১৯৯০ সালে পাকিস্তানের অর্থনীতির আকার ছিল ৪০ বিলিয়ন ইউএস ডলার, বর্তমানে সেই অর্থনীতির আকার প্রায় ২৬৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার। জনসংখ্যা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো পাকিস্তানের জন্যও আবির্ভূত হয়েছিল স্বাধীনতার পরপরই। উত্তরণ আর পতনের দোলাচলে রাজনীতি অর্থনীতি মিলিয়ে এখন উভয় সংকটে পাকিস্তান।
রাজনৈতিক সংকটের মধ্যেই অর্থনৈতিক দিক থেকে অতল গহ্বরে পড়ে গেল পাকিস্তান। অর্থনৈতিক অর্থ ভাণ্ডারের (আইএমএফ) ছয় বিলিয়ন ডলারের কর্মসূচি স্থগিত করে দেওয়া হল।
চলতি মাসে এই টাকা ছাড়া হবে না বলে জানিয়েছে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম দ্য নিউজের প্রতিবেদন। এমন পরিস্থিতিতে মার্কিন ডলারের বিপরীতে সর্বকালের রেকর্ড দরপতন হয়েছে পাকিস্তানি রুপির।
সূত্র মতে, মঙ্গলবার বাজার বন্ধের সময় এক ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রূপির দাম ছিল ১৮৫.২৩ রুপি; বুধবারে তা ১৮৫.৫০ রুপিতে এসে দাঁড়িয়েছে। ইতিহাসে এই প্রথমবার ১৮৫ রুপির গণ্ডি পেরিয়ে গিয়েছে পাকিস্তানি মুদ্রা।
পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম জিও টিভির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত কয়েকদিন ধরে অন্যান্য মুদ্রার নিরিখে শক্তিশালী হয়েছে মার্কিন ডলার। সেই ধাক্কার মধ্যেই অনিশ্চিত রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জেরে আইএমএফ ছয় বিলিয়ন ডলারের কর্মসূচি স্থগিত করে দেওয়ায় পাকিস্তানি রুপির এ বেহাল দশা।
ইসলামাবাদে আইএমএফের প্রতিনিধি এসথার পেরেজ রুইজ জানিয়েছেন, নতুন সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত এই তহবিল ছাড়া হবে না।
তিনি বলেন, তহবিলের মাধ্যমে পাকিস্তানকে সাহায্য করতে মুখিয়ে আছে আইএমএফ। নতুন সরকার গঠিত হলেই অর্থনীতির ভারসাম্যের দিকে নজর দেওয়া হবে। তবে আইএমএফের কর্মসূচি বন্ধ করে দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই।
প্রসঙ্গত, পাকিস্তানে চরমে উঠেছে রাজনৈতিক নাটক। এই আবহে অনাস্থা প্রস্তাব এবং সংসদ ভেঙে দেওয়ার প্রসঙ্গটি সেদেশের সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন রয়েছে। আর এই মামলা চলাকালীন সুপ্রিম কোর্টে বড় ধাক্কা খেয়েছেন ইমরান খান।
তার সুপারিশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি দেশের সংসদ ভেঙে দেওয়ার ইস্যুতে দায়ের করা মামলার রায় প্রদান স্থগিত রেখেছেন পাকিস্তানের শীর্ষ আদালত। এছাড়া, আদালতের একটি উল্লেখযোগ্য পর্যবেক্ষণে বড় ধাক্কা খেয়েছেন ইমরান।
এই পর্যবেক্ষণের প্রেক্ষিতে যদি পরবর্তীতে পাক সুপ্রিম কোর্ট রায় প্রদান করে, তাহলে ইমরানের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।
তবে বর্তমান সময়ে রাজনীতির পাশাপাশি পাকিস্তান আলোচিত হচ্ছে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে। পাকিস্তানের মুদ্রা গত ৬ মাসে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত দুর্বল হয়েছে ডলারের বিপরীতে। ২৬৩ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি ছুঁয়েছে দুই অঙ্কের ঘর, গত বছর মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ১০.১ শতাংশ।
জিডিপির ১০ শতাংশ রপ্তানির বিপরীতে আমদানি হচ্ছে ১৭ শতাংশ। ফলে সংকট দেখা দিয়েছে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে। সবকিছু মিলিয়ে পাকিস্তানে ২০১৮ সালের সংকটের পুনরায় আবির্ভাব ঘটছে, মহামারি ক্ষেত্রবিশেষে এই সংকটকে আরো গভীর করেছে পাকিস্তানের অর্থনীতির জন্য।
মুদ্রাস্ফীতি
পাকিস্তানের অর্থনীতিতে গত কয়েক বছর ধরেই ক্রমাগত উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতি অধিকাংশ সময়ই ঘোরাফেরা করেছে দুই অঙ্কের কাছাকাছি সংখ্যায়।
