সিরিয়ায় জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) শীর্ষ নেতা আবু ইব্রাহিম আল-হাশিমি আল-কুরাইশি নিজেকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার আগে তাকে জীবিত আটকের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছিল মার্কিন বাহিনী। আইএসের শীর্ষ নেতা আবু ইব্রাহিম আল কুরাইশিকে হত্যা করার জন্য বেশ কয়েকমাস ধরে পরিকল্পনা করছিল মার্কিন কর্মকর্তারা। তারপর নাটকীয়ভাবে অনেকটা আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন হত্যা অভিযানের কায়দায় মিশন চালানো হয়। তবে কুরাইশি ধরা না দিয়ে সপরিবারে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মঘাতী হন।
সিরিয়ার উত্তর ইদলিব প্রদেশের আতমেহ শহরের উপকণ্ঠে একটি তিনতলা আবাসিক ভবনকে লক্ষ্য করে ওই অভিযান চালানো হয়।
শহরটি তুরস্ক সীমান্তবর্তী ও বিরোধী-নিয়ন্ত্রিত। উত্তর ইদলিব অঞ্চলটি আইএসের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী জিহাদি সংগঠনগুলোর একটি শক্তিশালী ঘাঁটি। সেইসাথে সিরিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইরত তুরস্ক-সমর্থিত বিদ্রোহী দলগুলোও সেখানে শক্তিশালী।
মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে নিশ্চিত তথ্য ছিল যে কুরাইশি আতমেহ শহরের আবাসিক ভবনটির দোতলায় পরিবারের সঙ্গে বাস করছিলেন। সেখান থেকেই তিনি বার্তাবাহকের মাধ্যমে সিরিয়া এবং অন্যত্র তার নির্দেশনা প্রচার করে আইএস চালাতেন।
কিন্তু মার্কিন বাহিনী কিছু করার আগেই আল-কুরাইশি একটি আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ করেন। বাড়ির বেশ কিছুটা অংশ উড়ে যায়। আল-কুরাইশি সহ মোট ১৩জন মারা যান। এর মধ্যে ছয়জন নারী ও চারজন শিশু।
ডয়েচে ভেলের খবরে বলা হয়, তবে পেন্টাগনের মিডিয়া সচিব জন কিরবির দাবি, ‘আমেরিকার সেনাবাহিনী বুধবার মাঝরাতে উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালিয়েছিল। জঙ্গি গোষ্ঠী আল কায়দার বিরুদ্ধে মূলত এই অভিযান চালানো হয়। সেই অভিযানে আইএস প্রধান মারা গেছেন’।
২০১৯ সালে সিরিয়াতে আইএস প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদি মার্কিন হামলার মুখে এই কাজই করেছিলেন। জো বাইডেন বলেছেন, আল-কুরাইশি কাপরুষোচিত কাজ করেছেন।
তবে শহরের বাসিন্দাদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছে। মার্কিন সেনা হেলিকপ্টারে করে চূড়ান্ত আঘাত হানার আগে বাসিন্দাদের চলে যেতে বলে। লাউডস্পিকার ব্যবহার করে বলা হয়, বাসিন্দারা যেন দ্রুত ঘর ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় চলে যান। এক নারী রয়টার্সকে বলেছেন, ‘ঘোষণা হচ্ছিল, মার্কিন জোট চারপাশের এলাকা ঘিরে রেখেছে। পুরুষ, নারী, বাচ্চারা হাত তুলুন। আপনারা নিরাপদ থাকবেন’।
জেনারেল ফ্র্যাঙ্ক ম্যাকেঞ্জি এই অপারেশনের খবর বাইডেনকে জানাচ্ছিলেন। তিনি বলেছেন, যে বিস্ফোরণ হয়েছে, তা আত্মঘাতী বিস্ফোরণের থেকে অনেক বেশি জোরালো। বাড়ির তিনতলা ভেঙে পড়েছে। আল-কুরাইশি ও অন্যদের দেহ ছিটকে বাইরে এসে পড়েছে।
