ভারতের পাঁচ রাজ্যের এ নির্বাচনকে বলা হচ্ছে ‘মেগা নির্বাচন’ বা ‘সেমিফাইনাল’। কারণ, আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে এর চেয়ে বড় নির্বাচন আর নেই।
তাই দেশের পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে সবার নজর ছিল উত্তরপ্রদেশের দিকে। সকাল থেকেই ট্রেন্ড অনুযায়ী দেখা যায় যোগী সরকার আরও একবার ক্ষমতায় ফিরে আসতে চলেছে এবং যত বেলা বেড়েছে সেই অনুমান তত স্পষ্ট হয়েছে। এবার রেকর্ড জয় পেয়েছে উত্তরপ্রদেশে বিজেপি। পাশাপাশি ভোটও বেড়েছে তাদের।
উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকারের বিরুদ্ধে শক্তিশালী বিরোধী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি। আশা জাগিয়েও শেষ পর্যন্ত সমাজবাদী পার্টি হতাশ করেছে।
ভোটের আগপর্যন্ত জনপ্রিয় ধারণা ছিল, কোভিডের ছোবল, ব্যাপক কৃষক বিক্ষোভ, অভূতপূর্ব বেকারত্ব, মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষত্রীয়বাদী প্রশাসনজনিত অসন্তোষ এবং বিরোধীদের জাতভিত্তিক জোটবদ্ধতা উত্তর প্রদেশে শাসক বিজেপিকে ভাসিয়ে দেবে। ক্ষমতায় আসবে সমাজবাদী পার্টি ও তাদের জোট শরিকেরা। সাত দফা ভোট পর্বের শেষ দিনে বুথফেরত জরিপ জনপ্রিয় ধারণায় প্রথম যে ধাক্কা দিয়েছিল, বৃহস্পতিবার তা বিস্ময়করভাবে সত্য হলো। প্রতিশ্রুতি পালনে অন্যথা না হলে দীর্ঘ ৬২ বছর পর দেখা যাবে, টানা পাঁচ বছর শাসনের পর কেউ উপর্যুপরি দ্বিতীয়বার উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিচ্ছেন।
যোগী আদিত্যনাথ হতে চলেছেন সেই বিরল রাজনীতিক, উত্তর প্রদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গোবিন্দবল্লভ পন্থ ও সম্পূর্ণানন্দর পর যিনি পরপর দুবার মুখ্যমন্ত্রিত্ব লাভ করবেন। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৪ সালের মধ্যে পন্থ দুবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। আর সম্পূর্ণানন্দ ১৯৫৪ থেকে ১৯৬০ মধ্যে। দুজনই ছিলেন কংগ্রেসের অবিসংবাদিত নেতা। সেই কংগ্রেস, ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত যে দল উত্তর প্রদেশ দাপিয়ে বেরিয়েছে, দীর্ঘ ৩২ বছর তারা রাজ্যে ক্ষমতাহীন শুধু নয়, এবারের ভোটে আরও ক্ষয়ে গিয়ে দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো দৃশ্যমানতা হারিয়েছে। দেশের প্রাচীনতম দলের রাহুর দশা অব্যাহত।
ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তর প্রদেশে (ইউপি) বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করছে বিজেপি। বহুকাল পর ইউপিতে একই দল দ্বিতীয়বার সরকার গড়ছে। উত্তরাখণ্ড, মণিপুর ও গোয়াতেও নিজেদের সরকার ধরে রেখে বিজেপি বুঝিয়ে দিয়েছে নির্বাচনী লড়াইয়ে কংগ্রেস তাদের থেকে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। নিজেদের দখলে থাকা পাঞ্জাবেও হার স্বীকার করতে হয়েছে কংগ্রেসকে। সেখানে সরকার গড়ছে আম আদমি পার্টি। দিল্লির পর এবার পাঞ্জাবেও অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আপ সরকার গড়ছে। এটাও রেকর্ড। আগে কোনো আঞ্চলিক দলই একাধিক রাজ্যে সরকার গড়তে পারেনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা ৫ রাজ্যের বিধানসভা ভোটকে ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের সেমিফাইনাল বলছিলেন। সেই সেমিফাইনালে কিন্তু নিজেদের জয়ের ধারা অব্যাহত রেখে বিজেপি বুঝিয়ে দিল, তাদের কোনো বিকল্প আপাতত নেই। কংগ্রেস বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারেনি ৫ রাজ্যেই। নিজেদের অন্তর্কোন্দলে পাঞ্জাবও হারিয়েছে তারা। ইউপি-তে প্রচারাভিযানে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদরা টেক্কা দিলেও ফলাফলে পরাজয় হয়েছে কংগ্রেসের। কোনও প্রভাবই পড়েনি প্রিয়াঙ্কার প্রচারে।
