নাটোর জেলা কারগারে এক রাতে ২ জন কয়েদির মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার দিনগত রাত ৮টার দিকে ওসমান শেখ ও আজ শুক্রবার ভোরে আনছার শেখ নামে দুজন কয়েদি মারা গেছেন। তাদের মধ্যে আনছার শেখ ছিলেন হত্যা মামলায় দণ্ড পাওয়া আসামি এবং ওসমান শেখ মাদক মামলার আসামি।
জেল সুপার আব্দুর রহিম জানান, একটি হত্যা মামলায় বিচারাধীন হাজতি আনছার আলী গত বছরের ১৪ জানুয়ারি থেকে নাটোর জেলা কারাগারে বন্দী রয়েছেন। শুক্রবার ভোরে হঠাৎ তিনি বুকে ব্যাথা অনুভব করলে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে নাটোর সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
জেল সুপার আরো জানান, বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে একই হাসপাতালে ২৯ দিনের সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি ওসমান শেখের মৃত্যু হয়। গাঁজা সেবনের অপরাধে ভ্রাম্যমাণ আদালত ১৪ মার্চ ওসমানকে সাজা দিয়েছিল।
নাটোর জেলা কারাগারের জেলার মো. আবু তালেব বলেন, ‘বৃহস্পতিবার দিনগত রাতে ওসমান শেখ নামে মাদক মামলার এক কয়েদির মৃত্যু হয়েছে। রাত ৮টার দিকে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃত্যু হয়। ওসমান শেখ নাটোর সদর উপজেলার দিঘাপতিয়া গ্রামের নুরু শেখের ছেলে। চলতি মাসের ১৪ তারিখে মাদকগ্রহণের অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালতে তার সাজা হয়।’
উভয়ের লাশ নাটোর সদর হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানায় কারা কর্তৃপক্ষ।
তবে কয়েদি ওসমানের মৃত্যু নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। পরিবারের দাবি, পুলিশি নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়েছে। তবে পুলিশ বলছে অসুস্থতার কারণে তিনি মারা গেছেন। ওসমানের বাড়ি সদর উপজেলার দিঘাপতিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম হাগুড়িয়া গ্রামে। তার বাবার নাম নুরু শেখ।
স্বজনরা জানান, গত ১৪ মার্চ মাদক গ্রহণের অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালতে তার সাজা হয়। ওইদিন থেকেই ওসমান নাটোর জেলা কারাগারে কয়েদি হিসেবে বন্দি ছিলেন। গত রাত সোয়া ৭টার দিকে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার জন্য নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাত পৌনে ৮টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
বোন জামাই মুকুল জানান, ওসমান কাঠমিস্ত্রির কাজ করতো। তার দুই ছেলে-মেয়ে। মেয়ে আলমিনার বয়স ৬, আর ছেলে আলিমের বয়স ৩ বছর। গত ৫-৭ বছর থেকে তার মাথায় মাঝে মধ্যে সমস্যা হলে সবার সঙ্গে খারাপ আচরণ করতো।
কয়েদি ওসমানের মৃত্যু নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। পরিবারের দাবি, পুলিশি নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়েছে।
তিনি দাবি করেন, ‘বিভিন্ন মাধ্যমে জেনেছি, কারাগারের এক কয়েদি ওসমানকে এক গাঁজা দেয়। ওই গাঁজা পাওয়ার পর পুলিশ তার ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। এতে সে অসুস্থ হয়ে পরে। এরপর সদর হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।’
ওসমানের ভগ্নিপতি বলেন, ‘আমাদের পরিচিত একজন তার আত্মীয়কে কারাগারে দেখতে গিয়ে জানতে পারেন, ওসমানকে কারাগারে মারধর করা হয়েছে। আমরা এটা শোনার পর তাকে দেখতে যেতে চেয়েছিলাম। তার আগেই আজ সকালে পুলিশ এসে জানায় ওসমান মারা গেছে।’
