১৬,৪০০ টনের জলদানব সাবমেরিন K-141 Kursk ছিল তৎকালীন বিশ্বের সেরা সাবমেরিনগুলোর মধ্যে একটি। দুটো নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরের সাহায্যে এটি পানির উপরে সর্বোচ্চ ৩০ কি.মি. ও পানির নিচে সর্বোচ্চ ৫৯ কি.মি. গতিতে ছুটতে পারত। ৮ মিলিমিটার স্টিল প্লেটের উপর ৮০ মিলিমিটার রাবার প্যাড দ্বারা কভার থাকায় কুরস্ক যেমন রাডার-সোনারে ধরা পড়া কষ্টসাধ্য ছিল, তেমনি শত্রুর একটিমাত্র টর্পেডো হামলায় একে ডোবান অসম্ভব ছিল। এই কুরস্কেই ঘটেছিল রাশিয়ার ইতিহাসের সবথেকে বড় দুর্ঘটনা।
২০০০ সালের ১০ আগস্ট রাশিয়ান নৌবাহিনী একটি বড় ধরনের নৌমহড়ার আয়োজন করে। এক্সারসাইজ সামার-এক্স নামের এই মহড়ায় ৩০টি যুদ্ধজাহাজ, ৪টি সাবমেরিনসহ একাধিক ছোট ছোট জাহাজ অংশ নেয়। কুরস্ক কিছুদিন আগেই নর্দান ফ্লিটের সেরা সাবমেরিন হিসেবে পুরস্কার পেয়েছিল।
উক্ত অনুশীলনে এটি ‘ফুল কমব্যাট লোড’ তথা যুদ্ধাবস্থার ন্যায় সত্যিকারের অস্ত্র বহনের অনুমতি পেয়েছিল যা রাশান নৌবাহিনীর গুটিকয়েক সাবমেরিনের ছিল। সাধারণত শান্তির সময়ে সাবমেরিন বা যুদ্ধজাহাজগুলো তার সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতার অস্ত্র বহন করে না। অন্যদিকে অনুশীলনে বিস্ফোরকবিহীন ডামি মিসাইল/টর্পেডো সাধারণত ফায়ার করা হয়। কুরস্ককে সত্যিকারের অস্ত্র বহনের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। আর অনুশীলনে সেটিই কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য।
সত্যিকারের যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টির জন্য কুরস্ক তার প্রতি আরোপিত নির্দেশ অনুযায়ী রেডিও যোগাযোগ বন্ধ করে সাগরে ডুব দেয়। অনুশীলনের অংশ হিসবে তাকে খুঁজতে শুরু করে অন্যান্য জাহাজ। কিন্তু তাদের ফাঁকি দিয়ে নির্ধারিত পয়েন্টে পৌঁছে টার্গেটের উদ্দেশ্যে ডামি মিসাইল ফায়ার করে।
প্রথম মিশন সফল হওয়ার পর সাবমেরিনটি এবার নর্দান ফ্লিটের ফ্ল্যাগশিপকে ধাওয়া শুরু করে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী ব্যাটলক্রুজার ‘পিটার দ্য গ্রেট’ এর উদ্দেশ্যে ডামি টর্পেডো ফায়ারের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল কুরস্ককে। এতে কোনো বিস্ফোরক ওয়ারহেড ছিল না। ফলে নর্দান ফ্লিটের ফ্ল্যাগশিপ আক্রান্ত হলেও কোনো ক্ষতি হবে না। আধুনিক নৌবাহিনীগুলো এভাবেই সত্যিকারের যুদ্ধ অনুশীলন সম্পন্ন করে থাকে।
পরিকল্পনা মোতাবেক ১২ আগস্ট, ২০০০ সালে সাবমেরিন কুরস্ক ব্যারেন্টস সাগরের তলায় তার সুবিধাজনক স্থানে পজিশন নেয়। আগেই বলা হয়েছে যে এতে ‘টাইপ ৬৫’ নামক টর্পেডো ব্যবহার করা হতো যা তাত্ত্বিকভাবে সিঙ্গেল শটে ৫০-১০০ কি.মি. দূর থেকে মার্কিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ডোবানোর মতো শক্তিশালী ছিল।
এতে কনভেনশনাল (৫৫৭ কেজি) বা নিউক্লিয়ার (২০ কিলোটন)– দু’ধরনের ওয়ারহেড (বিস্ফোরক) নেয়ার সুবিধা ছিল। অনুশীলনে যেটি ফায়ারের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল তাতে কোনো ওয়ারহেড না থাকলেও সেটি নিজেই ছিল দুর্ঘটনার কারণ।
টাইপ ৬৫ টর্পেডো পানির নিচে অকল্পনীয় গতিতে (ঘণ্টায় ৯৩ কি.মি.) ছুটতে পারত। এজন্য এতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ও কেরোসিনকে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ১৯৫৫ সালে একটি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ এ ধরনের টর্পেডো ফায়ারের সময় দুর্ঘটনায় পড়ার পর বিশ্বের অন্যান্য দেশ হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের ব্যবহার বাদ দিয়ে ব্যাটারিচালিত ইলেকট্রিক মোটর ব্যবহার শুরু করে। কিন্তু রুশ নৌবাহিনী সেটি করেনি। উল্টো অনুশীলনে ফায়ার করা হবে বিধায় এতে নিম্নমানের ফুয়েল ব্যবহার করা হয়। ক্রুটিপূর্ণ ওয়েল্ডিংয়ের কারণে ফুয়েল লিক ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয় টের পেয়ে একজন ক্রু তার সিনিয়র অফিসারকে জানান। কিন্তু এজন্য কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