২০০৯ সালে পাকিস্তানের মুদ্রাস্ফীতি ছিল ১৯.৫৬ শতাংশ, গত দশকের শুরুতে ২০১০ সালে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ১০.১ শতাংশ, ২০১১ সালে এই হার ছিল ১৩.৬৬ শতাংশ। ২০১৩ সালে এই হার নেমে আসে ৭.৩৬ শতাংশে, ২০১৫ সালে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিলো ৪.৫৩ শতাংশ, ২০১৬ সালে এই হার ছিলো মাত্র ২.৮৬ শতাংশ।
মুদ্রাস্ফীতির এই ধারা ২০১৮ সাল পর্যন্ত বজায় থাকলেও, অর্থনৈতিক সংকট বাড়িয়ে দেয় ২০১৯ সালের মুদ্রাস্ফীতি, ২০২০ সালে এই মুদ্রাস্ফীতি ছিল ১০.৭৪ শতাংশ।
২০২০ সালের শুরুর দিক থেকেই পাকিস্তানে মুদ্রাস্ফীতির ব্যাপক প্রভাব দেখা যাচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, নিম্ন আয় আর নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষরা নিজেদের দৈনন্দিন জিনিসপত্র কিনতে পারছে না। ২০২১ সালের মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৯ শতাংশের কাছাকাছি। একই ধারা বজায় থাকবে ২০২২ সালেও।
সুদখোর সৌদির
ভঙ্গুর অর্থনীতিতে আমদানি ব্যয় মেটাতে ২০১৮ সালে সৌদি আরবের কাছ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয় পাকিস্তান। সৌদি আরব পাকিস্তানের বন্ধুপ্রতিম দেশ হলেও, এই ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য প্রায় ৪ শতাংশ সুদ আরোপ করে তারা।
পরবর্তীতে দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটলে পাকিস্তান চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে তিন দফায় এই ঋণ পরিশোধ করে।
মূলত, ভারত কাশ্মীরকে কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে নেওয়ার পর, কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে সৌদি আরবের।
প্রতিরক্ষা ব্যয়
ভঙ্গুর অর্থনীতির মধ্যে থেকেই গড়ে মোট সরকারি ব্যয়ের প্রায় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত সামরিক বাহিনীর পেছনে খরচ করেছে পাকিস্তান। নব্বইয়ের দশকের পুরোটা সময় জুড়েই বজায় ছিল এই ধারা।
গত দশকে এই হার ২০ এর নিচে আসে, ২০১৫ সালে মোট সরকারি ব্যয়ের প্রায় ১৮ শতাংশ ব্যয় হয় সামরিক বাহিনীর পেছনে। পরের দুই বছর এই ব্যয়ের হার কিছুটা কমলেও, ২০১৮ সালে সামরিক ব্যয় আবার পৌঁছায় মোট সরকারি ব্যয়ের ১৯ শতাংশে।
২০১৯ ও ২০২০ সালে ব্যয়ের শতাংশ কমলেও, বেড়েছে সামরিক বাজেট। জিডিপির হিসেবে এটি পাকিস্তানের মোট জিডিপির প্রায় ৪ শতাংশের কাছাকাছি।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের ক্ষেত্রে এই হার ২.৫ এর কাছাকাছি, মোট জনসংখ্যার অনুপাতে সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যাও পাকিস্তানে তুলনামূলকভাবে বেশি।
আইএমএফের বেইলআউট
ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড (আইএমএফ) এর ১৮৯টি সদস্য দেশ রয়েছে। ১৯৫৮ সালে সদস্য হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত পাকিস্তান আইএমএফের সাথে ২২টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, ২১টি ঋণের মধ্যে ১২টি বেইলআউট নিয়েছে আইএমএফ থেকে।
অর্থনীতির ভাষায় বেইলআউট হচ্ছে আর্থিক সংকটের সময়ে আর্থিক সহায়তা দানের মাধ্যমে কোন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা কোন দেশের অর্থনীতিকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা।
১৯৮০ সালে ১.৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয় পাকিস্তান, ১৯৮১ সালে নেয় ১ বিলিয়ন ডলার, ১৯৮৮ সালে নেয় ০.৭ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে প্রায় অর্ধেকটাই ছিল বেইলআউট। ১৯৯৪ সালে আইএমএফ থেকে ১.২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নেয় পাকিস্তান, ৬০০ মিলিয়ন বেইলআউট নেয় ১৯৯৫ সালে।
২০০০ সালে আবারো ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বেইলআউট নেয়, ২০০১ সালে ঋণ নেয় ১ বিলিয়ন ডলার। ২০০৮ সালে ৭.২ বিলিয়ন ডলারের বেইলআউট নেয়, ৪.৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নেয় ২০১৩ সালে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৪৫
আপনার মতামত জানানঃ