২০০২ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে বিএনপির শাসনামলে ৪৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্ত হয়েছেন। কিন্তু সেই সময় ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন-২০০২’ অনুসরণ করা হয়নি বলে অভিযোগ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের। সরকার এখন এই ৪৪ হাজারের সঙ্গে এর পরে ২০১৪ সাল অবধি গেজেটভুক্ত আরো ১১ হাজারসহ মোট ৫৫ হাজার গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার তথ্য পুনরায় যাচাই-বাছাইয়ের উদ্যোগ নিয়েছে।
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) পরামর্শ অনুযায়ী এই যাচাই-বাছাই সম্পন্ন হবে উপজেলা পর্যায়ে। সংশ্লিষ্ট প্রতিটি এ জন্য ৪ সদস্যের যাচাই-বাছাই কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। স্থানীয় এমপি মুক্তিযোদ্ধা হলে তিনিই হবেন এই কমিটির প্রধান। তা না হলে জামুকার চেয়ারম্যান মনোনীত একজন মুক্তিযোদ্ধা এ কমিটির প্রধান হবেন। তবে যাচাই কমিটির প্রধান হতে হলে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা হলে চলবে না। তার নাম থাকতে হবে ভারতীয় তালিকায়। নিদেনপক্ষে লাল মুক্তিবার্তায় নাম থাকতে হবে কিংবা হতে হবে যুদ্ধকালীন কমান্ডার পদমর্যাদার।
উপজেলা পর্যায়ে কমিটির সদস্য সচিব হবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি ছুটিতে থাকলে সহকারী কমিশনার (ভূমি) দায়িত্ব পালন করবেন। শহর অঞ্চলে কমিটি হবে নগরভিত্তিক। মহানগর কমিটির সভাপতি হবেন সংশ্লিষ্ট মহানগর এলাকায় যুদ্ধকালীন কমান্ডার বা ভারতীয় তালিকা বা লাল মুক্তিবার্তায় অন্তর্ভুক্ত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, যাকে মনোনয়ন দেবেন জামুকার চেয়ারম্যান। উভয় পর্যায়ে কমিটির সদস্য হবেন দু’জন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সদস্য সচিব হবেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি)।
৩ ডিসেম্বর ২০২০, অনুষ্ঠিত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) সভায় যাচাই-বাছাই সংক্রান্ত একটি নীতিমালা অনুমোদন দেয়া হয়। সেই নীতিমালায় এ বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের কাছে এসব তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের মহাপরিচালক জহুরুল ইসলাম রোহেল। তিনি বলেন, ‘২০০২ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বিধিবহির্ভূতভাবে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্ত হয়েছেন। তাদের সনদ যাচাই-বাছাইয়ে সংশ্লিষ্ট উপজেলায় ৪ সদস্যের কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি নীতিমালা অনুমোদন করেছে জামুকা। অমুক্তিযোদ্ধাদের শনাক্ত করে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণ এবং প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সঠিক ও নির্ভুল তালিকা প্রণয়নের উদ্দশ্যেই এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’
সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, যুদ্ধে অংশহ্রহণের তথ্য প্রমাণের দায় সংশ্লিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাকেই নিতে হবে। যে বীর মুক্তিযোদ্ধারা যাচাই কমিটির কাছে নিজেদের সপক্ষে তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারবেন, তাদের গেজেট বহাল থাকবে। অন্যথায় গেজেট সনদ বাতিলের পাশাপাশি ভাতাও বন্ধ হবে। বাড়তি কোনো পদক্ষেপ নেয়া হবে কিনা, প্রতারণার অভিযোগ আনা কিংবা এরকম কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপের দিকে যাওয়া যাবে কিনা সে বিষয়টিও পরখ করে দেখা হচ্ছে। বিএনপি আমলের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বরতদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করার কথা ভাবা হচ্ছে বটে, তবে সরকার আগে যাচাই-বাছাইয়ের ফল হাতে পেতে চায়।
জামুকার এক কর্মকর্তা জানান, দেশের ভেতরে প্রশিক্ষণ নেয়া মুক্তিযোদ্ধাকে অবশ্যই পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধ করার সপক্ষে তিনজন সহযোদ্ধার (ভারতে প্রশিক্ষণ নেয়া) সাক্ষ্য জোগাড় করতে হবে। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বরের পর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করা হবে না। যাচাই-বাছাইয়ের জন্য গঠিত এ কমিটি সংশ্লিষ্ট বীর মুক্তিযোদ্ধার বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারের কাছে সুপারিশ করবে।
স্বাধীনতার ৪৯ বছর পার হয়ে গেছে। এতদিনেও মুক্তিযোদ্ধার তালিকা চূড়ান্ত হয়নি। ফলে এখনো নতুন নতুন মুক্তিযোদ্ধার হদিশ মিলছে এবং তারা গেজেটভুক্তও হচ্ছেন। এ মুহূর্তে গেজেটভুক্তদের সংখ্যা কম-বেশি ২ লাখ ৩১ হাজার ৩৮৫। এর মধ্যে ভাতা পাচ্ছেন ১ লাখ ৮৭ হাজার ২৯৩ জন। তাদের প্রত্যেককে প্রতি মাসে ১২ হাজার টাকা করে সম্মানী ভাতা দেয়া হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নিয়মিত এই পরিমাণ অর্থ মোটেই ফেলনা নয়।
জানা যায়, এই যাচাই-বাছাই আওতার বাইরে থাকবেন বেশকিছু ক্যাটাগরির মুক্তিযোদ্ধা। এর মধ্যে ভারতের দেয়া মুক্তিযোদ্ধার সব তালিকা, কল্যাণ ট্রাস্ট কর্তৃক প্রণীত শহীদ বেসামরিক গেজেট এবং সশস্ত্র বাহিনী শহীদ গেজেটে যাদের নাম আছে, তারা এর বাইরে থাকবেন। এছাড়া বিজিবির শহীদ গেজেট, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার গেজেট, খেতাবপ্রাপ্তদের গেজেট, মুজিবনগর, বিসিএস ধারণাগত জ্যেষ্ঠতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বিসিএস, সেনা, বিমান, নৌ, নৌ-কমান্ডো, পুলিশ, আনসার, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন গেরিলা বাহিনী, স্বাধীন বাংলা বেতার শব্দসৈনিক, বীরাঙ্গনা, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের মুক্তিযোদ্ধারা এর মধ্যে পড়বে না।
এসডাব্লিউ/এসএন/আরা/১২১৫
আপনার মতামত জানানঃ