রাহুল গান্ধীর মতোই তার বোনও ভোটপ্রচারে চূড়ান্ত ব্যর্থ, এমনটাই বলছেন সাধারণ মানুষ। ইউপি-তে বিজেপির জয়ের পেছনে অনেকেই বলছেন হিন্দুত্ব বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু বিভাজনের রাজনীতির বিপরীতে অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি (সপা) মানুষের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ। উত্তরাখণ্ডে বিজেপির নির্বাচনী মেশিনারির কাছে দুর্বল লেগেছে কংগ্রেসকে। মণিপুর ও গোয়াতে গতবার জিতেও সরকার গড়তে তারা ব্যর্থ হয়েছিল। এবার দুই রাজ্যেই পরাস্ত কংগ্রেস। ভোটের ফলাফলে কংগ্রেসের অস্তিত্ব আরও বিপন্ন। দলের বর্ষীয়ান নেতা অভিষেক মনু সিঙ্ভির মতে, কংগ্রেসকে ঢেলে সাজাতে হবে। আনতে হবে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব।
অন্যদিকে, বিজেপি শিবিরের দাবি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উন্নয়ন কর্মসূচির বিপরীতে কংগ্রেসের পরিবারতন্ত্র ফের পরাস্ত হয়েছে। অন্যদিকে, দিল্লির বাইরে পাঞ্জাবেও নিজেদের জয় ছিনিয়ে নিয়ে আপ-এর দাবি, এবার কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে তারাই উঠে আসবেন। দলের নেতা রাঘব চাড্ডার দাবি, অরবিন্দ কেজরিওয়ালই হবেন দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।
ক্ষমতাসীন বিজেপির এ জয়ের পেছনে সম্ভব্য কিছু কারণ বৃহস্পতিবার জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
উত্তরপ্রদেশ আবারও যোগীর’ শিরোনামে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সেখানে নির্বাচনের ফলাফলের প্রবণতা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট- উত্তরপ্রদেশে লড়াই হয়েছে সরাসরি বিজেপি ও সমাজবাদী পার্টির মধ্যে।
প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর কংগ্রেস এবং মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি উত্তরপ্রদেশে এ বিধানসভা নির্বাচনে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। তারা নিতান্তই শক্তিহীন হয়ে পড়েছে।
উত্তরপ্রদেশের ইতিহাসে সাধারণত কেউ পরপর দুইবার মুখ্যমন্ত্রী হন না। যোগী হলে সম্ভবত দ্বিতীয়বার এ ঘটনা ঘটবে।
উত্তরপ্রদেশের ইতিহাসে সাধারণত কেউ পরপর দুইবার মুখ্যমন্ত্রী হন না। যোগী হলে সম্ভবত দ্বিতীয়বার এ ঘটনা ঘটবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, উত্তরপ্রদেশে এবার যোগীই ছিলেন বিজেপির মুখ। মোদী নন। তাকে সামনে রেখেই ভোটে গিয়েছিল বিজেপি। আর অনিবার্যভাবে যোগী প্রচারপর্বে হিন্দুত্বের প্রসঙ্গ তুলেছেন। বিভাজনের চেষ্টা করেছেন। মন্দির-মসজিদ প্রসঙ্গ তুলেছেন, সেই সঙ্গে ৮০-২০-র কাহিনি শুনিয়েছেন। ৮০ শতাংশ হিন্দু ও ২০ শতাংশ মুসলিমকে বিভাজনের কাহিনি। তিনি বারবার অযোধ্যায় রামমন্দির, মথুরায় কৃষ্ণজন্মভূমি ও কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের করিডোরকে প্রচারে সামনে এনেছেন।
