জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপি) ‘বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২২’ প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বব্যাপী বহু নারী অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের শিকার হচ্ছেন। এটি বৈশ্বিক সংকটের চেহারা পাচ্ছে। এই সংকটকে গুরুত্ব দিয়ে এবারের প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘অদৃশ্যকে দেখা’।
গত বুধবার(৩০ মার্চ) বার্ষিক এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইউএনএফপিএ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পুরুষদের গড় আয়ু ৭২ বছর। আর নারীর ৭৫ বছর। অর্থাৎ নারীরা পুরুষের চেয়ে তিন বছর বেশি বেঁচে থাকছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সঙ্গে ইউএনএফপিএর পরিসংখ্যানের খুব বেশি পার্থক্য নেই। বিবিএসের হিসাবে, দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৮ বছর। পুরুষের গড় আয়ু ৭১ দশমিক ২ বছর এবং নারীর ৭৪ দশমিক ৫ বছর।
বাংলাদেশের নারীদের গড় আয়ু এখন ৭৫ বছর। দম্পতিরা গড়ে দুটির কম সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন। তবে ১ হাজারের মধ্যে ৫৯টি গর্ভধারণ হচ্ছে মায়ের অনিচ্ছায়।
প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৬ শতাংশের বয়স ৬৫ বছরের বেশি। জাতিসংঘের হিসাবে, দেশে জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৭৯ লাখ। যদিও সরকার তিন মাস ধরে বলে আসছে, দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৩ লাখ।
৫০ বছর আগে অর্থাৎ স্বাধীনতার পরপর জনসংখ্যাকে অন্যতম বড় সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছিল। তখন প্রজনন হার ছিল ৬ দশমিক ৩। অর্থাৎ ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী একজন প্রজননক্ষম নারী গড়ে ছয়টির বেশি সন্তানের জন্ম দিতেন। পাঁচ দশক ধরে টিএফআর ক্রমান্বয়ে কমেছে। সর্বশেষ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে টিএফআর ছিল ২ দশমিক ৩। ইউএনএফপিএ তাদের প্রতিবেদনে বলছে, বাংলাদেশের টিএফআর এখন ১ দশমিক ৯। যার অর্থ একজন প্রজননক্ষম নারী সারাজীবনে দুটির কম সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন।
প্রজনন হার কমে আসার সঙ্গে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর ব্যবহার বৃদ্ধির সম্পর্ক আছে। ইউএনএফপিএ বলছে, ৬৩ শতাংশ দম্পতি কোনো না কোনো জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করে। আর আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করেন ৫৫ শতাংশ দম্পতি। অনেক আগেই বাংলাদেশ লক্ষ্য স্থির করেছিল, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার ৭২ শতাংশে নিয়ে যাওয়া। সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। অন্যদিকে ইউএনএফপিএ বলছে, ১২ শতাংশ দম্পতি প্রয়োজনের সময় হাতের কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী পান না। একে বলা হয় অপূর্ণ চাহিদার হার। জনসংখ্যাবিদেরা বলছেন, দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর অপূর্ণ চাহিদার হার বেড়েছে। কেউ বলছেন, এটি এখন ১৭ শতাংশ। মহামারির কারণে সেবা গ্রহণ ও সেবাদান কমে আসার কারণে এই হার বেড়েছে।
বাংলাদেশের নারীদের গড় আয়ু এখন ৭৫ বছর। দম্পতিরা গড়ে দুটির কম সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন। তবে ১ হাজারের মধ্যে ৫৯টি গর্ভধারণ হচ্ছে মায়ের অনিচ্ছায়।
অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ইউএনএফপিএ বলছে, কোনো শিশুর জন্য পরিকল্পনার বাইরে গর্ভধারণই হচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ। এর পেছনে একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন, নীতি ও আইন, সংস্কৃতি এবং জনমিতিক চরিত্র কাজ করে। প্রতিটি অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ যে মানবাধিকার লঙ্ঘনেরই ফল, তা কিন্তু নয়। তবে প্রয়োজনের সময় জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী পাওয়া, পদ্ধতি পছন্দ করা, সন্তান ধারণের সময় বেছে নেওয়া, সন্তানের সংখ্যা ঠিক করা–এসবই অধিকারের মধ্যে পড়ে। বৈশ্বিকভাবে ১ হাজারের মধ্যে ৬৪টি গর্ভধারণ অনাকাঙ্ক্ষিত। বাংলাদেশে তা ৫৯।
অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের সঙ্গে মাসিক নিয়মিতকরণের সম্পর্ক আছে। অনেকে ঠিক সময়ে এই সেবা পান না। আবার অনেকে ঠিক মানুষের কাছে এই সেবা পান না। এসব কারণে জটিলতার সৃষ্টি হয়, যা মাতৃমৃত্যুর একটি কারণ।
ইউএনএফপিএ তাদের প্রতিবেদনে বলছে, দেশে ১ লাখ শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ১৭৩ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। মাতৃমৃত্যুর আরেকটি কারণ প্রসবের সময় দক্ষ ও প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর সেবা না পাওয়া। বাংলাদেশে এখনো বহু সন্তানের জন্ম হয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালের বাইরে। ইউএনএফপিএ বলছে, ৪১ শতাংশ সন্তান জন্ম নিচ্ছে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তা ছাড়াই।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের পেছনে থাকে মানবাধিকার লঙ্ঘন। এই সংকট অনেকেরই দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। একজন নারী যদি অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের শিকার হন, তা হলে তার পরিণতি সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হতে পারে। নিরাপদ গর্ভধারণ করার উপযুক্ত হয়ে ওঠার আগেই কোনো কিশোরীর গর্ভধারণ করলে তার স্বাস্থ্যহানি ঘটে, মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে। প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে ১৮ বছর হওয়ার আগেই ৫১ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৮
আপনার মতামত জানানঃ