সকাল ১১:২৮ মিনিটে যখন টর্পেডো ফায়ারের জন্য অ্যাক্টিভেট করা হয়, তখন এটি টিউবের ভেতরই বিস্ফোরিত হয়। ৫০ মিটার দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে টিউবের বাইরের দিকের হ্যাচডোর। তদন্তকারীদের ধারণা, এই বিস্ফোরণের ধ্বংসক্ষমতা ১০০-২৫০ কেজি টিএনটির সমতুল্য ছিল। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ১.৫।
সাবমেরিনটি তখন ৩৫৪ ফুট পানির নিচে ছিল। বিস্ফোরণে সামনের টর্পেডো রুমে আগুন ধরে যায়। তদন্তে এই বিস্ফোরণের তাপমাত্রা ২,৭০০ ডিগ্রি ছিল বলে জানা যায়। ফলে ধারণা করা হয়, প্রথম কম্পার্টমেন্ট তথা টর্পেডো রুমের সবাই বিস্ফোরণের সাথে সাথে নিহত হন। এয়ার কন্ডিশনিং ভেন্টের সাহায্যে চতুর্থ কম্পার্টমেন্ট পর্যন্ত আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
কুরস্কের স্বয়ংক্রিয় অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা সাথে সাথেই চালু হলেও সব মিলিয়ে প্রথম ধাক্কায় আনুমানিক ৩৬ জন মারা যায়। ততক্ষণে অচল হয়ে পড়েছে সাবমেরিনের মেইন কমান্ড সেন্টার। সেকেন্ডে প্রায় ৯০ হাজার লিটার করে পানি ঢুকতে শুরু করেছে একাধিক কম্পার্টমেন্টে! নিয়মানুযায়ী নাবিকরা সেগুলোর হ্যাচডোর লকডাউনসহ পারমাণবিক বিপর্যয় এড়াতে নিউক্লিয়ার রিয়াক্টরও শাটডাউন করে দেয়।
সাবমেরিনে তখন ইমারজেন্সি জেনারেটরের সাহায্যে পাওয়ার সাপ্লাই করা হচ্ছিল। প্রথম বিস্ফোরণের ঠিক ১৩৫ সেকেন্ড পর দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। সত্যিকারের ওয়ারহেডযুক্ত পাঁচ থেকে সাতটি টর্পেডো একযোগে বিস্ফোরিত হয়ে সাবমেরিনের ভেতরটি বিদীর্ণ করে দেয়। এতে ২২ বর্গ ফুটের বিশাল গর্ত সৃষ্টি হয়।
তদন্তকারীদের ধারণা, এই বিস্ফোরণের ধ্বংসক্ষমতা তিন হাজার থেকে সাত হাজার কেজি টিএনটির সমতুল্য ছিল! এতে তিনটি কম্পার্টমেন্ট পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়, সাথে সাথে মারা যায় আনুমানিক ২৩ জন।
প্রথম বিস্ফোরণের পরপরই ‘রেসকিউ বয়া’ রিলিজ করা হয়। সাধারণত দুর্ঘটনা কবলিত সাবমেরিনের অবস্থান জানানোর জন্য বিশেষ ধরনের সিগন্যাল বয়া ছাড়া হয় যা পানির উপরে এসে ক্রমাগত জিপিএস সিগন্যাল দিতে থাকে। কুরস্কের এই সুবিধা থাকার পরও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেটি সময়মতো কাজ করেনি। ফ্ল্যাগশিপ পিটার দ্য গ্রেটের উপর নির্ধারিত সময়ে টর্পেডো আক্রমণ না হওয়ায় এবং নির্দিষ্ট সময় পরও কুরস্ক রেডিও যোগাযোগ না করায় রাশিয়ান নৌবাহিনী দেশটির ভূকম্পনবিদদের কথায় কান দেয়া শুরু করে।
কেননা ব্যারেন্টস সাগরের আশেপাশের একাধিক ইউরোপিয়ান ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ স্টেশন কুরস্কের জোরালো বিস্ফোরণ তাদের সিসমোগ্রাফ যন্ত্রে রেকর্ড করতে পেরেছিল (এ সংক্রান্ত বিস্তারিত আরেকটি আর্টিকেল পড়ুন Roar বাংলায়)। এমনকি সাড়ে চার হাজার কি.মি. দূরে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কার ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ সেন্টারও এই বিস্ফোরণ টের পেয়েছিল।
