সৃষ্টির শুরু থেকেই টিকে থাকা ব্যাপারটাই খুব বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষের কাছে। কালের গর্ভে অনেক শক্তিশালী প্রাণী হারিয়ে গিয়েছে আর তাদের মধ্যে নিজের ক্ষমতাবলে টিকে গিয়েছে মানুষ। সবসময় তাই যুদ্ধ করতে হয়েছে তাকে। নিজের সাথে, সবার সাথে, পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে।
ক্ষুধাবোধ এবং কোনোকিছু খাওয়া- এ দুটোই হলো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আর এই সহজাত প্রবৃত্তির কাছে হার মেনে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে মানুষের শরীরের মাংস কেটে খেতে বাধ্য হয়েছিলেন সহযাত্রীরা।
তিংগুইরিরিকা আগ্নেয়গিরির কারণে বরফাঞ্চল পরিণত হয়েছে খড়খড়ে সমভূমিতে। এই অঞ্চলের বর্তমান দুরবস্থা পরিবেশের কথা তো তুলে আনছেই। সেই সঙ্গে তুলে আনছে ৪৮ বছর আগে ঘটে যাওয়া একটি দুর্ঘটনার প্রসঙ্গও।
একটু পেছনে যাওয়া যাক। ১৯৭২ সালে উরুগুয়ে থেকে একটি চার্টার্ড প্লেন চিলির সান্তিয়াগোর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিল। প্লেনের নম্বর ছিল ৫৭১।
একটি রাগবি দলের ১৯ জন সদস্য, তাদের পরিবার, প্রিয়জন, ফ্যানরাও ছিল ওই প্লেনে। সব মিলিয়ে, মোট ৪৫ জন।
হঠাৎই যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে প্লেনটা ধাক্কা খায় আন্দিজ পর্বতের তিংগুইরিরিকা আগ্নেয়গিরির কাছেই একটি পাহাড়ে। দুটো ডানাই ভেঙে যায়।
সঙ্গে সঙ্গে তিনজন বিমানকর্মী-সহ বেশ কিছু যাত্রী মারা যান। বাকিরা ওখানেই আটকে থাকেন। এরপর শুরু হয় আসল ঘটনা।
এই দুর্ঘটনার দশ দিনের মাথায় ট্রানজিস্টর মারফৎ খবর আসে যে, তাদের উদ্ধার করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কিন্তু ততদিনে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তার ওপর খাবার নেই।
নিজেদের মধ্যে ‘ভয়াবহ’ চুক্তি করলেন তারা। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, যারা আগে মারা যাবেন, তাদের মাংস খেয়ে বাকিরা বেঁচে থাকবেন! হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন। আর সেটা বাস্তবায়িতও হল।
যে সঙ্গীটি প্লেনের পাশের সিটে বসেছিলেন, মারা যাওয়ার পর অবস্থার চাপে পড়ে তারই মাংস খেতে হয়েছিল বেঁচে থাকা যাত্রীদের।
তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর খাবারের অভাবে আরও লোক কমে আসতে লাগল। সেই সঙ্গে পর্বতের প্রবল ঠান্ডা। আগ্নেয়গিরি অঞ্চল হলেও, ওখানে শেষ অগ্ন্যুৎপাত হয়েছে ১৯১৭ সালে। তারপর, বরফের চাদরে ঢাকা।
প্রাথমিকভাবে বিমান দুর্ঘটনার পর মোট ২৭ জন মানুষ বাঁচতে পেরেছিল। তবে এক রাতের ভেতরেই ভীষণ ঠান্ডায় তাদের ৮ জন মারা যায়। এমনকি একটু একটু করে ঠান্ডায় জমাট বাঁধা সঙ্গীদের শরীর খাওয়া শুরু করলে সেটাও দ্রুত শেষ হতে থাকে। নিজের দুঃস্বপ্নেও যেটা ভাবেননি সেটাই করতে শুরু করেন বিমানযাত্রীরা।
নিজের মৃত সঙ্গীদের পর নিজেদের মৃতপ্রায় সঙ্গীদের শরীরের দিকে ঝুঁকতে থাকেন। একমাত্র আশা ছিল, কেউ না কেউ, কোন না কোনদিন হয়তো তাদের খুঁজে বের করা হবে। মৃত্যুর আগে কিংবা পরে তারা ফিরে যাবেন মানুষের কাছে। ২৩শে ডিসেম্বর, বিমান দুর্ঘটনার ৭২ নম্বর দিনে অবশেষে সাহায্য আসে। মোট ১৬ জন মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হয়।
অবশেষে, দুর্ঘটনার ৭৩ দিন পর, ১৯৭২-এর ডিসেম্বরে উদ্ধারকারী দল এসে পৌঁছায় ওখানে। ততদিনে ৪৫ থেকে বেঁচে থাকাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১৬! বাকিরা হয়েছেন অন্যদের খাদ্য।
১৯৯৩ সালে এই ঘটনাকে ভিত্তি করে নির্মিত হয় চলুচ্চিত্র “অ্যালাইভ”। স্বজাতি ভক্ষণ মানব সভ্যতায় কখনোই স্বীকৃতি পায়নি। মানুষ এমন বীভৎস ঘটনাকে স্থান দেয়নি নিজেদের মধ্যে।
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ হয়েছে ওই স্থানের বর্তমান ছবি। আর তাতেই হতবাক সবাই। কোথায় বরফ? খা খা করছে মাটি। চারিদিকে বিছানো নুড়ি কাঁকর। সমস্ত বরফ গলে গেছে।
ঝলমলে রোদে সেই ছবি যেন একটা অভিশাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আন্দিজ পর্বতের বুকে একদিন বাধ্য হয়েই মানুষ মানুষকে খেয়েছিল।
কিন্তু আজ, ক্রমশ পরিবেশকে দূষিত করে আমরা এই জায়গাগুলোকে শেষ করছি। এইভাবে এক এক করে বরফ গলে বেরিয়ে পড়ছে রুক্ষ মাটি। বদলে যাচ্ছে আবহাওয়া। আর সেটা হচ্ছে দ্রুতভাবেই।
শেষে কি এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে, যেখানে আমরাও একপ্রকার বাধ্য হয়েই ওই মানুষগুলোর মতো নিজেদের ‘মাংস’ নিজেরাই খাব?
এইডব্লিউ/এসএস/১৮৫৫
আপনার মতামত জানানঃ