বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্যাতনে হাজতি জহিরুল হাওলাদারের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। গত রোববার(১৩ মার্চ) বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। মেহেন্দিগঞ্জের চরফেনুয়া এলাকার বারেক হাওলাদারের ছেলে জহিরুল একই এলাকার দেলোয়ার হোসেন হাওলাদার হত্যা মামলার ১২নং আসামি ছিল।
এদিকে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকা হত্যা মামলার এক হাজতির মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। একই সঙ্গে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
জানা যায়, গত রোববার(১৩ মার্চ) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কারাগারে জহিরুল হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করে। এরপর তাকে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। কিন্তু তার মৃত্যুকে অস্বাভাবিক বলে দাবি করেছেন স্বজনরা।
তারা বলেন, ২৩ বছরের একটি ছেলে হঠাৎ করে মারা যেতে পারে না। তাকে নির্যাতন করা হয়েছে।
তবে পুলিশ বলছে-এ অভিযোগ পুরোপুরি ভিত্তিহীন। হাসপাতাল ও কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত মৃত্যুর সঠিক কারণ বলা সম্ভব নয়।
জহিরুলের বড়ভাই আলী আকবর জানান, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার ভাই জড়িত ছিল না। এরপরও পিবিআইয়ের সদস্যরা তাকে গ্রেপ্তার করে ব্যাপক মারধর করে। ৪-৫ দিন আগে কারাগারে জোর করে তার ঘাড়ে ইনজেকশন দিয়েছিল কয়েকজন। এ খবর জেল থেকে ফোন করে সে আমাদের জানিয়েছিল। রোববার সকালে কারাগার থেকে ফোন দিয়ে জহিরুলের মৃত্যুর খবর জানানো হয়।
আলী আকবর আরও বলেন, জহিরুলের যে বয়স তাতে যেভাবে মৃত্যুর কথা বলা হচ্ছে— সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাকে অমানবিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই।
ভগ্নিপতি মোহাম্মদ জুয়েল বলেন, কোনো সময় কোনো অপরাধের সঙ্গেই জহিরুল জড়িত ছিল না। হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে একটি গ্রুপ আর নিরপরাধ লোকজনকে আসামি করা হয়েছে। তিনি বলেন, পরিকল্পিতভাবে জহিরুলকে হত্যা করা হয়েছে।
বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের অ্যাম্বুলেন্স চালক আবদুল হাই বলেন, সকালে গাড়িতে ওঠানোর সময় জহিরুলের মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছিল। মনে হয় কারাগারেই তার মৃত্যু হয়। কারাগারের ডেপুটি জেলার আল মামুন খান বলেন, জহিরুল বেশ কয়েকদিন ধরে অসুস্থ ছিল।
সিনিয়র জেলসুপার প্রশান্ত কুমার বণিক বলেন, কারাগারে ওই হাজতি কোনো হামলার শিকার হয়নি বা নির্যাতিত হয়নি। এমনটা হওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। আগে তাকে নির্যাতন করা হয়েছে কিনা বিষয়টিও আমাদের নজরে আসেনি। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচএম সাইফুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালে আসার আগেই ওই হাজতির মৃত্যু হয়েছে।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) বরিশাল অঞ্চলের পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির বলেন, তিন মাসে আগে জহিরুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। মেডিকেল ফিটনেস দেখিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়েছে এমন অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই।
জহিরুলের যে বয়স তাতে যেভাবে মৃত্যুর কথা বলা হচ্ছে— সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাকে অমানবিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই।
২০২১ সালের ৬ মে মেহেন্দিগঞ্জের চরফেনুয়ায় মাটিকাটা নিয়ে সংঘর্ষে কৃষক দেলোয়ার হোসেন হাওলাদার নিহত হন। এ ঘটনায় ১৪ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত ১০ জনের বিরুদ্ধে মেহেন্দিগঞ্জ থানায় মামলা হয়। এ হত্যা মামলার ১২ নম্বর আসামি ছিলেন জহিরুল। গত বছর ডিসেম্বরের প্রথম দিকে জহিরুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি তাকে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয়।
