মুখ ঢেকে যাওয়া বিজ্ঞাপনের এই যুগে কখনো কি ভেবেছেন কবে থেকে এই বিজ্ঞাপনের সূত্রপাত? বিজ্ঞাপনের ইতিহাসটাই-বা কেমন? চলুন জানা যাক। এই ইতিহাসে আছে বরাবরের মত চীনাদের অবদান। চীনের ইনান শহর থেকেই সেই অর্থে খৃষ্টপূর্ব সাতশত বছর আগে বিজ্ঞাপনের শুরু। ‘লিউ ফ্যামিলি নিডেল শপ’ ব্রোঞ্জের প্লেটে খোদাই করে বিজ্ঞাপন প্রচার করে সর্বপ্রথম।
ওই বিজ্ঞাপনের ভাষা বর্তমান সময়ের বিজ্ঞাপনের ভাষার সাথে মিল রয়েছে। ওই সূচের বিজ্ঞাপনে ছিলো– “We buy high quality steel rods and make fine quality needles, to be ready for use at home in no time”
এতো-এতো বছর পেরিয়ে এসেও বিজ্ঞাপনের ভাষার কী খুব পরিবর্তন হয়েছে? ১৪ শতকের পর ছাপাখানার আবিষ্কারের পর বিজ্ঞাপনে আসে প্রচারগত বিপুল বিস্তার। সাহিত্য, বইপত্র, গবেষণার কাজে কাগজ ও ছাপাখানার ব্যবহার বৃদ্ধি ঘটে সবিস্তারে।
কাগজের ব্যবহারে বিজ্ঞাপনেও গতি আসে, গ্রাহকের কাছে পৌঁছানোও অনেকটা সহজ হয়। পোস্টার দিয়ে বিজ্ঞাপনের সূত্রপাত ঠিক তখন থেকেই। ১৪৭৬-৭৭ সালের দিকে সর্বপ্রথম ইংরেজি ভাষায় Caxton Press বই বিপণনের জন্যে লন্ডনের চার্চ গুলোর দেয়ালে, ফটকে বিজ্ঞাপন দেন।
১৭ শতকের দিকে পত্রিকার জনপ্রিয়তা ইংল্যান্ডে বাড়তে থাকার সময়টাতে পত্রিকাকে বিজ্ঞাপনের প্রধান প্রচার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হতে থাকে। Bofton News-Letter পত্রিকায় জমি বিক্রির জন্য ক্রেতা আহ্বান পূর্বক বিজ্ঞাপন ছাপানো হয়। এটিই পত্রিকা ইতিহাসে সর্বপ্রথম বিজ্ঞাপন প্রচার।
প্রচার মাধ্যম হিসেবে পত্রিকার জয়জয়কারে প্রায় ১০০ বছর কাটে; এতে উল্লেখযোগ্য হিসেবে হ্যান্ডবিল, লিফলেট সংস্করণে বিজ্ঞাপন প্রচার হয়।
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের সময়কালে আমেরিকায় পত্রিকা বা ম্যাগাজিনে বিজ্ঞাপনের সুসময়ের সূত্রপাত। আমেরিকায় প্রথম প্রিন্টেড বিজ্ঞাপন তার ম্যাগাজিনে প্রকাশ পায়।
১৮৩০ সাল, বিজ্ঞাপনে আসে নতুন এক মাধ্যম-বিলবোর্ড। Jared Bell নামক আমেরিকান পেইন্টার ও ইলাস্ট্রেটর একটি ৫০ স্কয়ার ফিটের বিলবোর্ড আঁকেন, যা প্রথম বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ড।
সার্কাসের এই বিলবোর্ড বিজ্ঞাপনে লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন ইংরেজিতে “The greatest show on Earth” এই মটো লাইন ব্যবহার করা হয়েছিলো। পরিচিত লাগছে? হ্যাঁ আসন্ন ফুটবল বিশ্বকাপকেই “The greatest show on Earth” বলা হয়।
আমাদের কাছে টেলিভিশনে প্রথম বিজ্ঞাপন বলতে ১৯৬৪ তে প্রতিষ্ঠিত একমাত্র টিভি চ্যানেল পিটিভি বা বর্তমানে বিটিভি তে প্রচারিত বিজ্ঞাপন। ১৯৬৭ সালে সর্বপ্রথম প্রচারিত বিজ্ঞাপন হল ৭০৭ ডিটারজেন্ট সোপের বিজ্ঞাপন।