ফলাফল প্রকাশের পর দেখা যাচ্ছে, যোগীর ৮০-২০-এর কৌশল সফল হয়েছে। বিজেপিকে পঞ্চাশটির মতো আসন হারাতে হলেও তারা সমাজবাদীর পার্টির থেকে প্রায় দেড়শ আসনে এগিয়ে আছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, উত্তরপ্রদেশে পরপর দ্বিতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর যোগীর রাজনৈতিক উচ্চতা বাড়তে বাধ্য। সারা ভারতেই তিনি হিন্দুত্বের মুখ হিসেবে আরও অনেক সামনে আসবেন বলে বিজেপি নেতারাই মনে করছেন।
স্বরাজ পার্টির নেতা ও সাবেক ভোটবিশেষজ্ঞ যোগেন্দ্র যাদব এনডিটিভিকে বলেন, সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক বিষয় হলো, কিছুদিন আগেই করোনাকালে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছেন। অক্সিজেন না পেয়ে মারা গেছেন। গঙ্গা দিয়ে একের পর এক শব ভেসে এসেছে। তারপরও মানুষ মনে করছে, মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে যোগী ভালো কাজ করছেন এবং তারই থাকা উচিত।
উত্তরপ্রদেশ ভোটপর্ব ঘুরে দেখার সময় মনে হয়েছে, দুটি বিষয় বিজেপিকে সাহায্য করছে। দরিদ্রদের বিনা পয়সায় প্রতি মাসে চাল, গম, তেল, ছোলা, নুন দেয়া এবং স্থানীয় স্তরে গুণ্ডামি বন্ধ করা। তাতে পুলিশরাজের অভিযোগ উঠলেও সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে ছিলেন।
অখিলেশের ভোট পাওয়ার হার গতবারের তুলনায় অনেক বেড়েছে। গতবার তার দল পেয়েছিল প্রায় ২২ শতাংশ ভোট। এবার তাদের ভোট পাওয়ার হার গিয়ে পৌঁছেছে ৩৪ শতাংশে। বিজেপিও তাদের ভোটের হার চার শতাংশ বাড়াতে পেরেছে।
তারা এবার প্রায় ৪৫ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পেয়েছে। ভোটপ্রাপ্তির হারে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মায়াবতীর দল। তারা গতবার ভোটের হারে দ্বিতীয় স্থানে ছিল। এবার তাদের ভোট পাওয়ার হার অর্ধেক হয়েছে।
এ হিসাব থেকেই স্পষ্ট, গতবারের তুলনায় অখিলেশ অনেক ভালো ফল করেছেন। কিন্তু বিজেপির কাছাকাছি তিনি পৌঁছতে পারেননি।
উত্তরপ্রদেশের এই ফলাফল বিজেপিকে নিঃসন্দেহে স্বস্তি দেবে। কারণ, পশ্চিমবঙ্গে হার, করোনাকালের কঠিন সময়, অর্থনীতির বেহাল অবস্থার পর উত্তরপ্রদেশ হাতছাড়া হলে সেটা হতো মোদি-শাহের কাছে বড় ধাক্কা। কিন্তু কঠিন সময়ে এ জয়ের ফলে তারা রাজনৈতিক দিক থেকে আবার অন্যদের অনেক পিছনে ফেলে দেবেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কংগ্রেসমুক্ত ভারত গঠনের কথা মোদী প্রথম দিন থেকেই বলে আসছেন। নেহরুবাদী রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠায় তিনি কাজ করছেন সাড়ে সাত বছর ধরে। এবারের ভোট সেই লক্ষ্যে আরও এক বিরাট পদক্ষেপ। মোদির কাছে এই সাফল্য আরও গরিমার কারণ। ক্ষমতায় থাকার যাবতীয় প্রাতিষ্ঠানিক বিড়ম্বনা পাশ কাটিয়ে জয়ের ধ্বজা কীভাবে পতপত করে উড়িয়ে রাখা যায়, তার প্রমাণ তিনি রাখলেন। পাঁচ রাজ্যের এই ভোট ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে সেমিফাইনাল বলে বিবেচিত হচ্ছিল। বলতেই হবে, বিজেপি যতটা সসম্মানে উত্তীর্ণ, প্রতিষ্ঠিত বিরোধীরা ততটাই ভূলুণ্ঠিত।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯১৬
আপনার মতামত জানানঃ