তবে জেল সুপার আব্দুর রহিম দাবি করেন, ডাক্তারের রিপোর্ট অনুযায়ী ওসমান গত ৮ বছর ধরে মাদকাসক্ত। এ কারণে জেলখানায়ও সে প্রায় অসুস্থ হয়ে জেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতো। যেদিন জেলে আসে সে সময়ে তার কাছে গাঁজা পাওয়ায় তা জব্দ করা হলেও কোনও নির্যাতন করা হয়নি। আর অসুস্থ হওয়ার আগেও তার কাছে গাঁজা পাওয়া বা তাকে নির্যাতনের কোনও ঘটনা ঘটেনি। বরং অসুস্থতার কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার রাত ৪টার দিকে নাটোর জেলা কারাগারের আরও এক কয়েদির মৃত্যু হয়। কয়েদির নাম আনছার আলী। তিনি পাবনা জেলার চক ভানুরা গ্রামের ভানুর ছেলে। গত ১৭ জানুয়ারি জেলার লালপুর উপজেলার একটি হত্যা মামলার আসামি হিসেবে তিনি কারাগারে আসেন। বৃহস্পতিবার রাত ৩টার পর তিনি বুকে ব্যথা অনুভব করলে সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷। সেখানে ৩ টা ৫৮ মিনিটে তার মৃত্যু হয়। জেল সুপার আব্দুর রহিম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চললেও এটির উন্নতিতে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো কাজ হয়নি। চিকিৎসক এবং অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রীর অপ্রতুলতার কারণে কারাগারে এর আগেও বন্দি মারা গিয়েছে।
তারা বলেন, ১৮৯৪ সালের প্রিজন অ্যাক্টের ১৩ ধারা মতে, একজন বন্দির পূর্ণ চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। একজন মেডিক্যাল অফিসার প্রতি ২৪ ঘণ্টা অন্তর বন্দিদের শারীরিক পরীক্ষা ছাড়াও তাদের নানা অসুস্থতা সম্পর্কে জানার কথা। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে যে, বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে বিষয়টি সর্বক্ষেত্রে মানা হয় না। এদিকে ১৮৬৪ সালের জেলকোড বন্দিদের চিকিত্সা পাওয়ার ক্ষেত্রে দারুণ ব্যবস্থা রেখেছে।
এ বিধান অনুযায়ী, কোনো বন্দি অসুস্থ হলে প্রহরীরা সঙ্গে সঙ্গে হেড ওয়াড্রেনকে জানানোর কথা রয়েছে। তিনি সাব-অ্যাসিসট্যান্ট সার্জনকে বন্দির অসুস্থতা সম্পর্কে জানাবেন। এরপর অ্যাসিসট্যান্ট সার্জন সঙ্গে সঙ্গে বন্দির ওয়ার্ড ভিজিট করবেন। বন্দির অবস্থা বুঝে তাকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করার কথাও বলা হয়েছে ১৮৬৪ সালের জেলকোডে। এ বিষয়ে তিনি জেলার এবং মেডিক্যাল অফিসারের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারেন। বাংলাদেশের জেলখানায় এ নিয়মগুলো মানা হয় না বলে অনেকের অভিযোগ।
বর্তমান সরকারের আমলে কারাগারে থাকা অবস্থায় মৃত্যুর ঘটনা একের পর এক ঘটেই চলেছে বলে দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিশেষ করে বিরোধী বা ভিন্নমতের মানুষের ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটছে। এর দায় অবশ্যই সরকারকেই নিতে হবে। বলেন, কারাগারে মৃত্যুর ঘটনা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যক্তিগত রেশ মেটানোর হাতিয়ার হয়ে উঠেছে দেশের আইন। আইনের সাথে জড়িত কর্তাব্যক্তিরা এর অপব্যবহারের পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য হাসিলের রেওয়াজ প্রচলিত। কারাগারে বন্দিকে কেন নির্যাতন করা হয়েছে এবিষয়ে আসামিদের তদন্ত করলে অনেক কিছুই বেরিয়ে আসবে। কদিন আগে বন্দিকে নারীসঙ্গের ব্যবস্থা করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল কেন্দ্রীয় কারাগারের কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। এখন অমানবিকভাবে বন্দিকে নির্যাতনের অভিযোগ এলো। এ থেকে দেশের কারাগারগুলোর এক ভয়ানকতম চিত্র উঠে আসে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। তারা এর সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে আসামিদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯১৮
আপনার মতামত জানানঃ