ফেসবুক কি আর মানুষকে সেভাবে টানতে পারছে না? ফেসবুক কি দিন দিন আকর্ষণহীন হয়ে পড়ছে? এইসব প্রশ্ন বারবার উঠে আসছে আলোচনায়। গত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ফেসবুকে সক্রিয়তা অনেক কমে গেছে। এখন সেখানে শুধু ব্র্যান্ড আর চটকদার খবর। বন্ধু-পরিবারের মধ্যে যোগাযোগের যে আকর্ষণ, তা আর নেই। যে এক্টিভিজমের উপর ভিত্তি করে ফেসবুকের ভিত্তি গড়ে উঠেছিল, সেটি এখন আর নেই। ফেসবুকের আগের জনপ্রিয়তা হারানোর প্রভাব পড়ছে জাকারবার্গের উপরেও।
ফোর্বসের প্রকাশিত বিশ্বের শীর্ষ দশ ধনী ব্যক্তির তালিকা থেকে বাদ পড়েছে মেটার প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ। শেয়ার ধসের পর ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় জাকারবার্গের অবস্থান এখন ১২তম।
বিষয়টি জাকারবার্গের জন্য বেশ উদ্বেগের বিষয়ই বটে, গত বছরের নভেম্বরেই শীর্ষ ধনীদের তালিকায় তার অবস্থান ছিল তৃতীয়।
একই সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার ছিল মেটার স্টকের জন্য চূড়ান্ত হতাশাজনক একটি দিন। ওয়াল স্ট্রিটে ফেসবুকের এ প্যারেন্ট কোম্পানিটির শেয়ারে ধস নেমেছ ২৫ শতাংশে।
সূত্র মতে, কোম্পানটির বর্তমান আয় নিয়ে বিনিয়োগকারীদের অনাস্থাই এর মূল কারণ। এ ঘটনাকে একদিনেই সম্পদ ধসের সবচেয়ে বড় ঘটনা হিসেবে অভিহিত করেছে ব্লুমবার্গ।
প্রায় ৩১ বিলিয়ন ডলার হারিয়েছেন জাকারবার্গ। ফেসবুকের ইতিহাসেও এ ঘটনা প্রথম। বর্তমানে প্রযুক্তি খাতের এ মহারথীর সম্পদের পরিমাণ আনুমানিক ৮৭.৪ বিলিয়ন ডলার।
কোম্পানিটি প্রত্যাশার চেয়ে কম আয় করেছে বলে ঘোষণা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই মেটার শেয়ারদর প্রায় ২৫ শতাংশ পড়ে যায়।
২০২১ সালের শেষ তিন মাসে মেটার আয় ছিল মাত্র ১০.২৯ বিলিয়ন ডলার, শেয়ার প্রতি আয় ৩.৬৭ ডলার। বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস ছিল ওই সময়ে মেটার শেয়ার প্রতি আয় থাকবে ৩.৮৫ ডলার।
ফেসবুক বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে ২৯১ কোটি মাসিক সচল গ্রাহক দেখিয়েছে। এর আগের প্রান্তিকের সচল গ্রাহকের সংখ্যায় কোনো পরিবর্তন ছিল না। অর্থাৎ, সচল গ্রাহকের দিক দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি স্থবিরতায় ভুগছে।
গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানিটির আয় ছিল দুই হাজার নয়শ কোটি ডলার যা এর আগের পূর্বাভাসকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। এরপরেই মেটার শেয়ার দর ২০ শতাংশ কমে যায়। ফলে বাজার থেকে তাদের ১৭ হাজার ৫০০ কোটি ডলার হারিয়ে যায়।
ব্যবহারকারী হারাচ্ছে ফেসবুক
সম্প্রতি ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গ প্রতিষ্ঠানটির ২০০ কোটি ব্যবহারকারীর মাইলফলক ছোঁয়ার ঘোষণা দেন। প্রতি মাসে ২০০ কোটি ব্যবহারকারী ফেসবুকে লগইন করছেন। অবশ্য ফেসবুক কখনো ব্যবহারকারীদের ‘কাস্টমার’ বা গ্রাহক বলে না। এর পরিবর্তে জাকারবার্গ ‘কমিউনিটি’ বা সম্প্রদায় শব্দটি ব্যবহার করেন।