ম্যাকেঞ্জি জানিয়েছেন, দুইতলায় মার্কিন বাহিনী যখন পৌঁছায়, তখন আল-কুরাইশির এক সহযোগী ও তার স্ত্রী গুলি চালাতে থাকে। তারা মার্কিন সেনার গুলিতে মারা যায়। সেখানে একটি বাচ্চার দেহ মেলে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, কুরাইশি ইদলিবের আতমেহ শহরের যে আবাসিক ভবনে লুকিয়ে ছিলেন, সেখানকার আশপাশে হেলিকপ্টার দিয়ে মহড়া চালিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা। ভবনের অন্য বাসিন্দাদেরও সেখান থেকে বের হয়ে আসার জন্য বারবার অনুরোধ করা হচ্ছিল। বের না হলে পরিণাম ভালো না হওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হচ্ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত মার্কিন বাহিনীর সদস্যরা কুরাইশির কাছে পৌঁছানোর আগেই তিনি আত্মঘাতী বোমায় নিজকে উড়িয়ে দেন। ভবন থেকে ছিটকে রাস্তায় এসে পড়ে তার ছিন্নভিন্ন মরদেহ।
সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ইদলিবে গত বুধবার মধ্যরাতে সন্ত্রাসবিরোধী এ অভিযান চালায় যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বাহিনী। ওই অভিযানে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) শীর্ষ নেতা আবু ইব্রাহিম আল-হাশিমি আল-কুরাইশি নিহত হন বলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন।
মার্কিন বাহিনী কিছু করার আগেই আল-কুরাইশি একটি আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ করেন। বাড়ির বেশ কিছুটা অংশ উড়ে যায়। আল-কুরাইশি সহ মোট ১৩জন মারা যান। এর মধ্যে ছয়জন নারী ও চারজন শিশু।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুম থেকে পুরো ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। কুরাইশির আত্মহত্যাকে ‘প্রচণ্ড ভীরুতার চূড়ান্ত প্রকাশ’ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
পেন্টাগন বলছে, এদিন আল–কায়েদার স্থানীয় শাখার দুই সশস্ত্র সদস্য ঘটনাস্থলে পৌঁছালে তাদেরও মার্কিন হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
মার্কিন কর্মকর্তাদের বরাতে রয়টার্স জানায়, কুরাইশি ওই ভবনে অবস্থান করছেন বলে জানতে পারার পর গত বছরের ডিসেম্বরের শুরু থেকেই অভিযানের পরিকল্পনা করছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে ভবন থেকে কুরাইশি বের হতেন না বললেই চলে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য কুরিয়ারের ওপর নির্ভর ছিলেন তিনি। আর এমন অবস্থায় অভিযান পরিচালনা জটিল হয়ে পড়েছিল।
এ ছাড়া ওই ভবনের আশপাশে শিশুদের দেখা যাওয়ায় এবং ভবনের দ্বিতীয় তলার বিভিন্ন পরিবারের বসবাসকে ঘিরে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়েছে মার্কিন বাহিনীকে। বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে অভিযান চালানোর চেষ্টা চলছিল।
গত মঙ্গলবার ওভাল অফিসে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ও প্রতিরক্ষাপ্রধান মার্ক মিলের সঙ্গে বৈঠকে অভিযানের চূড়ান্ত অনুমোদন দেন বাইডেন।
পেন্টাগন জানায়, অভিযানের জন্য ব্যবহৃত একটি হেলিকপ্টারে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছে। এটি সেখানে ফেলে না রেখে ধ্বংস করা হয়েছে।
কে এই আবু ইব্রাহিম কুরাইশি?
