দক্ষিণ আমেরিকার বিশাল এলাকাজুড়ে আমাজন বনাঞ্চল বিস্তৃত। এই বনভূমির বিশাল অংশ ব্রাজিলের মধ্যে পড়েছে এবং সেখানে বনের গাছ কেটে উজাড় করা হচ্ছে বলে দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ রয়েছে। এসব নিয়ে জলবায়ু সংকট পর্যালোচনায় বরাবরই সমালোচিত হয়ে আসছে ব্রাজিল। এবার নিজেদের তৈরী খাদেই যেন পড়ল ব্রাজিল। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে দেশটিতে ভয়াবহ বন্যা চলছে।
ভারী বৃষ্টির পর বন্যা ও ভূমিধসে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোর একটি পাহাড়ি পর্যটন শহরে স্থানীয় সময় গতকাল মঙ্গলবার অন্তত ১৮ জন মারা গেছেন। খবর এএফপির
রিও ডি জেনিরোর অগ্নিনির্বাপণ বিভাগ এক বিবৃতিতে বলেছে, সম্প্রতি কয়েক ঘণ্টায় বন্যা ও ভূমিধসে এখন পর্যন্ত ১৮ জনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত হওয়া গেছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, রিও শহরের ৬৮ কিলোমিটার উত্তরে ব্রাজিলের শেষ সম্রাট দ্বিতীয় পেদ্রোকে সমাধিস্থ করা মনোরম পাহাড়ি শহরে এই প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার কার্যক্রম চালানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের ১৮০ জনের বেশি কর্মী ঘটনাস্থলে রয়েছেন।
প্রতিদিন একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে আমাজনের অরণ্য। ব্রাজিলের আমাজনে গত ১৫ বছরের মধ্যে গত বছর সর্বোচ্চ পরিমাণ বন উজাড়ের ঘটনা ঘটেছে।
পৃথিবীর ফুসফুস হিসেবে পরিচিত ব্রাজিলের আমাজন বনে চলতি বছরের জানুয়ারিতে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় অনেক বেশি গাছ কাটা হয়েছে।
দেশটির সরকারি স্যাটেলাইটের তথ্যের বরাতে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
এতে বলা হয়, যে পরিমাণ এলাকার গাছ কাটা হয়েছে তা ২০২১ সালের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি। ২০১৫ সালে এ বিষয়ে তথ্য সংরক্ষণ করার পর থেকে জানুয়ারিতে এটিই বন উজাড়ের সর্বোচ্চ ঘটনা।
জানুয়ারিতে আমাজনের ৪৩০ বর্গকিলোমিটার বন উজাড় করা হয়েছে। যা নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের চেয়ে আয়তনে সাতগুণ বড়।
রিও শহরের ৬৮ কিলোমিটার উত্তরে ব্রাজিলের শেষ সম্রাট দ্বিতীয় পেদ্রোকে সমাধিস্থ করা মনোরম পাহাড়ি শহরে এই প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার কার্যক্রম চালানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের ১৮০ জনের বেশি কর্মী ঘটনাস্থলে রয়েছেন।
পরিবেশবাদীরা ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোকে বন উজাড় ত্বরান্বিত করার অনুমতি দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত করেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যদি আমরা জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে চাই তবে আমাজনকে রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ। গাছগুলো কাটা হয় মূলত কাঠ ও ফসল চাষের জন্য; আর উৎপাদিত ফসল চলে যায় বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, ব্রাজিলের মহাকাশ সংস্থা ইনপের সর্বশেষ উপগ্রহের তথ্য আবারও বন রক্ষায় দেশটির সরকারের প্রতিশ্রুতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
গ্রিনপিস ব্রাজিলের কর্মকর্তা ক্রিস্টিয়ান মাজেট্টি বলেন, নতুন তথ্যে আবারও প্রকাশ পেল কীভাবে সরকারের পদক্ষেপগুলো তার সবুজায়ন নিয়ে প্রচারণার সম্পূর্ণ বিপরীত।
এদিকে ব্রাজিলের সরকার বলছে, গত বছরের আগস্ট থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে সামগ্রিকভাবে কম বন উজাড় হয়েছে।
গত বছর গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত কপ২৬ সম্মেলনে ২০৩০ সালের মধ্যে বন উজাড় বন্ধে একশ’র বেশি দেশের সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেখানে প্রতিশ্রুতি দেওয়া বিশ্বেনেতাদের মধ্যে বলসোনারোও ছিলেন। কিন্তু প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বাস্তবে পরিস্থিতি আগের মতোই রয়ে গেছে।
পরিবেশবাদি সংগঠনগুলো বলছে, বলসোনারোর আমলেই খনন কাজ আর কৃষি জমি তৈরির জন্য বননিধন বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এই প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব তা নিয়ে সন্দিহান তারা।