এদিকে আজ মঙ্গলবার মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ)প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুলতানা কামাল স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত রোববার সকালে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের হাজতি জহিরুল হাওলাদার (২৩) হঠাৎ করে বুকে ব্যথা অনুভব করেন। পরে বরিশাল শের–ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। কারা হেফাজতে জহিরুল হাওলাদারের মৃত্যুকে অস্বাভাবিক দাবি করে স্বজনেরা বলেছেন, অমানবিক নির্যাতন করে কারা অভ্যন্তরে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের চরফেনুয়ায় একটি হত্যা মামলার অভিযোগের ১২ নম্বর আসামি হিসেবে জহিরুল হাওলাদারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। গত ১২ জানুয়ারি থেকে তিনি বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন। জহিরুলের বড় ভাই মোহাম্মদ আলী আকবর বলেছেন, জহিরুল হাওলাদার কোনোভাবেই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। ঢাকায় তার স্ক্রিনপ্রিন্টের দোকান রয়েছে। তিনি ঢাকা থেকে বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন।
পিবিআইয়ের লোকজন জহিরুল হাওলাদারকে গ্রেপ্তার করে আদালতে উপস্থিত না করে তাকে মারধর করে। এরপর থেকে জহিরুল অসুস্থ ছিলেন। চার–পাঁচ দিন আগে জহিরুল তাঁদের ফোন করে জানিয়েছিলেন, কারাগারের মধ্যে কিছু লোকজন জোর করে তার ঘাড়ে ইনজেকশন দিয়েছিল।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে মৃত হাজতি কারাগারে নির্যাতিত হননি। তবে এমএসএফের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এমনটি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, প্রকাশিত সংবাদ বলা হয়েছে, বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের অ্যাম্বুলেন্সচালক মোহাম্মদ আবদুল হাই জানিয়েছেন, ওই দিন সকালে হাজতিকে গাড়িতে ওঠানোর সময় তার মুখ থেকে ফেনা বের হচ্ছিল। তিনি কারাগারেই মারা গেছেন। শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক এইচ এম সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, হাজতি জহিরুল হাওলাদারকে হাসপাতালে নিয়ে আসার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ছাড়া মৃত্যুর কারণ বলা যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চললেও এটির উন্নতিতে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো কাজ হয়নি। চিকিৎসক এবং অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রীর অপ্রতুলতার কারণে কারাগারে এর আগেও বন্দি মারা গিয়েছে।
তারা বলেন, ১৮৯৪ সালের প্রিজন অ্যাক্টের ১৩ ধারা মতে, একজন বন্দির পূর্ণ চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। একজন মেডিক্যাল অফিসার প্রতি ২৪ ঘণ্টা অন্তর বন্দিদের শারীরিক পরীক্ষা ছাড়াও তাদের নানা অসুস্থতা সম্পর্কে জানার কথা। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে যে, বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে বিষয়টি সর্বক্ষেত্রে মানা হয় না। এদিকে ১৮৬৪ সালের জেলকোড বন্দিদের চিকিত্সা পাওয়ার ক্ষেত্রে দারুণ ব্যবস্থা রেখেছে।
এ বিধান অনুযায়ী, কোনো বন্দি অসুস্থ হলে প্রহরীরা সঙ্গে সঙ্গে হেড ওয়াড্রেনকে জানানোর কথা রয়েছে। তিনি সাব-অ্যাসিসট্যান্ট সার্জনকে বন্দির অসুস্থতা সম্পর্কে জানাবেন। এরপর অ্যাসিসট্যান্ট সার্জন সঙ্গে সঙ্গে বন্দির ওয়ার্ড ভিজিট করবেন। বন্দির অবস্থা বুঝে তাকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করার কথাও বলা হয়েছে ১৮৬৪ সালের জেলকোডে। এ বিষয়ে তিনি জেলার এবং মেডিক্যাল অফিসারের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারেন। বাংলাদেশের জেলখানায় এ নিয়মগুলো মানা হয় না বলে অনেকের অভিযোগ।
বর্তমান সরকারের আমলে কারাগারে থাকা অবস্থায় মৃত্যুর ঘটনা একের পর এক ঘটেই চলেছে বলে দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিশেষ করে বিরোধী বা ভিন্নমতের মানুষের ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটছে। এর দায় অবশ্যই সরকারকেই নিতে হবে। বলেন, কারাগারে মৃত্যুর ঘটনা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যক্তিগত রেশ মেটানোর হাতিয়ার হয়ে উঠেছে দেশের আইন। আইনের সাথে জড়িত কর্তাব্যক্তিরা এর অপব্যবহারের পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য হাসিলের রেওয়াজ প্রচলিত। কারাগারে বন্দিকে কেন নির্যাতন করা হয়েছে এবিষয়ে আসামিদের তদন্ত করলে অনেক কিছুই বেরিয়ে আসবে। কদিন আগে বন্দিকে নারীসঙ্গের ব্যবস্থা করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল কেন্দ্রীয় কারাগারের কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। এখন অমানবিকভাবে বন্দিকে নির্যাতনের অভিযোগ এলো। এ থেকে দেশের কারাগারগুলোর এক ভয়ানকতম চিত্র উঠে আসে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। তারা এর সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে আসামিদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৩২
আপনার মতামত জানানঃ