ভারতের কর্নাটক রাজ্যে হাইস্কুল ও কলেজে মুসলিম মেযেদের হিজাব পরে ক্লাসে আসা নিষিদ্ধ করা, আর এ নিয়ে গেরুয়া স্কার্ফ-ধারী হিন্দুত্ববাদীদের সাথে সংঘাতকে কেন্দ্র করে হঠাৎ সারা দেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। কর্নাটক রাজ্যের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে বিক্ষোভ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোলকাতা শহরেও বুধবার শত শত শিক্ষার্থী হিজাব নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে মিছিল করেছে।
সাম্প্রতিক কয়েক বছরে সামাজিক মাধ্যমে মেয়েদের হয়রানি ও হেনস্তা করার ঘটনা খুবই বেড়ে গেছে। বিশেষ করে কোন নারী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বা তার ক্ষমতাসীন বিজেপি দল নিয়ে কোন সমালোচনামূলক মন্তব্য করলে তো কথাই নেই; তা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। অনলাইনে এবং মাঠেঘাটেও বিভাজনের চিত্র ক্রমশই প্রকট হয়ে উঠেছে সাম্প্রতিক সময়ে।
যদিও সব রাজনৈতিক দল এবং সব মতাদর্শের সমর্থকরাই নারীদের অনলাইনে হয়রানি করতে ছাড়েন না, কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চরম দক্ষিণপন্থীদের উত্থান এবং প্রযুক্তির প্রসার ভারতের তরুণ হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের বিদ্বেষের বিষ ছড়ানোর কাজে এখন সাহস যোগাচ্ছে।
হিন্দু মৌলবাদের রাজনৈতিক উত্থান
ইউটিউবে পাকিস্তানি নারীদের ছবি দিয়ে লাইভ অনুষ্ঠান করার পর অনলাইনে নারীদের হেনস্তা ও হয়রানির বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে।
দুটি অ্যাপ-এর উদ্ভাবকরা কিছুদিন আগে মুসলমান নারীদের অপমান করতে অ্যাপে বেশ কিছু মুসলিম নারীর ছবি শেয়ার করে বলে এদের “নিলামে” বিক্রি করা হচ্ছে। শুধু মুসলিম নারীরা নয়, ভিন্নমত পোষণ করা হিন্দু নারীরাও হয়রানির শিকার হন। তবে অন্য একটা অ্যাপে।
ক্লাবহাউস নামে একটি অডিও অ্যাপে মোদী এবং বিজেপির সমালোচক কিছু হিন্দু নারীর নাম তুলে দিয়ে বলা হয় এদের “কেনা” যাবে। ক্লাবহাউস জানায় তাদের অ্যাপে খোলা এই চ্যাটরুমের কার্যকলাপ তারা স্থগিত করে দেয় এবং যাদের অ্যাকাউন্ট এর সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়।
কোন অ্যাপেই প্রকৃত অর্থে কোন কেনাবেচা হয়নি। এগুলোর উদ্দেশ্য ছিল শুধু নারীদের হেনস্তা, অসম্মান ও অপমান করা, তাদের খাটো করা।
সুল্লি ডিল নামে মুসলিম নারীদের নিলামে বিক্রির দুটি অ্যাপ নিয়ে সাধারণ জনগণের তুমুল সমালোচনার পর অ্যাপ তৈরির সাথে জড়িত নয়জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃত সবার বয়স ১৮ থেকে ২৬-এর মধ্যে। সামাজিক মাধ্যমের যেসব সাইটে নিয়মিত ইসলাম-বিদ্বেষী পোস্ট দেয়া হয় এরা সবাই সেসব সাইটের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করত।
পুলিশ জানায়, ক্লাবহাউস নামে অ্যাপে ‘ভুয়া নিলামঘর’ খোলার সাথে এবং ইউটিউবে পাকিস্তানি নারীদের ছবি ব্যবহার করে লাইভ অনুষ্ঠান স্ট্রিম করার ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে পুলিশের নথিতে রিতেশ ঝায়ের নাম রয়েছে।
