ক্যাম্পে অবস্থানরত অনিশ্চিত জীবনেও থেমে নেই রোহিঙ্গা নারীদের সন্তান নেওয়ার প্রবণতা। গত সাড়ে চার বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় দুই লাখ শিশু জন্মলাভ করেছে। অশিক্ষিত রোহিঙ্গারা ধর্মের দোহাই দিয়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণে অনাগ্রহী। বেশি সন্তান জন্মদানের শারীরিকভাবে ক্ষতিকর বুঝলেও তারা তা মানছেন না। একইসঙ্গে রোহিঙ্গাদের মধ্যে বাড়ছে একাধিক বিয়ে করার প্রবণতাও।
কক্সবাজারের উখিয়া টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন ১১৫ থেকে ১২০ জন শিশু জন্ম নিচ্ছে বলে একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপ রিপোর্টে বলা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিয়েছে।
ক্যাম্পের পরিস্থিতি
ক্যাম্পে অধিকাংশ পুরুষ রোহিঙ্গার একাধিক স্ত্রী রয়েছে। তারা সন্তান জন্মদানকে আল্লাহর দান বলে মনে করেন। যেকোনো ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণেও রয়েছে তাদের চরম অবহেলা।
ক্যাম্পের নারীরাও কিছু ধর্মীয় কথাবার্তাকে পুঁজি করে বেশি সন্তান নিতে আগ্রহী। খুব প্রয়োজন না হলে রোহিঙ্গা নারীরা চিকিৎসা ও সেবা কেন্দ্রে যান না। এছাড়া রোহিঙ্গা নারীরা মনে করেন, স্বামী ছেড়ে গেলেও সন্তান বেশি থাকায় ক্যাম্পে রেশনিং কার্ডে ত্রাণসামগ্রী বেশি পাবেন।
কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের ইউনিসেফ সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গত ৫৪ মাসে প্রায় ২ লাখ শিশুর জন্ম হয়েছে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর এখন হিসাব অনুযায়ী নতুন এবং পুরোনো রোহিঙ্গা এবং এ দেশে জন্ম নেওয়া শিশুসহ রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ।
প্রতি বছর গড়ে জন্ম নিচ্ছে ৩৯ হাজার ৪৩৮ শিশু। প্রতি বছর গর্ভবতী নারীর সংখ্যা প্রায় ৪২-৪৩ হাজার। এক থেকে চার বছরের শিশুর সংখ্যা এক লাখ ৭৪ হাজার প্রায়।
যা বলছেন রোহিঙ্গারা
উখিয়ার বালু খালি ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নারী রোকেয়া বেগমের বয়স মাত্র ২৫ বছর। এর মধ্যেই তিনি ছয় সন্তানের জননী। এ ছাড়া বর্তমানে তিনি পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে জন্ম দিয়েছেন তিন সন্তানের। সন্তান বেশি হওয়ায় এখন নাকি তার সংসারে তেমন অভাব নেই। কারণ ছেলেরাও আয়-রোজগার করছে। তবে এই ছোট্ট ঘরে সবাইকে নিয়ে থাকতে খুব কষ্ট হয়।
আরো সন্তান নেওয়ার ইচ্ছে আছে কি না জানতে চাইলে প্রথমে কথা বলতে লজ্জাবোধ করলেও পরে রোকেয়া বলেন, আল্লাহ চাইলে ও তার স্বামীর ইচ্ছে থাকলে ছেলে মেয়ে বেশি হলে দোষ কি। তবে ক্যাম্পে এসে এখন চিকিৎসা কেন্দ্রে গিয়ে নিজের শরীর ও জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনেছি।
পার্শ্ববর্তী ক্যাম্পের আরেক নারী তৈয়বা খাতুন। বয়স ২৩। তিনি পাঁচ সন্তানের জননী। চেহারা রোগাক্রান্ত, দেখেই বোঝা যাচ্ছিল অসুস্থ শরীর, চরম পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। তিনি আবারো ছয় মাসের গর্ভবতী।
তিনি জানান, স্বামীর আদেশ মানতে গিয়ে নাকি তার আজ এ অবস্থা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনেক নারী জন্মনিয়ন্ত্রণের সামগ্রী নিজেরা ব্যবহার না করে অন্যত্র বিক্রি করে দেন বলেও জানান তিনি।
রোকেয়া তৈয়বার মতো এমন হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী রয়েছেন উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে। যাদের সন্তান সংখ্যা পাঁচের বেশি, কারো বা ৯-১০ জন। এসব নারীর সন্তানরাও পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। তবে সন্তানদের শারীরিক গঠন নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা এই রোহিঙ্গারা সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে অপ্রতিরোধ্য। কুতুপালং ১৬নং ক্যাম্পে রোহিঙ্গা নেতা আবুল কালাম জানান, তার স্ত্রী রয়েছেন দু’জন। প্রথমটি মিয়ানমারে, দ্বিতীয়টি এ দেশে এসে বিয়ে করেছেন। দুই সংসারে রয়েছে ৯ সন্তান। তার বড় মেয়ে রশিদা বেগমকে অন্য একটি ক্যাম্পে বিয়ে দিয়েছেন। তারও রয়েছে দুই সন্তান।
তিনি আরো জানান, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাকে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারের মধ্যে বিশ্বাস রয়েছে তারা একসময় বিশাল একটি জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে। মূলত এ বিশ্বাস থেকেই তারা কম বয়সের কিশোরীদের বিয়ে দিয়ে থাকেন।
অনেক পুরুষ রোহিঙ্গা আবার একাধিক বিয়ে করে সন্তান সংখ্যা বাড়িয়ে চলছেন। তাই প্রতি বছর রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে সদস্য সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এছাড়া এ দেশে এসে রোহিঙ্গারা সংসারে সদস্য সংখ্যা যত বেশি থাকবে, তত বেশি সরকারি, বেসরকারি ত্রাণ বা রেশন সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে বলে জানান তিনি।
সংশ্লিষ্টদের মতামত
টেকনাফ ২১ নম্বর ক্যাম্পের চাকমারকুল মেডিকেল ক্যাম্পে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মী উন্মে কুলসুম বলেন, রোহিঙ্গা নারীদের মধ্যে সন্তান জন্মদানের প্রবণতা অনেক বেশি। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে পরিবার পরিকল্পনা সম্বন্ধে কোনো ধরনের সচেতনতা পায়নি। সন্তান সম্ভবা অনেক রোহিঙ্গা নারী এখনো হাসপাতালমুখী নয়। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হলেও তারা নিজেদের ছোট্ট বাড়িতেই সন্তান জন্মদানে আগ্রহী।
কক্সবাজার পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের উপ-পরিচালক ডা. পিন্টু কান্তি ভট্টাচার্য বলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণে রোহিঙ্গা নারীদের বিষয়টি বোঝানোর জন্য পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর, স্বাস্থ্য বিভাগ ও এনজিওগুলো কাজ করছে। তাছাড়া আমরা রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে অধিক সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরছি।
অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছুদ্দোজা বলেন, জন্মহার বাড়ছে, তবে নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ ও নেয়া হয়েছে । ক্যাম্পে দায়িত্বরত সংস্থাগুলোকে এ ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত চার বছরে রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৪ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। বাড়ছে অস্থিরতা। এভাবে আগামী ১০ বছর পর কক্সবাজার জেলার মোট জনসংখ্যার সমান হবে রোহিঙ্গারা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৫৫
আপনার মতামত জানানঃ