জীবের জীবনধারণের জন্য অক্সিজেন যতটা জরুরি, পৃথিবীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ততটাই গুরুত্বপূর্ণ পৃথিবীর সব রেইনফরেস্ট। রেইনফরেস্ট পৃথিবীর ফুসফুস। এরা কেবল জল, বায়ু, খাদ্য আর ওষুধ উৎপাদনের উৎস নয়; হাজারো প্রাণিপ্রজাতির আশ্রয়দাতা। বায়ুমণ্ডল থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস শুষে নেওয়ার শক্তিশালী শোষক।
একুশ শতকের পরিবর্তিত জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব রুখে দিতে সে কারণেই কিংবদন্তি ভূমিকা রয়েছে রেইনফরেস্টগুলোর। এ জন্যই আমাজন অরণ্যের ধ্বংস নিয়ে সারা পৃথিবী উদ্বিগ্ন আজ।
বিশ শতক থেকে যেভাবে সারা বিশ্বে অরণ্যভূমি বিনষ্ট করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, অতীতে সেভাবে কোনো দিনও হয়নি। বরং প্রকৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা বজায় রেখে হাজার হাজার বছর ধরে অরণ্যবাসী মানুষ ও বন্য প্রাণী বসবাস করে এসেছে অরণ্যের অভ্যন্তরে। এরপর জনসংখ্যা যত বেড়েছে, জড়বিজ্ঞানের প্রবল প্রতাপ যত বেশি আকাশচুম্বী হয়েছে, ততই অরণ্য সভ্যতা বিলীন হয়ে গেছে পৃথিবী থেকে।
১৯৭০ সালে আমাজনের বনভূমি প্রথম ধাপে উজাড় হওয়া শুরু হয় যখন ব্রাজিলের সামরিক সরকার খেয়াল করে এই বনের ভেতর লুকিয়ে আছে বিশাল খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ এ বন থেকে ব্রাজিলের তৎকালীন সরকার অর্থনৈতিক উন্নতির অপার সম্ভাবনা দেখছিল। কিন্তু দুর্গম বনভূমির জন্য এগুলো সংগ্রহ করা অসম্ভব ছিল। তাই ব্রাজিলের সরকার আমাজনের ভেতর দিয়ে ৩,২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ট্রান্স-আমাজনিয়ান হাইওয়ে নির্মাণ করা শুরু করে যা আমাজনের গহীন অরণ্যে মানুষের প্রতিনিয়ত চলাচলের সূচনা করে।
ওই সময়ে ব্রাজিলের বেশিরভাগ মানুষ দক্ষিণ-পূর্বে রিও-ডি-জেনিরো, সাও পাওলোর মত শহরে থাকতো। ব্রাজিলের সরকার জমি চাষাবাদ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে জনগণকে আমাজনে স্থানান্তর করতে চেয়েছিল। এই লক্ষ্যে ব্রাজিলের সরকার এই হাইওয়ের পাশে বিনামূল্যে জমির বিতরণ করা শুরু করেছিল, এরই সাথে সাথে জনগণকে প্রণোদনা দেওয়াও শুরু হয়েছিল এখানে বসতি স্থাপনের জন্য। হাইওয়ে নির্মাণের সাথে সাথে তার চারপাশের বন উজাড়ের হারও ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। এসকল বেশিরভাগ জমিই গরুর খামার করার জন্য চারণভূমিতে রুপান্তরিত করা হয়। লাভবান ব্যবসা হওয়ায় চারণভূমি বাড়ানোর জন্য আমাজনের আরো গহীনে বনভূমি উজাড় করা শুরু হয়।
জড়বিজ্ঞান সভ্যতায় বছরের পর বছর ধরে সীমাহীন নগরায়ণের কারণে, শিল্পসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরির কাজে, আসবাবপত্র কিংবা জ্বালানির ব্যবহারে, কৃষিজমির অনুসন্ধানে এবং আরও হাজার রকমের নিষ্ঠুর অভিপ্রায় নিয়ে বিশাল বিস্তীর্ণ বনভূমিকে মানুষ নিঃশেষিত করেছে অপূরণীয় ক্ষতিতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ কথা অনস্বীকার্য যে, আমরা যদি টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করতে চাই কিংবা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রন করতে চাই, আচরণ এবং অভ্যাসগত পরিবর্তন আনার কোনো বিকল্প নেই। তবে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, আচরণ ও অভ্যাসগত পরিবর্তন প্রযুক্তি নির্ভর জ্বালানি ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত নীতিমালার পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু কখনোই তা প্রযুক্তি নির্ভর নীতিমালার বিকল্প নয়।
তারা বলেন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও তাপমাত্রা স্বভাবিক রাখতে বৃক্ষ রোপণ বৃদ্ধিতে মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। বনদস্যুদের হাত থেকে বনাঞ্চল রক্ষায় কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। অপরিকল্পিত বনাঞ্চল নিধনে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। উদ্যোগ নিতে হবে পরিবেশ ও উষ্ণতা স্বভাবিক রেখে পৃথিবীকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করে তুলতে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩৬
আপনার মতামত জানানঃ