মার্কিন হামলায় নিহত ইসলামিক স্টেটের (আইএস) শীর্ষ নেতা আবু ইব্রাহিমকে নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ঘনীভূত হচ্ছে। তার প্রকৃত নাম নিয়েও রয়েছে রহস্য।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনি আমির মোহাম্মদ সাঈদ আবদে আল-রহমান আল-মওলা নামেও পরিচিত ছিলেন। দুই বছর আগে জিহাদি নেটওয়ার্কে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ২০১৯ সালের অক্টোবরে মার্কিন বিশেষ বাহিনীর অভিযানের সময় আইএসের প্রতিষ্ঠাতা আবু বকর আল-বাগদাদি নিজেকে বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেন। তারপর আইএসের শীর্ষ নেতৃত্বে চলে আসেন আবু ইব্রাহিম।
আইএসের শীর্ষ নেতৃত্বে আসার পর ছদ্মনাম গ্রহণ করেন আবু ইব্রাহিম। তার ছদ্মনাম ছিল ‘ধ্বংসকারী’ বা ডিসট্রয়ার। আইএসের নেতৃত্ব গ্রহণের আগে তিনি ইয়াজিদিদের গণহত্যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। নৃশংসতার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন এই সন্ত্রাসী নেতা। আইএসের সবচেয়ে নাজুক সময়ে বাহিনীর হাল ধরেছিলেন আবু ইব্রাহিম আল কুরাইশি। কয়েক বছর ধরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন হামলায় সিরিয়া ও ইরাকে আইএস যখন তাদের স্বঘোষিত ‘খিলাফত’ হারাচ্ছিল এবং দুর্বল হয়ে পড়ছিল, তখন আইএসের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন তিনি।
তার দায়িত্ব গ্রহণের পর পুনরায় চাঙা হতে শুরু করে আইএস। আইএসের এই নব-উত্থান যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তখন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর আবু ইব্রাহিমের মাথার দাম ঘোষণা করেছিল ১ কোটি টাকা (১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)। একই সঙ্গে আবু ইব্রাহিমের নাম ‘বৈশ্বিক সন্ত্রাসী’ তালিকায় যুক্ত করেছিল।
উত্তর ইরাকের তাল আফার শহরে ১৯৭৬ সালে জন্মেছিলেন আবু ইব্রাহিম। সেখানে ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত ছিলেন তিনি। তার পরিবার তুর্কমেনিস্তান থেকে ইরাকে এসেছিল। এমন একটি অনারব পরিবারে জন্ম নেওয়া আবু ইব্রাহিমের চরমপন্থী গোষ্ঠীতে যোগ দেওয়া ছিল বিরল ঘটনা।
প্রথম পেশাজীবনে আবু ইব্রাহিম ইরাকের প্রয়াত স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনের সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন। ২০০৩ সালে মার্কিন সেনাদের হাতে সাদ্দাম হোসেন বন্দী হওয়ার পর আবু ইব্রাহিম আলকায়েদায় যোগ দিয়েছিলেন। এর ঠিক এক বছর পর ২০০৪ সালে মার্কিন বাহিনীর হাতে আটক হয়েছিলেন তিনি। সে সময় তাকে দক্ষিণ ইরাকের কুখ্যাত বুক্কা কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল।
ভয়ংকর নিষ্ঠুর আচরণের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন আবু ইব্রাহিম। তিনি ২০১০ সালে আলকায়েদার ইরাকি শাখার হাল ধরেছিলেন। তারপর ইসলামিক স্টেট অব ইরাক (আইএসআই) এবং তারও পরে ইসলামিক স্টেট অ্ ইরাক অ্যান্ড সিরিয়ার (আইএসআইএস) হাল ধরেছিলেন। সব দলেই তার পরিচয় ছিল ‘নিষ্ঠুর নীতিনির্ধারক’।
২০১৪ সালে আবু ইব্রাহিমের সহায়তায় ইরাকের উত্তরের শহর মসুল নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিএন আইএসের প্রতিষ্ঠাতা আবু বকর আল-বাগদাদি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে নিজেকে বিদ্রোহীদের সিনিয়র পদে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন আবু ইব্রাহিম। তখন তাকে ‘প্রফেসর’ ও ‘ডিসট্রয়ার’ নাম দেওয়া হয়েছিল। আইএসের মধ্যে যারা বাগদাদির নেতৃত্বের বিরোধিতা করেছিল, তাদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছিলেন আবু ইব্রাহিম। এ জন্য তাকে নিষ্ঠুর নীতিনির্ধারক বলা হতো।
প্যারিসের সায়েন্স পো ইউনিভার্সিটির জিহাদি বিশ্লেষক জেন-পিয়েরে-ফিলিয়ু বলেন, আবু ইব্রাহিম সম্ভবত গণহত্যা ও যৌন দাসত্বের মাধ্যমে ইরাকের ইয়াজিদি সংখ্যালঘুদের নির্মূল করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন।
২০১৫ সালে গৃহযুদ্ধ কবলিত মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশ ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল এলাকা দখল করে পৃথক রাষ্ট্র বা খিলাফত ঘোষণা করে আইএস। এই রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয় সিরিয়ার রাক্কা শহরে।
সে সময় আইএসের তৎকালীন প্রধান নেতা ছিলেন আবু বকর আল বাগদাদি, যিনি ২০১৯ সালের অক্টোবরে এই ইদলিব প্রদেশেই মার্কিন বাহিনীর হামলায় নিহত হয়েছিলেন। বাগদাদি নিহত হওয়ার পর আইএসের প্রধান খিলাফত বা নেতার আসনে বসেন কুরাইশি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪৮
আপনার মতামত জানানঃ