প্রায় ৩০০ বছর আগে শিল্পভিত্তিক সভ্যতায় প্রবেশ করেছে মানবজাতি। দিন যত যাচ্ছে, উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়া ও মানুষের জীবনযাত্রা হয়ে উঠছে কলকারখানা ও শিল্প-প্রযুক্তি নির্ভর। কিন্তু এই সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে শিল্প-কলকারখানা ও যানবাহনে প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানোর ফলে বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে মানবজাতির সামনে, যার উপসর্গ বা লক্ষণ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মহামারিতে সারা বিশ্ব যেভাবে থমকে দাঁড়িয়েছে, তাতে প্রকৃতি নিজের শুশ্রূষা কিছুটা হলেও করতে পেরেছে। বাধ্য হয়ে আরোপিত লকডাউনের কারণে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ আগের চেয়ে অনেক কমেছে, কমেছে বায়ুদূষণও। কিন্তু এত সবেও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কিন্তু থামানো যাচ্ছে না। সামগ্রিকভাবে লকডাউনের কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশের লাভ হলেও, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ওপর এর প্রভাব নগণ্য।
পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টের হিমবাহ ‘মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের’ কারণে গলে যাচ্ছে। যতটা সময় নিয়ে হিমবাহ তৈরি হয়, তার চেয়ে ৮০ গুণ দ্রুততার সঙ্গে এটি গলছে। এর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু এলাকাতেও পৌঁছে গেছে বলে একটি নতুন গবেষণায় উঠে এসেছে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নেচার পরিচালিত সাময়িকী ক্লাইমেট অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফেরিক সায়েন্সে ওই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণাটি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেইনের একদল বিজ্ঞানী ও পর্বতারোহীর তত্ত্বাবধানে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ও রোলেক্স পারপেচুয়াল প্ল্যানেট এভারেস্ট এক্সপেডিশন নামে ২০১৯ সালে এভারেস্টে একটি অভিযান চালানো হয়। বিজ্ঞানী ও পর্বতারোহীরা এভারেস্টের হিমবাহে ভ্রমণ করেন এবং সেখানকার নমুনা সংগ্রহ করেন। তথ্য সংগ্রহের জন্য তারা সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া স্টেশনও প্রতিষ্ঠা করেন। সেখান থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের গবেষণার পরই এভারেস্টের হিমবাহ উদ্বেগজনক হারে গলে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেল।
ওই গবেষণাপত্রের বরাতে সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এভারেস্ট চূড়ায় এভাবে হিমবাহ গলে যাওয়া বড় ধরনের বিপর্যয়ের সংকেত। বিশ্বের ১৬০ কোটি মানুষের খাবার পানি, সেচের পানি, জলবিদ্যুত উৎপাদনের স্রোত- সব ওই হিমবাহ গলা পানি থেকেই আসে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, এভারেস্টের হিমবাহ তুষার দ্বারা সুরক্ষিত থাকে। এই হিমবাহ গঠিত হতে লাগে কয়েক দশক। কিন্তু বরফ আলগা হয়ে পড়ায় সেই হিমবাহ প্রতিবছর গলছে দ্রুত হারে। এভারেস্টে হিমবাহ গঠিত হতে কমবেশি ২ হাজার বছর লাগে। কিন্তু সেটা গলতে লাগছে ২৫ বছর।
গবেষণায় নেতৃত্বদানকারী ইউনিভার্সিটি অব মেইনের ক্লাইমেট চেঞ্জ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক পল মায়েস্কি বলেন, এভারেস্টের সর্বোচ্চ হিমবাহটি এর ভারসাম্য রক্ষায় রক্ষাকর্তা হিসেবে কাজ করে। এখন দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর ছাদেও মনুষ্যসৃষ্ট উষ্ণতার প্রভাব পড়েছে।
এভারেস্টে হিমবাহ গঠিত হতে কমবেশি ২ হাজার বছর লাগে। কিন্তু সেটা গলতে লাগছে ২৫ বছর।
গবেষণাটি ২৬ হাজার ৩০০ ফুটের বেশি উঁচু হিমবাহের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। গবেষণায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সারা বিশ্বের জনজীবনের ওপর প্রভাবের বিষয়টি নতুন করে আলোকপাত করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ১৯৯০-এর দশক থেকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ হিমবাহের ওপর মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। এর ফলে তুষারধসের ঝুঁকি বেড়ে গেছে। প্রতিবছর প্রায় ৮০০ পর্বতারোহীর এভারেস্টে ওঠার বিষয়টিকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। হিমবাহ ধসে পড়লে এশিয়ায় ১০০ কোটির বেশি মানুষের সুপেয় পানি, খাবার ও জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে। কারণ, হিমালয় থেকে নেমে আসা নদীর ওপর তাদের জীবন নির্ভরশীল।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর অন্যান্য উঁচু পর্বতের হিমবাহের অবস্থা কী হতে পারে বা হচ্ছে, সেই বিষয়টিকে ইঙ্গিত করছে মাউন্ট এভারেস্টের হিমবাহের ওই গবেষণার ফল।
গবেষকেরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে কেবল হিমবাহ গলে যাচ্ছে তা নয়; বরং এর ফলে তুষার আচ্ছাদিত পৃষ্ঠ যে ভারসাম্য রক্ষা করে, সেটিও নষ্ট হচ্ছে।
অধ্যাপক মায়েস্কি বলেন, তার আন্তর্জাতিক দলটি সাউথ কোল গ্লেসিয়ার নিয়ে কাজ করেছে। এই হিমবাহটির অবস্থান মাউন্ট এভারেস্ট ও লোটসের (চতুর্থ সর্বোচ্চ পর্বতমালা) মাঝখানে। দলটি এই হিমবাহটি কতটা সময় ও কী কারণে গলে গেছে, তা নিয়ে কাজ করে।
