নগর সভ্যতার ডামাডোলে গোটা বিশ্ব এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যেখানে প্রাণ ধারণের জন্য ন্যূনতম বিশুদ্ধ আলো, বাতাস ও পানির মতো প্রকৃতির অফুরান দানগুলো অবশিষ্ট থাকার সুযোগ নেই। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে নানা বিরূপ প্রভাবসহ মানবসৃষ্ট পরিবেশ দূষণের কবলে পড়ে ক্রমেই হুমকির মুখে এগিয়ে চলছে জনজীবন। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও দ্রুত শিল্পায়নের এই অশুভ প্রতিযোগিতার করাল গ্রাসে পড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে, লাগামহীনভাবে বেড়ে চলছে দূষণ। প্রতি বছর বিশ্বে বায়ুদূষণের কারণে অন্তত ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়৷
বিশ্বের বায়ুদূষণের সবচেয়ে বড় উৎস বা হটস্পট হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়া। এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ ঘটছে বাংলাদেশে। ঢাকাসহ বড় শহরের বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার পাশাপাশি ক্ষতিকর গ্যাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। বাতাসে এসব বাড়ছেও দ্রুত। ফলে নগরবাসীর জন্য তা দীর্ঘমেয়াদি বিপদ বাড়াচ্ছে, তৈরি করছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি। গত বছর বিশ্বব্যাংক থেকে করা দক্ষিণ এশিয়ার বায়ুদূষণ নিয়ে করা গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
‘ফিজিকস অ্যান্ড কেমিস্ট্রি অব দ্য আর্থ’ শীর্ষক বিজ্ঞান সাময়িকীতে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম, যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. সরফরাজ গনি আদনান, লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতুন এ জান্নাত এতে জড়িত ছিলেন। গবেষণায় নেতৃত্ব দেন অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক গবেষক আশরাফ দেওয়ান। এ ছাড়া অস্ট্রিয়াভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যাপ্লাইড সিস্টেম অ্যানালাইসিস গবেষণার একটি অংশে কাজ করেছে।
গবেষণায় বায়ুদূষণ নিয়ে নতুন এক বিপদের কথা বলা হয়েছে। ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোতে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড গ্যাস বেড়ে যেতে দেখা গেছে। জনসংখ্যা ও যানবাহন চলাচল বেশি এবং বেশি সংখ্যায় উন্নয়ন প্রকল্প চলছে—এমন এলাকাগুলোতে এ গ্যাস বাড়ছে। এত দিন ঢাকার বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা পিএম ২.৫ ও পিএম ১০-এর পরিমাণ বেড়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ ছিল। এসব বস্তুকণার পাশাপাশি এই গ্যাস বাতাসকে আরও বিষাক্ত করে তুলছে।
বিশ্বের বায়ুদূষণের সবচেয়ে বড় উৎস বা হটস্পট হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়া। এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ ঘটছে বাংলাদেশে।
বাতাসে দূষণ সৃষ্টিকারী গ্যাসীয় পদার্থের মধ্যে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড অন্যতম। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া, আউটলেট ছাড়া প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার, কেরোসিন, তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দহন, তামাক, বজ্রপাত এবং কাঠ পোড়ানোর কারণে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এই গ্যাসীয় পদার্থ তৈরি হয়। এটি হৃদ্রোগ, ফুসফুসের ক্যানসার এবং অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের রোগের কারণ হতে পারে।
২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ১২ মাসের নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড দূষণ পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। তথ্য সংগ্রহের জন্য ট্রপোমি নামে একটি ভূ-উপগ্রহের সহায়তা নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে মাঠপর্যায়েও দূষণ পরিমাপ করা হয়।
দুভাবে প্রাপ্ত উপাত্ত তুলনা করে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ মাসে দূষণের তীব্রতা বেশি থাকে। এর মধ্যে দূষণের মাত্রা প্রকট আকার ধারণ করে নভেম্বরে। শীত মৌসুমে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ও মুন্সিগঞ্জে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড সবচেয়ে বেশি ছিল। এ জেলাগুলো মূলত শিল্পপ্রধান।
গবেষণায় দেখা গেছে, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যখন ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম ছিল, সে সময় দূষণ সর্বোচ্চ ছিল। বর্ষা মৌসুমে সাধারণত বৃষ্টিপাতের প্রভাবে দূষণের মাত্রা কম থাকে। যেসব শহর এলাকায় ঘন গাছপালা রয়েছে, সেখানে দূষণের পরিমাণ কম ছিল।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বায়ুমান গবেষক সরফরাজ গনি আদনান বলেন, যেসব স্থানে এ ধরনের দূষণ রয়েছে, সেখানকার অধিবাসীদের মাস্ক ব্যবহার করা উচিত। এ জন্য প্রচার-প্রচারণা চালানো যেতে পারে। বেশি দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর বাড়তি কর আরোপ করা যেতে পারে। আর সামগ্রিকভাবে শহর ও শিল্পাঞ্চলগুলোকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।
রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা বিপজ্জনক পর্যায়ে অবস্থান করছে। বিশ্বে শীর্ষ দূষিত কয়েকটি শহরের অন্যতম ঢাকার মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর সর্বাধিক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। মানুষের গড় আয়ু কমছে দীর্ঘমেয়াদী বায়ুদূষণের কারণে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু সবচেয়ে বেশি কমেছে। চীন, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মিয়ানমার ও ভুটানের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুষ্কাল বায়ুদূষণের কারণে বেশি কমছে।
বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে মানুষের আয়ু গড়ে তিন বছর কমছে। বায়ুদূষণ নিয়ে এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ‘বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০২০: বায়ুদূষণ কীভাবে সারা বিশ্বে আয়ুষ্কালকে প্রভাবিত করে’ শিরোনামের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণে বিশ্বে প্রতিবছর ৭০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু হয়। বায়ুদূষণের বর্তমান (২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী) মাত্রা বিশ্বে মানুষের গড় আয়ুষ্কাল ১ বছর ৮ মাস কমিয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মানুষের আয়ুষ্কালের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এসব দেশে অনেকে উচ্চমাত্রার বাহ্যিক (আউটডোর) ও অভ্যন্তরীণ (ইনডোর) বায়ুদূষণের দ্বিগুণ ভোগান্তির শিকার হয়।
এদিকে সাম্প্রতিক একটি গবেষণা জানিয়েছে, বায়ুদূষণের ফলে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের হৃৎপিণ্ড, বেড়ে যাচ্ছে উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগ। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কিডনির নানা জটিল অসুখও।
গবেষকরা দেখেছেন, দীর্ঘদিন ধরে কিডনির অসুখে ভুগছেন এমন প্রাপ্তবয়স্কদের উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে সঙ্গে গ্যালেক্টিন প্রোটিনের পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে বায়ুদূষণের মাত্রাবৃদ্ধির কারণে। এই গ্যালেক্টিন প্রোটিনের পরিমাণ দেহে বাড়লেই হৃৎপিণ্ডে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। আর সেই ক্ষত কিছুতেই সারিয়ে তোলা সম্ভব হয় না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় যার নাম ‘মায়োকার্ডিয়াল ফাইব্রোসিস’।
মূল গবেষক যুক্তরাষ্ট্রের কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক হাফসা তারিক বলেছেন, ‘যখনই আমাদের হৃদযন্ত্রে ফাইব্রোব্লাস্ট নামে একটি বিশেষ ধরনের কোষ কোলাজেন তৈরি করতে শুরু করে, তখনই হয় মায়োকার্ডিয়াল ফাইব্রোসিস। তার ফলে নানা ধরনের হৃদরোগ হয়। ডেকে আনে মৃত্যু।’
গবেষকরা দেখেছেন, বাতাসে বিশেষ ধরনের দূষণ কণার (পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫) পরিমাণ বাড়লেই এটা হচ্ছে। সেই কণা বাতাসে কম থাকলে বা একেবারে না থাকলে কিডনি, হৃৎপিণ্ডের ততটা ক্ষতি হচ্ছে না। খুব ক্ষতি হচ্ছে কিডনিরও। গবেষকরা দুবছর ধরে প্রায় দেড় হাজার রোগীর উপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালিয়ে এই ঘটনা ঘটতে দেখেছেন।
বায়ুদূষণ সব দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। তবে এটি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় চরম ঝুঁকি তৈরি করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য দেয়া হয়েছে৷
ডব্লিউএইচও’র মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতার কারণে তৈরি হচ্ছে মারত্মক বায়ুদূষণ। এর ফলে ফুসফুস হৃদযন্ত্র ও শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বস্তুকণা, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডসহ অন্যান্য দূষণ তৈরিকারী উপাদানের উপস্থিতি কমাতে হবে।
সংস্থাটির মতে, বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি বায়ুদূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য অন্যতম পরিবেশগত হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে ডব্লিউএইচওর প্রধান তেদ্রোস আধানম গেব্রেয়াসুস বলেন, ‘বায়ুদূষণ সব দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। তবে এটি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় চরম ঝুঁকি তৈরি করেছে।’
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি নগরায়ন ও শিল্পায়নের হার বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। অনুষঙ্গ হিসেবে পরিবেশ দূষণ বিশেষ করে বায়ুদূষণের মাত্রাও বেড়েছে বহুগুণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, পৃথিবীর শতকরা প্রায় ৯১ ভাগ মানুষ সংস্থাটির নির্ধারিত মান মাত্রার নির্মল বায়ু সেবন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এছাড়া প্রতি বছর বায়ুদূষণের জন্য বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বায়ুদূষণ প্রকট আকার ধারণ করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরবাসীর কাছে যানজটের পাশাপাশি আরেক যন্ত্রণার নাম বায়ুদূষণ। মাত্রাতিরিক্ত দূষণের কবলে নগরজীবন বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে। বাড়িয়ে তুলছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশু, বৃদ্ধ ও শ্বাসতন্ত্রের রোগীরা।
প্রতিনিয়ত বায়ুদূষণে ফুসফুসের অক্সিজেন গ্রহণক্ষমতা কমে শ্বাসকষ্ট ক্রমাগত বাড়ে বলে জানান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, প্রথমে শ্বাসনালি ও চোখে সমস্যা তৈরি করে। ফলে অ্যাজমা ও নিউমোনিয়ার রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে এ দূষিত বায়ু গ্রহণ ব্রঙ্কাইটিস থেকে ফুসফুস ক্যান্সারের কারণ হতে পারে বলে উল্লেখ করেন। এদিকে বায়ুদূষণের কারণে ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) বেশি দেখা দেয় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
এ জন্য বায়ুদূষণের সঙ্গে মানুষের গড় আয়ুর বিষয়টি জড়িত। আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে কিন্তু সেটা কতটা মানসম্মত সেটাও খতিয়ে দেখা উচিত। আমাদের জীবদ্দশায় কতটা সময় হাসপাতালে কাটাতে হয়, সেটাও হিসাব করা উচিত বলে জানান তারা।
নির্মল বায়ুর জন্য স্থায়ী কোনো নীতি যেটি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে পারে, সেটা গড় আয়ু বাড়ানোর পাশাপাশি জলবায়ুর ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তারা এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে চীনকে উল্লেখ করে বলেছেন, ২০১১ সালের তারা যে নীতি গ্রহণ করেছে, তাতে তাদের গড় আয়ু বেড়েছে ২.৬ বছর।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১১৪৪
আপনার মতামত জানানঃ