বিস্তীর্ণ মরুভূমি। অথচ একসময় তার বুক ভরা জলরাশিতে ছিল প্রাণের প্রাচুর্য। বলছি আরাল সাগরের প্রসঙ্গে। ১৯৯৭ সালের শুরুর দিকে করা জরিপ অনুযায়ী আরাল সাগরের প্রায় ৯০ শতাংশ পানি শুকিয়ে গেছে।
নামে সাগর হলেও আরাল সাগর মূলত একটি হ্রদ। বিশালতার কারণে আরবদের কাছে এটি সাগর নামে পরিচিত ছিল। ১৯৬০ সালের দিকে এটি পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম হ্রদ ছিল। উত্তর থেকে সির দরিয়া ও দক্ষিণ থেকে আমু দরিয়া নদী থেকে পানি এসে মিশতো আরালের বুকে।
লেকটি ধীরে ধীরে শুকাতে শুরু করে। ২০১৪ সালের নাসার প্রকাশিত উপগ্রহ চিত্রে দেখা যায় হ্রদটির পূর্বাঞ্চলীয় বেসিনের পুরোটাই শুকিয়ে গেছে। অঞ্চলটি এখন আরালকুম মরুভূমি নামে পরিচিত।
আরাল সাগরের জলরাশি কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান এবং মধ্য এশিয়ায় বিস্তৃত ছিলো। এ হ্রদটি আয়তন ছিল ৬৭ হাজার বর্গ কি.মি.। যা ১৯৯৬ সালের হিসেব অনুযায়ী প্রায় ৭০ শতাংশই শুকিয়ে গেছে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল আরাল সাগর। সাগরটি শুকিয়ে যাওয়ায় সেখানকার ভূ অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে।
আরাল সাগর বিপর্যয়কে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ধরা হয়। আরাল সাগর তীরবর্তী এলাকার আবহাওয়া মোটেও বসবাসের জন্য উপযুক্ত ছিল না। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ মাত্র ১০০ মিলিমিটার, যা যেকোনো প্রাণীর বসবাসের জন্য প্রতিকূল।
প্রতি লিটার পানিতে লবণের পরিমাণ ছিল গড়ে ১০ গ্রাম করে। হাতেগোনা কয়েক প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ বেঁচে থাকতো সেখানে। এদেরকে ঘিরে আরালের বুকে গড়ে উঠে ক্ষুদ্র মৎস্যশিল্প।
সাগরটি শুকিয়ে যাওয়ার পেছনের মূল খলনায়ক তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯১৮ সালে গড়ে তোলা সোভিয়েত তুলা শিল্প তখন সফলতার শীর্ষে আরোহণ করেছিলো। সোভিয়েত সরকার তাই বিশ্ব বাজার ধরে রাখতে তুলার উৎপাদন বৃদ্ধি করার প্রকল্প হাতে নেয়।
সির দরিয়া এবং আমু দরিয়া, এই দুই নদীর পানিকে তুলা ক্ষেতে সেচের কাজে ব্যবহার করা হয়। দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারদের সাহায্যে নদীর পানি টেনে এনে তুলা চাষ অঞ্চলে সেচ করা হয়।
ফলে আরাল হ্রদের দিকে ধাবিত হওয়া পানির পরিমাণ কমে যায়। হ্রদের সঙ্গে কোনো সাগরের সংযোগ না থাকায় আস্তে আস্তে পানির পরিমাণ কমে যায়।
পানির পরিমাণ কমে যেতে থাকায় হ্রদের পানিতে লবণের ঘনত্ব মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে যায়। ফলে জলজ প্রাণীদের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। এখান থেকে আরাল সাগরের ধ্বংসের সূচনা ঘটে।
লবণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফলে আবহাওয়ায় বড় রকমের পরিবর্তন ঘটে। ঝড়-তুফানের পরিমাণ বেড়ে যায় বহুগুণে। এ ছাড়াও বিভিন্ন গবেষণাগারের রাসায়নিক বর্জ্য, বিষাক্ত কীটনাশক, শিল্প-কারখানার বর্জ্য আরাল সাগরের পানিতে নিষ্কাশন করা হতো।
১৯৬০ সালের বিশাল হ্রদের পানি দ্রুত শুকিয়ে যেতে থাকে। স্থানীয় অধিবাসীরা বিষয়টি লক্ষ্য করে। আরালের পানির উপর নির্ভরশীল অধিবাসীরা উপায় না দেখে অন্য প্রদেশে চলে যেতে থাকে।
আরাল সাগর শুকিয়ে যাওয়ার কারণে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরাল সাগর এলাকার অধিবাসীরা। কারণ তাদের অধিকাংশ নাগরিকের আয়ের প্রধান উৎস ছিল এই হ্রদটি। তাই সাধারণ জনগণের আর্থ-সামাজিক কাঠামো ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।
পানি শুকিয়ে গেলেও লবণ থেকে যায়। বিপর্যয়ের কারণে পূর্বের আরাল সাগর উপকূলে ঘন লবণের স্তূপের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সেখানকার মাটির গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। লবণাক্ত পরিবেশ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ফলে বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগ মহামারী হিসেবে দেখা দেয়।
১৯৯০ সালের দিকে আরাল সাগর এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। আরাল সাগরতীরে গড়ে উঠা মৎস্যশিল্পের চূড়ান্ত পতন ঘটে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৪০
আপনার মতামত জানানঃ