প্রথম ১০০ কোটির মাইলফলক পেরোতে ফেসবুকের আট বছর সময় লেগেছিল। পরের ১০০ কোটিতে পৌঁছাতে সময় লেগেছে মাত্র পাঁচ বছর। প্রতি সপ্তাহে ৫০ লাখের বেশি ব্যবহারকারী বাড়ছে। ফেসবুকের এই অর্জন অসাধারণ। বিশ্লেষকদের তথ্যমতে, বর্তমানে বিশ্বে ৩৫০ কোটি মানুষ ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় আছেন। এর মধ্যে ৭৫ কোটি মানুষ চীনের। সেখানে ফেসবুক নিষিদ্ধ।
অর্থাৎ, এখন মাত্র ৮০ কোটি মানুষের ইন্টারনেট আছে, যাঁদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ফেসবুকের দৌড়ের শেষ আছে। কারণ, ইন্টারনেট সংযোগ বাড়ছে ধীরে। জাকারবার্গ তাই নির্ভার থাকতে পারছেন না। ফেসবুক ব্যবহারকারী বাড়ার হার বেশি আর ইন্টারনেট বাড়ার হার কম। নানা প্রচেষ্টায় ইন্টারনেট সংযোগ বাড়ানো ও ফেসবুক ব্যবহারকারী বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি।
ফেসবুকের সব প্রচেষ্টা অবশ্য সাফল্যের মুখ দেখেনি। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ফেসবুকের বিনা মূল্যে ইন্টারনেট দেওয়ার প্রচেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়েছে। টেলিকম অপারেটররা তাঁদের বিনিয়োগ করা অবকাঠামোতে বিনা খরচার ব্যবসা করার সুযোগ দিতে অনীহা দেখাচ্ছে।
সরকারের পক্ষ থেকেও ফেসবুকের ওপর চাপ বাড়ানো হচ্ছে। এতে ফেসবুকের ব্যবহারকারী বৃদ্ধির হার কিছুটা কমে আসছে। ২০০ কোটি ব্যবহারকারীর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ ব্যবহারকারী প্রতিদিন ফেসবুকে ঢোকেন। এ থেকে বোঝা যায়, ফেসবুক কতটা আকর্ষণ ধরে রাখতে পারছে। গত দুই বছরে এই হার একই জায়গায় আছে। এতে বোঝা যায়, ফেসবুক ব্যবহারকারী বাড়লেও সক্রিয়তার হার খুব বেশি বাড়ছে না।
এ ছাড়া গত কয়েক বছর ধরে ফেসবুকের জন্য আরেকটি আশঙ্কাজনক বিষয় হচ্ছে—ফেসবুকে পোস্ট কমে যাওয়া। ফেসবুকে লগইন করলেও পোস্টের সংখ্যা কমতে দেখা যাচ্ছে। অনেকেই অভিযোগ করছেন, ফেসবুক এখন বিভিন্ন ব্র্যান্ড আর ভাইরাল কনটেন্টে ভরে গেছে। ফেসবুকের বড় আরেকটি ধাক্কা হচ্ছে এর ‘স্টোরিজ’ ফিচারটি। এ ফিচারটি স্ন্যাপচ্যাটের কাছ থেকে সরাসরি নকল করে গত মার্চ মাসে ফেসবুকে বসানো হয়। এতে ২৪ ঘণ্টার পর ছবি ও ভিডিও অদৃশ্য হয়ে যায়।
উল্লেখ্য, ১৮ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমেছে ফেসবুকের। গত বছরের শেষ তিন মাসে নিয়মিত ফেসবুক ব্যবহারকারী হারিয়েছে। ওয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার ও ইন্সটাগ্রামের মতো অন্যান্য মাধ্যমগুলোতে মোটামুটি মানের প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে।
জাকারবার্গ নিজেই বলেছেন ফেসবুকের এমন কিছু মোকাবিলা করতে হবে যা আগে কখনো হয়নি। ফেসবুকের বর্তমান অন্যতম প্রতিদ্বন্দী টিকটকের ব্যাপারে বলেছিলেন খুবই দ্রুত এটি এগিয়ে যাচ্ছে।
২০২১ সালের শেষ তিন মাসে দৈনিক সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ১৯২ কোটি ৯০ লাখ। এর আগের তিন মাসে এই ব্যবহারকারী সংখ্যা ছিল ১৯৩ কোটি।
অর্থাৎ গত বছরের শেষ তিন মাসে ফেসবুকের সক্রিয় ব্যবহারকারী কমেছে ১০ লাখ। বলা হচ্ছে, প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানি টিকটক ও ইউটিউবের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কুলিয়ে উঠতে না পেরে ব্যবহারকারী হারিয়েছে ফেসবুক।
কেন ব্যবহারকারী কমছে?
