ক্যালেন্ডারের পাতায় তারিখটা ছিল ১৯৭৬ সালের ১৫ জুলাই। সেদিন মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো গণ-অপহরণের সাক্ষী হয়েছিল ক্যালিফোর্নিয়া। অপহৃত হয়েছিলেন বাস ড্রাইভার-সহ মোট ২৬ জন শিশু।
চাওয়া হয়েছিল ৫০ লক্ষ ডলারের মুক্তিপণ। ভারতীয় মুদ্রায় যার অর্থ প্রায় ৩৮ কোটি টাকা। তবে এখানেই থেমে থাকেনি নৃশংসতা। ড্রাইভার-সহ ২৬ জন শিশুকেই সেদিন জীবন্ত কবর দিয়েছিল দুষ্কৃতিরা।
কী ঘটেছিল সেদিন? অন্য যেকোন দিনের মতোই ছিল স্বাভাবিক একটা দিন। বিকেল শেষে সন্ধ্যে হতে চলেছে তখন। বাড়ি ফেরার আনন্দে স্কুলবাসে দিব্যি হই-হল্লা জুড়ে দিয়েছে শিশুরা। তাদের সকলের বয়সই ৫-১৪ বছরের মধ্যে।
তবে বাড়ি অবধি পৌঁছানো হয়নি তাদের। মাঝপথেই হঠাৎ ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল বাস। বাসে উঠল বন্দুকধারী তিন সশস্ত্র ব্যক্তি। তাদের নির্দেশেই সেই বাস গিয়ে পৌঁছাল ক্যালিফোর্নিয়ার লিভারমোরের নিকটবর্তী এক কোয়ারিতে।
ফ্রেডরিক উডস, জেমস শোয়েনফিল্ডস এবং রিচার্ড শোয়েনফিল্ডস— এই তিন বন্ধুই মূলত দায়ী ছিল গোটা অপহরণের পিছনে। গ্রেপ্তার হয়েছিল তিন অপরাধীই। আরোপিত হয়েছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি। তবে এক দশক আগেই মুক্তি পেয়েছিল শোয়েনফিল্ডস ভাতৃদ্বয়। এবার প্যারোল অনুমোদিত হল ফ্রেডরিকেরও।
আশ্চর্যের বিষয় হল, এই অপহরণের ঘটনার পিছনে দায়ী ছিল একটি সিনেমাও। ‘ডার্টি হ্যারি’। ফ্রেডরিক এবং তার দুই সঙ্গী অনুপ্রাণিত হয়েছিল এই সিনেমা দেখেই। সিনেমার কায়দাতেই জোগাড় করেছিল আগ্নেয়াস্ত্র। তারপর দরকার ছিল একটি ফাঁকা জনশূন্য স্থানের। তাতেও সমস্যায় পড়তে হয়নি ফ্রেডকে।
বাবা ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত প্রোমোটার। লিভারমোরে সেসময় আবাসন তৈরির একটি প্রকল্প রয়েছে তার দায়িত্বেই। কোয়ারির চাবিও ছিল ফ্রেডের কাছে। অপহরণের জন্য তাই এই অঞ্চলটাকেই বেছে নিয়েছিল ফ্রেডরিক।
পরিকল্পনামাফিক আগে থেকেই, কোয়ারিতে খুঁড়ে রাখা হয়েছিল ১২ ফুট গভীর গর্ত। তাতে আবর্জনা ফেলার বাঙ্কার স্থাপন করে তৈরি করা হয়েছিল অপহৃত শিশুদের আটক করার জন্য বিশেষ ‘গুম ঘর’।
শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য সামান্য ফাঁক ছাড়া আলো কিংবা খাদ্য-পানীয়ের কোনো ব্যবস্থাই ছিল না সেখানে। শিশুদের বাঙ্কারে বন্দি করার পর গোটা বাঙ্কারটাই মাটি চাপা দিয়ে দিয়েছিল ফ্রেড ও তার দুই সঙ্গী।
দীর্ঘ ১৬ ঘণ্টা পর শেষ পর্যন্ত ড্রাইভারের বুদ্ধিমত্তাতেই প্রাণ বেঁচেছিল ২৬ জন শিশুর। তাদের বীরত্বও কম কিছু ছিল না। গাড়ি সারানোর অল্পবিস্তর যান্ত্রিক কারিগরি জানা ছিল ড্রাইভারের। সেই সামান্য দক্ষতা নিয়েই ভেতর থেকে তিনি খুলে ফেলেন বাঙ্কারের ঢাকনা।
তারপর সবাই মিলে খুঁড়ে তৈরি করেন বের হবার পথ। আবর্জনা এবং গাড়ির ব্যাটারি পর পর সাজিয়ে তৈরি করেন সিঁড়ি। অপরাধীরা ঘুমিয়ে পড়ার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সেখান থেকে শিশুদের বার করে আনেন বাসচালক। তাদের বয়ানের ভিত্তিতেই সপ্তাহখানেক পর গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ৩ অপরাধীকে।
তবে প্রাণ বাঁচলেও, আবর্জনার অসহ্য দুর্গন্ধ, অনাহার এবং তেষ্টায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিল অধিকাংশ শিশুই। পাশাপাশি পিটিএসডি ও ট্রমার মতো দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবও পড়েছিল তাদের ওপর। আজও যার জাল থেকে মুক্তি পায়নি অনেকেই। এর পরেও ৩ অপরাধীর প্যারোলপ্রাপ্তি নিয়ে ক্রমশ বিতর্ক ঘনাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
যদিও অপরাধীরা বর্তমানে আর সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক নয়, এমনটাই দাবি মার্কিন প্রশাসনের। তবে এই অপহরণের ঘটনা মার্কিন ইতিহাসের অন্ধকারতম অধ্যায়গুলির মধ্যে অন্যতম।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯০৩
আপনার মতামত জানানঃ