দ্বিতীয় বিস্ফোরণের ফলে সাগরের এই সামান্য গভীরতায় রিখটার স্কেলে ৪.২ মাত্রার ভূমিকম্পটির উৎপত্তি কেন্দ্র হওয়ার বিষয়টি খুবই অস্বাভাবিক। সবাই ধারণা করতে শুরু করে যে তাদের কোনো সাবমেরিন দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। মহড়া বাতিল করে পুরো রাশান নৌবাহিনী কুরস্ককে খুঁজে বের করতে উঠেপড়ে লাগে।
ব্যাপক খোঁজাখুঁজির পর দুর্ঘটনার ১৬ ঘণ্টার মাথায় সাগরের ৩৭৭ ফুট গভীরে কুরস্ককে খুঁজে পাওয়া যায়। ৯ নাম্বার কম্পার্টমেন্টের ভেতর থেকে ধাতব বস্তু দিয়ে মোর্স কোডের শব্দ উৎপন্ন করার মাধ্যমে জানান দিচ্ছে যে কয়েকজন নাবিক এখনো বেঁচে আছে! দ্বিতীয় এস্কেপ ক্যাপসুল সচল থাকলেও ‘ডিকম্প্রেশন’জনিত অসুস্থতার ভয়ে সেটি ব্যবহার করা তাদের পক্ষে তখন সম্ভব নয়। শুরু হয় উদ্ধারের আপ্রাণ প্রচেষ্টা।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে নরওয়ে ও ব্রিটেন সাহায্যের প্রস্তাব দেয়। দেশ দুটোর কাছে তৎকালীন সর্বাধুনিক সাবমেরিন রেসকিউ ভেসেল ছিল। কিন্তু রাশিয়ান নৌবাহিনী সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। তাদের কাছে দুটো ভেসেল ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আর্থিক সংকটে থাকা দেশটি একটি ভেসেল বিক্রি করে দিয়েছিল। অপরটি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্রুটিপূর্ণ ছিল যা সঠিকভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়। এদিকে গোপন তথ্য পাচারের আশঙ্কায় রুশ প্রশাসন প্রথমে বিদেশী নৌবাহিনীর সাহায্য নিতে চায়নি।
শেষপর্যন্ত নিজেদের অক্ষমতার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে নরওয়ের সাহায্য নেয়া হয়। ততক্ষণে ১১৮ জন নাবিকের সবাই মারা গেছে। ২১ আগস্ট নয় নাম্বার কম্পার্টমেন্টের ভেতর ২৪টি মৃতদেহ পাওয়া যায়। ক্যাপ্টেন দিমিত্রি কোলেসনিকভের লেখা দুর্ঘটনার পর বেঁচে যাওয়া নাবিকদের নাম লেখা একটি লিস্টও পাওয়া যায়। অর্থাৎ এই ২৪ জন রিজার্ভ অক্সিজেন শেষ হবার পর মারা গেছেন। পুরো রাশিয়া জুড়ে এই ঘটনা আলোড়ন সৃষ্টি করে। শুরু হয় পুতিন সরকারের তীব্র সমালোচনা। সময়মতো বিদেশী সাহায্য নিলে তারা হয়তো বেঁচে যেত।
তদন্তে আরো একটি মর্মান্তিক ঘটনার কথা জানা যায়। সাবমেরিন কুরস্কে ইমারজেন্সি অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের জন্য কেমিক্যাল জেনারেটর ব্যবহার করা হতো যার ফুয়েল ছিল পটাশিয়াম সুপারঅক্সাইড কার্টিজ। এটি রাসায়নিকভাবে অক্সিজেন ত্যাগ করে কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে। এই কার্টিজ নির্দিষ্ট সময় পরপর বদলে দিতে হতো। এই কার্টিজ পানির সংস্পর্শে আসলে প্রচন্ড দাহ্য পদার্থ হয়ে ওঠে। নয় নাম্বার কম্পার্টমেন্টের মেঝেতে কোমর পর্যন্ত পানি জমে ছিল। একজন ক্রু কার্টিজ বদলানোর সময় ভয়, পিপাসা ও ঠাণ্ডায় তালগোল পাকিয়ে হাত থেকে সেটি ফেলে দেয়। ফলে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন। এতে বেশ কয়েকজনের গায়ে আগুন ধরে যায়। বাকিরা বাঁচার জন্য পানিতে ডুব দেয়। আগুনে ক্রুদের তেমন শারীরিক ক্ষতি না হলেও তার চেয়ে বড় ক্ষতি ততক্ষণে হয়ে গেছে। আগুন ধরায় কম্পার্টমেন্টের অক্সিজেন লেভেল এক লাফে অনেকখানি কমে যায়। পোর্টেবল অক্সিজেন সাপ্লাই সিস্টেমের রিজার্ভও তখন প্রায় শেষের দিকে ছিল। এর কিছু সময় পরই সকল নাবিক একে একে মারা যান। ক্যাপ্টেন কোলেসনিকভের লেখা নোটে লেখা ছিল,
It’s dark here to write, but I’ll try by feel. It seems like there are no chances, 10–20%. Let’s hope that at least someone will read this. Here’s the list of personnel from the other sections, who are now in the ninth and will attempt to get out. Regards to everybody, no need to despair. Kolesnikov.
আপনার মতামত জানানঃ