ফেসবুক সব সময়ই একটি বর্ধনশীল প্ল্যাটফর্ম। এখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তারপরও গত কয়েক বছরে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাড়েনি ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা। মূলত বিশ্বের অন্যান্য অংশের ব্যবহারকারীরাই এই প্ল্যাটফর্মকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
তবে তরুণ প্রজন্মের কাছে ফেসবুক আগের মতো জনপ্রিয় নেই। তরুণ প্রজন্ম ফেসবুকের চেয়ে ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম টিকটকের দিকে বেশি ঝুঁকছে।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, বিনিয়োগকারীদের ফেসবুকের প্রতি অনীহার অন্য কারণও রয়েছে। এর পেছনে রয়েছে ফেসবুকের প্যারেন্ট প্রতিষ্ঠানের নাম বদল।
মূলত মেটাভার্সকে ফোকাস করতে ফেসবুকের প্যারেন্ট প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে মেটা রাখা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি মেটাভার্স নির্মাণের ধারেকাছেও নেই। এই মুহূর্তে মেটাভার্স একটি অবাস্তব বিষয় হিসেবেই রয়ে গেছে।
পাশাপাশি মেটার প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা ডেভ ওয়েনার একটি কনফারেন্স কলে বিশ্লেষকদের জানান, অ্যাপলের গোপনীয়তা শর্ত পরিবর্তনের প্রভাব পুরো ২০২২ জুড়ে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের সমতুল্য হতে পারে।
বুধবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এটি জানায়, গত বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে কোম্পানিটির আয় প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম হয়েছে। কারণ এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে এটির ব্যবহারকারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। যা শুরু থেকেই তাদের বড় বাজার হিসেবে বিবেচিত। তাছাড়া অন্যান্য অঞ্চলেও এটির ব্যবহারকারী কমেছে।
মেটা জানিয়েছে, অ্যাপলের অপারেটিং সিস্টেমে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার শর্ত পরিবর্তনের কারণে তারা সমস্যায় পড়েছে। এতে করে, বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে তাদের সম্ভাব্য গ্রাহকের কাছে বিজ্ঞাপন পৌঁছে দিতে ও এ সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণে জটিলতার মুখে পড়ছে। এছাড়াও মেটা সাপ্লাই চেইনে বিঘ্নসহ অন্যান্য সামষ্টিক অর্থনীতির বিষয়ের উল্লেখ করেছে।
মেটা আরও জানায়, তারা টিকটক ও ইউটিউবের কাছ থেকে আরও বেশি প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীরা এখন ছোট ছোট ভিডিও ‘রিলের’ দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছেন, কিন্তু সেগুলো থেকে আয়ের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম। এ কারণে সার্বিকভাবে আয়ের প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।
বিশ্লেষক ডেব্রা আহো উইলিয়ামসন জানান, নিশ্চিতভাবেই মেটার জন্য সামনে আরও বড় বড় প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, বিশেষ করে বিজ্ঞাপন থেকে পাওয়া রাজস্বের ক্ষেত্রে।
সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, টিকটকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা ও অ্যাপলের অপারেটিং সিস্টেমে পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদেরকে উদ্যোগী হতে হবে, জানান ডেব্রা।
সূত্র মতে, ফেসবুকে বয়স্ক ব্যবহারকারী বাড়ছে ঠিকই কিন্তু তরুণ ব্যবহারকারীরা স্ন্যাপচ্যাটের দিকে বেশি ঝুঁকছেন। ইমার্কেটার নামে একটি বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপে এ তথ্য জানা গেছে। খবর স্কাইনিউজের।
ব্রিটিশ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের মধ্যে যাদের বয়স ১২ ও ২৪ বছরের মাঝামাঝি তাদের মধ্যে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমতে পারে সাত লাখের মতো। এতে কোম্পানিটির যুক্তরাজ্যের বাজারে মার্কেট শেয়ার কমে দাঁড়াবে ৭১ শতাংশ।
ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর ৪৩ শতাংশ ব্রিটিশ কিশোর তরুণ স্ন্যাপচ্যাটে স্থানান্তরিত হতে পারে। সংখ্যাটি ২০১৫ সালের স্ন্যাপচ্যাট ব্যবহারকারীদের তুলনায় দ্বিগুন।
এই পরিসংখ্যানটি একইভাবে খাটে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও, যেখানে মাসে অন্তত একবার ফেসবুক লগইন করা ব্যবহারকারী প্রথমবারের মতো ৫০ শতাংশের কমে নেমে এসেছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩২০
আপনার মতামত জানানঃ