আফগানিস্তানে ক্ষুধা এখন নিত্যদিনের সমস্যা। প্রতিদিনই নতুন নতুন উপায়ে ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন দেশটির প্রত্যন্ত এলাকার বাসিন্দারা। অভাবের তাড়নায় নিজের সন্তানকে বিক্রি করার ঘটনাও এখন অহরহ। এখন আবার অর্থ পেতে, নিজের কিডনিও বিক্রি করছেন অনেকে।
সম্প্রতি আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে শীত মৌসুমে তাপমাত্রা শূন্যের নিচে নামতে শুরু করেছে। তালিবান ক্ষমতা দখলের পর দেশটিতে বন্ধ হয়ে গেছে আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতা। এতে দেশটির জনসংখ্যার একটি বড় অংশ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে। অনেকে নিজের সন্তানকে বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের মুখে আহার তুলে দিচ্ছেন।
আফগানিস্তানে মানবিক সংকটের বিষয়ে আবারও সতর্ক করেছেন জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) প্রধান। সংস্থাটির প্রধান ডেভিড বেসলি জানিয়েছেন, অভাবের তাড়নায় শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গ এবং সন্তানদের বেচে দিতে বাধ্য হচ্ছেন আফগানরা।
বিশ্বের বিত্তশালী ব্যক্তিদের কাছে দেশটির অবস্থা উত্তরণের আহ্বান জানিয়ে ডেভিড ব্যাসলি জানান, প্রতিদিন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের সম্পদের পরিমাণ ৫.২ বিলিয়ন ডলার করে বাড়ছে অথচ আফগানিস্তানের মানুষ খাবার পাচ্ছেন না।
আফগানিস্তানের বিষয়ে সবাইকে আরও একবার সতর্ক করে ডেভিড বেসলি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সহায়তা চেয়েছেন। তিনি অবিলম্বে দেশটিতে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার আহ্বান জানান। বর্তমানে দেশটির অর্ধেকের বেশি মানুষ প্রচণ্ড খাদ্য সংকটে দিন কাটাচ্ছেন।
বছরের পর বছর ধরে চলা সংঘাতের মধ্যেই খরা, মহামারি এবং অর্থনীতি ধসের কারণে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে সময় পার করছেন আফগানরা। দেশটিতে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছেন প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। এই শীতে অর্ধেকের বেশি মানুষ দুর্ভিক্ষে পতিত হবেন এবং চলতি বছর দেশটির ৯৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে দিন কাটাবেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
ডয়েচে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বেসলি বলেন, গত ২০ বছরের সংঘাতে আফগানিস্তান ইতোমধ্যেই দরিদ্র দেশে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। দেশটির ৪ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় আড়াই কোটি মানুষই এখন অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন।
ওই সাক্ষাতকারে তিনি জানান, আফগানিস্তানে এক নারীর সঙ্গে তার দেখা হয়েছে যিনি খাবারের অভাবে নিজের সন্তানকে অন্য একটি পরিবারে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। তার আশা তার সন্তানকে নতুন পরিবারে খাবারের কষ্ট করতে হবে না।
বর্তমান খাদ্য সংকটের এই পরিস্থিতি সমাধানে বিশ্বের ধনী দেশগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন বেসলি। তিনি বলেন, করোনা মহামারিতে ধনকুবেরদের সম্পদ আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। তারা এই সংকট মোকাবিলায় সহায়তা করতে পারেন।
ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নরওয়ে, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ প্রতিনিধি এবং বিশেষ দূতরা গত ২৪ জানুয়ারি অসলোতে সাক্ষাত করেন। তারা আফগানিস্তানের চলমান সংকট নিয়ে আলোচনা করেছেন।
অভাবের তাড়নায় শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গ এবং সন্তানদের বেচে দিতে বাধ্য হচ্ছেন আফগানরা।
চলতি বছরের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল নিয়ন্ত্রণে নেয় তালিবান। এরপর তারা নতুন সরকার গঠন করলেও এখনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে দেশটি। দেখা দিয়েছে চরম খাদ্য সংকট। এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে রেহাই পাচ্ছে না কন্যাশিশুরাও। ফলে আফগানিস্তানে ক্রমশ বাড়ছে ‘শিশুবধূ’র সংখ্যা।
খাদ্য সংকট কতটা চরমে পৌঁছালে একজন মা তার কন্যাসন্তানকে বিক্রি করতে বাধ্য হন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে একজন মার এছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। দেশে ভয়াবহ আর্থিক সংকট তৈরি হওয়ায় আফগানিস্তানের অনেক নাগরিককেই এখন এমন মর্মান্তিক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে আফগানিস্তান। গত বছরের আগস্ট মাসে তালিবানরা দেশটির ক্ষমতা দখলের পর থেকে মানবিক পরিস্থিতির তীব্র অবনতি হতে শুরু করেছে। দীর্ঘ দুই দশক যুদ্ধ চলাকালে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা দেশটিকে সহায়তা করে আসছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সরকারকে আগস্টে তালিবান ক্ষমতাচ্যুত করার পর ওই সব সহায়তা বন্ধ হয়ে যায়। আর এর ফলেই সমূহ বিপদে পড়েছে দেশটি।
এ বিষয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এতদিন যেসব আন্তর্জাতিক সহায়তার মাধ্যমে দেশটির ভঙ্গুর অর্থনীতি টিকে ছিল সেটা বন্ধ হয়ে গেছে এবং তালিবান সরকারের সঙ্গে কীভাবে কাজ করবে সে বিষয়ে বিশ্বজুড়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
তালিবান নিয়ে বিশ্ব মোড়লদের সিদ্ধান্তহীনতা এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলছে। তালিবানের নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্তহীনতার ফল ভুগতে হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির লাখ লাখ মানুষকে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আফগানিস্তানে দিনের পর দিন কন্যা শিশুসন্তান বিক্রির ঘটনা বাড়ছে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, খাদ্য ও কাজের অভাব এবং বিভিন্ন সংকটে থাকা পরিবারগুলো এমন সিদ্ধান্তকেই সঠিক বলে মনে করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছে আফগানিস্তানের এসব বিপন্ন মানুষের কাছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শিগগিরই পৌঁছতে হবে। তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া হবে কী হবে না, এ বিতর্কে আটকে গেলে এখানকার লাখ লাখ শিশুকে বাঁচানো সম্ভব হবে না।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১৮
আপনার মতামত জানানঃ