আমাদের সকলের। কেবল ধর্মের কারণে সেই অধিকারবোধ নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। যে কোনো মূল্যে এই ঐক্যের বোধ জাগ্রত রাখতে হবে। উন্নয়নের প্রকৃত সোপান সেখানেই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২৩২৮
আপনার মতামত জানানঃ