মুম্বাই পুলিশের সাইবারসেল বিভাগের প্রধান রাশমি কারানদিকার বলেন, আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি, এবং ঝা যদি তদন্তে হাজির না হন, আমরা তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনী ব্যবস্থা নেব।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন এগুলো কিন্তু বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সাংবাদিক ও লেখক স্নিগ্ধা পুনম বলেন, আমি বলব হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে হিন্দু মৌলবাদের যে বিশাল উত্থান হয়েছে এগুলো তারই বহিঃপ্রকাশ। এটা হিন্দু সমাজের একেবারে ভেতর থেকে উঠে আসা কট্টর ধর্মান্ধতা।
ঝা-র যে ইউটিউব চ্যানেল এখন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, তার ফলোয়ার ছিল হাজার হাজার মানুষ। ঝা-র শেয়ার করা মুসলিম-বিদ্বেষী কন্টেন্টগুলোতে তারাও অংশ নিতেন, যোগ দিতেন।
ঝা যুক্তি দিচ্ছেন, ইসলামী রীতিনীতি নিয়ে যেসব অবমাননাকর ব্যঙ্গবিদ্রূপ করা হতো তার সাইটে, সেগুলো “শুধু কড়া ধরনের ঠাট্টা তামাশা”। পাকিস্তানি নারীদের ছবি নিয়ে তার লাইভ অনুষ্ঠান নিয়ে তার উত্তর, ওগুলো তো “টিকটক বা ইনস্টারিল-এর নির্দোষ ভিডিওগুলোর মত”।
ঝা যখন প্রথম স্মার্টফোন হাতে পান, তখন তার বয়স ছিল ১৪। তিনি বলেন, সেসময় যেসব কন্টেন্ট তার কাছে আসতো, সেগুলোর হাত ধরেই দক্ষিণপন্থীদের জগতে তার প্রবেশ।
তিনি বলেন, সেখানে আমি মিম দেখেছি, রাজনীতিকদের বক্তৃতা শুনেছি। তারা জোর গলায় বলেছেন- হিন্দু ধর্ম বিপন্ন।
রাজনৈতিক দলগুলোর দলীয় নীতিভিত্তিক বিতর্ক আর মুসলমানদের দেশের শত্রু হিসাবে চিহ্ণিত করে বিষাক্ত কথাবার্তাগুলো তাকে ধীরে ধীরে “উগ্রপন্থী” হিন্দুতে পরিণত করেছে।
ঝা বলেন, এসব কথাবার্তা শুনতে শুনতে ভাবতে শুরু করেছি আমরা বৈষম্যের শিকার। এত গভীর বৈষম্য যে আমরা সহিংসতার পথ ধরার কথা ভেবেছি।
এধরনের কথাবার্তাই আরও অনেক তরুণের মনকে বিষিয়ে দিতে সক্ষম, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিভাজন এবং এই উগ্রপন্থা অবলম্বনের কারণ
ক্যানাডার ইনস্টিটিউট অফ স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগ নামে একটি সংস্থার জরিপ, যারা ভারতে দক্ষিণপন্থী উগ্রবাদীদের আচরণ নিয়ে গবেষণা করেছে, তারা জানাচ্ছে, উগ্রপন্থায় ঝোঁকার পথ আরও নিশ্চিত করেছে এই মহামারি। কারণ লক্ষ লক্ষ মানুষ অনলাইনে প্রচুর সময় কাটিয়েছে।
ভারতের দক্ষিণপন্থীদের চিন্তাধারায় কিছু পরিবর্তনও এসেছে। অনেকে বলছেন তাদের মধ্যে দুধরনের মত কাজ করছে। “ট্র্যাডস” আর “রায়তাস”।
ট্র্যাডস হল ট্র্যাডিশনাল-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। অর্থাৎ প্রথাগতভাবে যারা খুবই উগ্রবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী। যারা বিশ্বাস করে বিজেপি যথেষ্ট দক্ষিণপন্থী নয়। আবার দক্ষিণপন্থী মতাদর্শ নিয়ে প্রথাগতদের যারা সমালোচক, তাদের নাম দিয়েছে তারা “রায়তাস”। রায়তাসরা বলে তারা সহিংসতার পথ পরিহার করে তাদের মত প্রকাশ করতে পছন্দ করে।
দলিত সম্প্রদায়ের এক তরুণ, নিজের পরিচয় দিলেন ‘এইচআর’ এই নামে। এই নামে তিনি টুইট করেন। বিবিসিকে বললেন কীভাবে তিনি এই কড়া উগ্রপন্থী বা ট্র্যাডস হয়ে উঠলেন।