আমাদের এখানে ১৯৬৭-তে প্রথম টিভি বিজ্ঞাপন প্রচারিত হলেও বিশ্বে টিভিতে প্রথম বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয় ১৯৪১ সালে। NBC এর WNBC টিভি চ্যানেলে। The Brooklyn Dodgers এর প্রতিপক্ষ হয় Philadelphia Phillies, উক্ত ফুটবল ম্যাচের সময় সূচি প্রচার হয় একটি দেয়াল ঘড়িতে আর বর্ণনাতে একজন জানাতে থাকেন খেলা সম্পর্কে, যা ২০ সেকেন্ড ব্যাপী প্রচারিত হয়। এর মাধ্যমে সূত্রপাত ঘটে প্রথম টিভি কমার্শিয়াল বিজ্ঞাপনের। Bulova Watch Co. উক্ত বিজ্ঞাপনের জন্য অর্থ সংস্থাপন করে, বিজ্ঞাপনটি তৈরি ও প্রচারে খরচ হয় সর্বমোট ৯ ডলার, বর্তমানে বিজ্ঞাপন তৈরিতে সেই অঙ্ক আমাদের দেশেই লাখে এসে পৌঁছেছে।
বিজ্ঞাপনের জন্য সবচেয়ে নতুন-তম মাধ্যম হলো ইন্টারনেট। সবচেয়ে আধুনিক মাধ্যম এই ইন্টারনেট বিজ্ঞাপনকে সবার পকেট অবধি পৌঁছে দিয়েছে।
১৯৯৪ সালকে ইন্টারনেট জগতে বিজ্ঞাপন প্রচারের সূত্রপাত ধরা হয়। hotwire.com প্রথম ad banner এর মধ্যদিয়ে বিজ্ঞাপনের সূচনা করে। বিজ্ঞাপন প্রচারে ইতিহাসের সর্বশেষ সংযোজন হল সোশাল মিডিয়া সাইট গুলোতে বিজ্ঞাপনের বিস্তার।
এখন প্রায় সব ওয়েব সাইটেই কিছুটা জায়গা বরাদ্দ থাকে বিজ্ঞাপনের জন্য, আপনি যখন এই আর্টিকেলটি পড়ছেন তখনও হয়তো লিখাটির আশেপাশে বিজ্ঞাপন রয়েছে।
এরপর ১৮৪২ সাল Wolnui B. Palmer প্রতিষ্ঠা করেন পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞাপনী সংস্থা। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞাপনী সংস্থার অনুমোদিত বিজ্ঞাপনসমূহ তৎকালীন আমেরিকা ও কানাডার গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকায় প্রকাশিত হত।
১৮৬৪ সালে প্রথম ফ্রান্সিস আইরের বিজ্ঞাপনী সংস্থা N.W.Ayer & Son বিজ্ঞাপনদাতা ও বিজ্ঞাপন প্রকাশকদের মধ্যে মধ্যস্থতা করার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ নির্ধারণ করেন। সেই সময় থেকেই বিজ্ঞাপনী সংস্থার আর্থিক সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রচলিত হয়ে আসছে।
ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলায় বিজ্ঞাপন কবে থেকে আকার নিয়েছে? প্রথম বাংলা হরফে বিজ্ঞাপন ছাপা হয় ১৭৭৮ সালে “Calcutta Chronicle” ইংরেজি পত্রিকায়। বিজ্ঞাপনটি ছিলো ‘বাংলা ব্যাকরণ’ বিষয়ক একটি বইয়ের। প্রকাশ করেন পঞ্চানন কর্মকার।
পত্রিকার বিজ্ঞাপন ছাড়া বিজ্ঞাপনের অন্যকোন মাধ্যম আজ আর সংরক্ষিত নেই, তবে দিনকে দিন পরিবর্তন এসেছে বিজ্ঞাপনী ভাষায়, যুক্ত হয়েছে স্থির চিত্রের।
১৮৫০ সালের দিকে ভারতীয় উপমহাদেশে চায়ের চাষ শুরু করে ব্রিটিশ সরকার। সম্পূর্ণ নতুন এই পানীয়কে পরিচিত করে তুলতে বিজ্ঞাপন অনেক বেশী ফলপ্রসূ অবদান রাখে। বিজ্ঞাপনী পোস্টার ছাপায় চা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো, তাতে চায়ের প্রস্তুত প্রণালী থেকে শুরু করে চায়ের উপকারিতা সম্পর্কে সবিস্তারে জানানো হত।
‘অসম চা কোম্পানি’ আনুষ্ঠানিকভাবে চায়ের বিজ্ঞাপন প্রচার করে এই উপমহাদেশে। বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে গ্রাহকের কাছে চায়ের প্রয়োজনীয়তা কেমন তা তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিল সে সমস্ত বিজ্ঞাপন, বর্তমানের চায়ের জনপ্রিয়তা তাই প্রমাণ করে।
এসডব্লিউ/এসএস/২১৩০
আপনার মতামত জানানঃ