‘দ্য সাম্বা স্ক্যান্ডাল’-এর পটভূমি যে জায়গায়, সেই সাম্বা হচ্ছে একটি জেলার নাম, যা জম্মু-কাশ্মীরের আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। শান্তশিষ্ট একটি সীমান্তবর্তী জেলা, ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের কড়া পাহারার জন্য কোনো প্রকার ঝামেলা হতে দেখা যায় না এখানে। শুধু যে সেনাসদস্যরাই এখানে অবস্থান করেন তা নয়।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিশেষায়িত গোয়েন্দা ইউনিট ডিরেক্টরেট অব মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স (এমআই) এর অসংখ্য ছদ্মবেশী গোয়েন্দা কর্মকর্তাও এই জেলায় অবস্থান করতেন প্রতিবেশী পাকিস্তানের বিভিন্ন গোপন তথ্য সংগ্রহের আশায়। এই সীমান্তবর্তী এলাকার ভৌগলিক অবস্থান যেহেতু স্পর্শকাতর জায়গায় (পাকিস্তান থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে), তাই ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৬৮ তম ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের সেনাসদস্যদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সবকিছু নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য।
এই ব্রিগেডের একজন সেনাসদস্য ছিলেন সারওয়ান দাস। আজকে যেখানে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে কাঁটাতারের শক্ত বেড়া রয়েছে, তখন এসব ছিল না। পাচারকারীরা আজকের তুলনায় অনায়াসে দুই দেশের নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারত।
সারওয়ান দাস দেখলেন, সেনাবাহিনী থেকে মাসশেষে তিনি যে বেতন-ভাতা পান, তা দিয়ে তার চলছে না। তার মনে বাড়তি আয়ের লোভ চেপে বসেছিল। তিনি উপায় খুঁজছিলেন, কীভাবে আরও কিছু অর্থ কামানো যেতে পারে। ভেবে দেখলেন, যে সময়ে তার ডিউটি থাকে না, সেসময়টাতে তিনি যদি ছোটখাট পাচারের সাথে নিজেকে যুক্ত করতে পারেন, তাহলে বেশ কিছু অর্থ আসতে পারে।
এই ভাবনা থেকেই তিনি ১৯৭২ সালের এক বর্ষণমুখর রাতে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানে যান। তার এই সিদ্ধান্ত যে পরে একসময় বিশাল বিপর্যয় ডেকে আনবে ১৬৮ তম ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের সেনাসদস্যদের জন্য, এটা বোধহয় তার ধারণাতেও ছিল না।
প্রথম যেদিন পাকিস্তানে গেলেন সারওয়ান দাস, সেদিন মস্ত বড় ভুল করেছিলেন তিনি, যার পূর্ণ সুবিধা নিয়েছিল পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনী। তিনি শিয়ালকোটে যাওয়ার পর যখন চলে আসার সময় হয়েছিল, তখন পকেটে থাকা ভারতীয় সেনাবাহিনীর পরিচয়পত্র না লুকিয়েই বাসের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বাসস্ট্যান্ডে ঘুমিয়ে যান।
তাকে দেখার পর বাসস্ট্যান্ডের এক পাকিস্তানি পুলিশ কর্মকর্তার সন্দেহ হয়। সেই কর্মকর্তা যখন তার পুরো শরীরে তল্লাশি চালায়, তখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পরিচয়পত্রসহ তাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। তবে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টি গোপন রেখেছিল, তারা তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য সারওয়ান দাসকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
গ্রেফতারের পর প্রথমদিকে তাকে শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি ভয় দেখানো হয়েছিল, তার পরিচয় গণমাধ্যমে ফাঁস করে দেয়া হবে। কিন্তু এরপর তাকে প্রস্তাব দেয়া হয়– যদি সে সীমান্তের ওপারের ভারতীয় সেনাঘাঁটির অবস্থান, সেনাকর্মকর্তাদের পরিচয় ইত্যাদির খবর দিতে পারে, তাহলে তাকে পর্যাপ্ত অর্থ দেয়া হবে। তিনি তাদের এই প্রস্তাবে সাড়া দেন।
পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে সারওয়ান দাস পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা ‘ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’ এর কাছে অসংখ্য তথ্য দিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, পাকিস্তানের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্য তিনি তার সহযোগী সেনাসদস্য আয়া সিংয়ের কাছেও প্রস্তাব দিয়েছিলেন, এবং আয়া সিংও তার মতো বাড়তি আয়ের আশায় তার প্রস্তাবে সাড়া দেন। তারা প্রায় তিন বছর গুপ্তচরবৃত্তি করার পর ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার হাতে ধরা পড়েন।
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা একটি ফাঁদ তৈরি করে। তাদেরই একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে পাকিস্তানি এজেন্ট সাজিয়ে আয়া সিং এবং সারওয়ান দাসের কাছে প্রেরণ করে। সারওয়ান ও আয়া এই ফাঁদে পা দেন। বেশ কিছু ঘটনার পর তাদের গ্রেফতার করতে সমর্থ হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। গ্রেফতার এড়াতে একবার তিনি চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিয়েও শেষরক্ষা পাননি, তাকে গ্রেফতার করা হয়।
সাধারণত সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর উপস্থিতি বেশি থাকে। অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর উপস্থিতি যে একেবারে থাকে না তা কিন্তু নয়। ‘দ্য সাম্বা স্ক্যান্ডাল’-এর ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল- সারওয়ান দাস এবং আয়া সিংকে গ্রেফতার করেছিল ব্যুরো অব ইন্টেলিজেন্স, যারা ভারতের অভ্যন্তরে মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের প্রতিদ্বন্দ্বী।
এই ঘটনা মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দারুণ ক্ষুব্ধ করেছিল। কারণ, তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ১৬৮ তম ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের এই দুই সদস্য গুপ্তচরবৃত্তি করছিল, এবং ধরা পড়েছিল অন্য একটি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে। এটি ছিল তাদের কাছে এক লজ্জাজনক ব্যাপার। ব্যুরো অব ইন্টেলিজেন্স তথা আইবির গোয়েন্দারা এই দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পর মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের কাছে হস্তান্তর করে।
মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স এরপর তাদেরকে টর্চার সেলে নিয়ে যায়। তাদের উপর ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে তথ্য আদায় করতে শুরু করে। তাদের দেয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একে একে পঞ্চাশের অধিক সামরিক কর্মকর্তা ও সেনাসদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া আটজন বেসামরিক ব্যক্তিকেও গ্রেফতার করে মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের গোয়েন্দারা।
আয়া সিং ও সারওয়ান দাস– দুজনই মূলত নির্মম নির্যাতন থেকে বাঁচতে জেরার মুখে অন্য সামরিক কর্মকর্তাদের নাম বলেছিলেন, যদিও তারা পাকিস্তানিদের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করেননি। কিন্তু তাদেরকে নির্মম নির্যাতন করা হয়েছিল এই দুজনের মতোই।
পরবর্তীতে তারা আদালতের দ্বারস্থ হলে ষাটজনের মধ্যে বেশ কিছু অভিযুক্ত সামরিক কর্মকর্তা ও সেনাসদস্য ন্যায়বিচার লাভ করেন। কিন্তু তাদেরকে আর সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হয়নি। এছাড়া গণমাধ্যম তাদেরকে যেভাবে দেশবাসীর সামনে ‘খলনায়ক’ হিসেবে উপস্থাপন করেছিল, সেই হারানো ভাবমূর্তিও আর ফিরে আসেনি তাদের। ‘দ্য সাম্বা স্ক্যান্ডাল’ এখন পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীর কলঙ্কিত অধ্যায়গুলোর একটি হয়ে স্থান পেয়েছে ইতিহাসে।
এসডব্লিউ/এসএস/২০১০
আপনার মতামত জানানঃ