হিন্দু জাতপাতের দিক দিয়ে দলিতরা সমাজের নিচের তলার মানুষ। মার্চ ২০২০এ এই তরুণকে একটি ইনস্টাগ্রাম গ্রুপে যোগ দেবার আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই গোষ্ঠী জানায় তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে হিন্দুত্ববাদ নিয়ে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরা। যে ব্যক্তি তাকে আমন্ত্রণ জানান তিনি বলেন এইচআর অনলাইনে মুসলিমদের সাথে এত দারুণ বক্তৃতা করতে পারেন যা দেখে তিনি মুগ্ধ। ওই ব্যক্তি এইচআর-কে বলেন এই দলে ১৪-১৫ বছরের কিশোরদের নিয়ে আসতে।
এইচআর বলেন, তিনি হিন্দু হিসাবে “গৌরব” বোধ করেন এবং তিনি সানন্দে যোগ দেবেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। কারণ তিনি দেখেন অনলাইনের ওই গ্রুপে সদস্যরা শুধু মুসলমানদের উদ্দেশ্যেই নয়, দলিতদের প্রতিও ন্যক্কারজনক ঘৃণা ও বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য করছে।
“তারা বলে দলিতরা হিন্দু নয়। তারা বলে হিন্দু ভারত গড়ে তোলার জন্য মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করা যথার্থ এবং এমনকি শিশুহত্যাও যক্তিসম্মত।”
তিনি ওই গ্রুপের অন্য সদস্যদের জানাননি তিনি দলিত। গ্রুপে যোগ দেবার ছয় মাস পর তিনি গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যান। তিনি বলেন, তিনি এখন এই কড়া উগ্রপন্থী ট্র্যাডসদের বিরুদ্ধে লড়ছেন। সামাজিক মাধ্যম টুইটারে তারা যে নামে লেখেন সেই নামগুলো তিনি টু্ইটার কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেন।
বিশেষজ্ঞদের মত হল অনলাইনে অতিরিক্ত ট্রোলিংএর কারণ হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণির কট্টরপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়া
লেখিকা সানিয়া সাইদ, মুসলিম নারীদের নিলামে বিক্রির অ্যাপে তার ফটোও বিক্রির পণ্য হিসাবে আপলোড করা হয়েছিল, বলেন, “ট্র্যাডস বা অতি উগ্রপন্থীরা মুসলিম ও খ্রিস্টান বিরোধী। ক্রুদ্ধ জনতা অপরাধের বিচার করতে মানুষকে পেটালে বা হত্যা করলে তারা সেটার প্রশংসা করেন। তারা দমনমূলক জাতপাতের বৈষম্যে বিশ্বাস করেন, তারা আধুনিকমনস্ক স্পষ্টবক্তা নারীদের ঘৃণা করেন- সে তারা হিন্দু বা মুসলিম হোন।”
সাইদ বলছেন ট্র্যাডস গ্রুপগুলো প্রায়ই তাকে তাদের সাইটে যোগ করে দেয়, যাতে তাকে যারা হেনস্তা করছে তারা তার বিরুদ্ধে আপত্তিকর যেসব কথাবর্তা বলছে তা তিনি দেখতে পান।
দিল্লি পুলিশ বলছে যে ব্যক্তি নিলামের এই অ্যাপ সৃষ্টি করেছিল বলে অভিযোগ করা হয়ঢ, সেই ব্যক্তিও এই ট্র্যাডস দলের সদস্য।
এদিকে, মোনা শর্মা একজন ‘রায়তা’। তিনি বলছেন তিনি এবং তার মত অন্য ডানপন্থী নারীদেরও ট্র্যাডসরা অনলাইনে টার্গেট করে থাকে। কারণ নারীদের কীভাবে চলা উচিত সে বিষয়ে রায়তাদের সাথে তারা সহমত নয়।
শর্মা বলছেন তাকে অনলাইনে হয়রানি করা হয়েছে। তবে তিনি একথাও স্বীকার করেন যে তিনি নিজেও উদারপন্থীদের অনলাইনে হেনস্তা করেছেন। তারাও টু্ইটারে তাকে পাল্টা আক্রমণ করেছে। তিনি তিনি বলছেন অনলাইনে এধরনের কথা কাটাকাটি কারোর ক্ষতি করে না।
তিনি বলছেন, “ট্র্যাডসদের মতে আধুনিক শিক্ষিত নারীরা যথেষ্টভাবে হিন্দু নয়।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই সমস্যার শেকড় কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে ঘৃণা ছড়ানোর থেকেও অনেক বেশি গভীরে। হিন্দুদের মধ্যে উগ্রপন্থার উত্থান ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য বিশাল একটা হুমকি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫০৮
আপনার মতামত জানানঃ