গ্রীষ্মকালে গড় তাপমাত্রার চেয়ে ১০ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধি বিশাল অঞ্চল জুড়ে হিমবাহগুলোর ক্ষতি করছে। কখনো কখনো হিমবাহগুলোর আট বিলিয়ন টন বরফ গলে যাওয়ার রেকর্ড রয়েছে যা গ্রীষ্মকালের সাধারণ গড়ের দ্বিগুণ।
২০২০ সালের জুন মাস ছিল উত্তর মেরুর জন্য ইতিহাসের উষ্ণতম মাস। ওই বছর ২০ জুন বিশ্বের শীতলতম স্থান বলে পরিচিত ভরখয়ানাস্ক শহরে তাপমাত্রা উঠেছিল ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উত্তর মেরুর মূল কেন্দ্র আর্কটিক মূল কেন্দ্র থেকে শহরটির দূরত্ব ১১৫ কিলোমিটার। এটি বিশ্বের শীতলতম শহর বলে পরিচিত।
গত বছরের আগস্টে জলবায়ু বিজ্ঞানীরা জানিয়েছিলেন, শিল্পায়নের আগে পৃথিবীর যে তাপমাত্রা ছিল সেই তুলনায় এখন গ্রহটি প্রায় ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি উষ্ণ। বাড়তে থাকা এই তাপমাত্রা সর্বসাকল্যে ১.৫ ডিগ্রির নিচে থাকা উচিত বলে উল্লেখ করেন তারা। জলবায়ু সংকটের সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাব এড়ানোর গুরুত্বপূর্ণ সীমা এটি।
কিন্তু, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমতে শুরু করলেও কয়েক দশকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাবে। যদি তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে, তাহলেও চরমভাবাপন্ন পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকেই যাবে।
এদিকে, ২০৫০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে বিভিন্ন দেশ। তাদের পরিকল্পনা সফল হলেও ২০৬০ থেকে ৭০ এর দশকের শুরুতে তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়তে পারে। ফলে, কয়েক দশক ধরে বাড়বে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা।
গবেষকদের মতে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকবে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল। বিশ্লেষণ অনুসারে, সমুদ্রপৃষ্ঠের দীর্ঘমেয়াদী উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে রয়েছে চীন, ভারত, ভিয়েতনাম এবং ইন্দোনেশিয়া।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষুদ্র দ্বীপের দেশগুলো পুরোপুরি তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সংস্পর্শে থাকা শীর্ষ ১০টি অঞ্চলের মধ্যে ৮টি রয়েছে এশিয়ায়। এই অঞ্চলে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন মানুষের বাস।
জলবায়ু পরিবর্তনে মানুষের ক্ষয়ক্ষতি সংক্রান্ত এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বে তাপদাহে যে পরিমাণ মানুষ মারা যায়, তার এক তৃতীয়াংশেরও বেশি মৃত্যুর প্রধান কারণ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন।
গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, তাপদাহে মোট মৃত্যুর ৩৭ শতাংশের জন্য দায়ী জলবায়ুর পরিবর্তন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন ও জ্বালানি দক্ষতা সংক্রান্ত নীতিমালা প্রনয়নে মানুষের আচরণ ও অভ্যাসগত বিষয়কে আমলে নেয়া প্রয়োজন। উল্লেখ্য যে, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের তুলনায় মানুষের আচরণগত পরিবর্তন আনার জন্য যে বিনিয়োগ প্রয়োজন তা একেবারেই কম। কিন্তু অভ্যাস ও আচরণগত পরিবর্তনের প্রতিদান এবং কো-বেনিফিটস অনেক বেশী।
তারা বলেন, কভিড-১৯ এর কারণে আমাদের জীবনযাত্রায় যে আমূল পরিবর্তন এসেছে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন ও জ্বালানি দক্ষতা সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নে আচরণ ও অভ্যাসগত পরিবর্তনকে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। ভেবে দেখা যেতে পারে, কী ধরনের সামাজিক প্রণোদনা মানুষের আচরণ ও অভ্যাসগত পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করতে পারে?
এ কথা অনস্বীকার্য যে, আমরা যদি টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করতে চাই কিংবা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রন করতে চাই, আচরণ এবং অভ্যাসগত পরিবর্তন আনার কোনো বিকল্প নেই। তবে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, আচরণ ও অভ্যাসগত পরিবর্তন প্রযুক্তি নির্ভর জ্বালানি ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত নীতিমালার পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু কখনোই তা প্রযুক্তি নির্ভর নীতিমালার বিকল্প নয়।
তারা বলেন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও তাপমাত্রা স্বভাবিক রাখতে বৃক্ষ রোপণ বৃদ্ধিতে মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। বনদস্যুদের হাত থেকে বনাঞ্চল রক্ষায় কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। অপরিকল্পিত বনাঞ্চল নিধনে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। উদ্যোগ নিতে হবে পরিবেশ ও উষ্ণতা স্বভাবিক রেখে পৃথিবীকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করে তুলতে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬২৪
আপনার মতামত জানানঃ