যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বের প্রথম এইচআইভি টিকার পরীক্ষামূলক ট্রায়াল শুরু হয়েছে। ট্রায়ালের প্রথম ধাপ পরিচালনার জন্য ইতোমধ্যে ৫৬ জন স্বেচ্ছাসেবীকে বেছে নেওয়া হয়েছে, যারা স্বাস্থ্যবান ও এইচআইভি নেগেটিভ।
এমআরএনএ প্রযুক্তিতির যে টিকা এই ট্রায়ালে ব্যবহার করা হচ্ছে, এখনও সেটির কোনো নাম দেওয়া হয়নি। টিকাটি প্রস্তুত করেছে মার্কিন ওষুধ ও টিকা উৎপাদনকারী কোম্পানি মডার্না।
বৃহস্পতিবার এক যৌথ বিবৃতিতে মডার্না ও আন্তর্জাতিক অলাভজন সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এইডস ভ্যাকসিন ইনিশিয়েটিভস (আএভিআই) এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে বলে শুক্রবার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
গত ৪০ বছর ধরে এইডসের টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আন্তর্জাতিক গবেষকরা। এই প্রথম তাতে সাফল্যের দেখা মিলল। গত বছরও একটি টিকা প্রস্তুত করা হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি মেডিকেল ট্রায়ালের পর্যায়ে যায়নি।
বৃহস্পতিবারের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই টিকার মূল উদ্দেশ্য মানবদেহে ‘ব্রডলি নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি’ বা বিএনএডি নামের একপ্রকার বিশেষ অ্যান্টিবডি তৈরি করা, যা মানবদেহে এইচআইভি ভাইরাস প্রবেশ করলে তাকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারবে।
টিকার ডোজে থাকা ওষধি তরল বা ইমিউনোজেন এই কাজটি করবে উল্লেখ করে বিবৃতিতে মডার্না ও আইএভিআই বলেছে, ‘এইডস নিয়ে এ পর্যন্ত যত গবেষণা হয়েছে, তাতে প্রমাণিত হয়েছে যে বিএনএডি এইচআইভিকে নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম।
অন্যভাবে বলা যায়, মানবদেহে এইচআইভি সংক্রমণ ঠেকানোর প্রথম ধাপ এই বিএনএডি। তাই এ বিষয়টিকে মনোযোগের কেন্দ্রে রেখেই নতুন এই টিকাটি প্রস্তুত করা হয়েছে।’
‘আমরা আশা করছি, সব ধাপ পেরোনোর পর যখন টিকাটি স্বীকৃতি পাবে, মূল এইচআইভি ও তার যে কয়েকটি রূপান্তরিত ধরন এই পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে- সবগুলোর বিরুদ্ধেই কার্যকর হবে এই টিকা।’
অ্যাকোয়ার্ড ইমিওনো ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোম বা এইডস আসলে একই সঙ্গে রোগ এবং রোগলক্ষণসমষ্টি। এইচআইভি বা হিউম্যান ইমিওনো ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটলে এই রোগ ও রোগ লক্ষণসমষ্টি দেখা দেয় মানবদেহে।
এইচআইভি ভাইরাস মূলত মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে আক্রামণ করে এবং ধ্বংস করতে থাকে। ফলে এইডসে আক্রান্ত রোগী খুব সহজেই সংক্রামক রোগের শিকার হন এবং ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হতে থাকেন।
গত শতকের ১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম এইডসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। ওই বছরই দেশটির রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) এই রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস এইচআইভিও চিহ্নিত করে।
অনিরাপদ যৌনতা, রক্ত সঞ্চালন, সিরিঞ্জের সূঁচের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে এইচআইভি ভাইরাস। এছাড়া, মায়ের মাধ্যমেও এইডসে আক্রান্ত হয় শিশুরা। কোনো গর্ভবতী নারীর দেহে এইডসের জীবাণু থাকলে তা অনাগত সন্তানকেও সংক্রমিত করে।
সাহারা ও নিম্ন আফ্রিকার অঞ্চলগুলোতে এইডসের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষ মারা যান এইডসে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বিশ্বে এইডসে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন ১০ লাখ মানুষ।
এর আগেও মরণব্যাধী এইডসের ওষুধ আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিলেন বিজ্ঞানীরা। এইডসের মতো প্রায় হুবহু মারাত্মক ভাইরাসে আক্রান্ত বেশ কয়েকটি বানরের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে বিস্ময়কর সাফল্য পেয়েছিলেন তারা।
জানা যায়, অতি প্রাচীন ম্যাকাকু প্রজাতির বানরের দৈহিক গঠনের সাথে মানব দেহের বেশ মিল রয়েছে। সে কারণে আক্রান্ত এসব বানরের দেহে মারাত্মক এই ভাইরাস ব্যাপকভাবে প্রতিরোধ করতে সক্ষম নতুন ধরনের ওষুধ প্রয়োগ করে দেখা হয়।
এতে এসআইভি (সিমিয়ান ইম্যুনোডিফেসিয়েন্সি ভাইরাস) ভার্সনের এ ওষুধগুলো বারবার উচ্চমাত্রায় ব্যবহার করা হয়।এর আগে ২০১৩ সালেও বানরের উপর পরীক্ষা চালিয়ে এইচআইভি ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা।
তবে তারা ওই প্রচেষ্টাকে খুবই কার্যকর বলে অভিহিত করেছিলেন।যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার স্ক্রিপস রিসার্চ ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ও এ গবেষণা প্রধান মিশেল ফারজান বলেন, ‘এইচআইভি-১ মানব দেহে বিস্তারিত ভাইরাসের প্রধান গ্রুপ।
আমরা এই এইচআইভি ১-কে প্রতিরোধ করার মতো একটি দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর ভ্যাকসিন অর্জনের পন্থা দেখাই।’গবেষণায় এর মূল ওষুধকে ইসিডিফোর-এলজি বলা হয়। এতে একটি কোষের আস্তরে থাকা প্রোটিনের (যেটি নির্দিষ্ট মলিকিউলগুলোকে এই আস্তরে বেঁধে রাখে।
যাতে এসব বিশেষ ধরনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের ফলে কোষের ভেতরে শোষণ করা যেতে পারে।) দুধরনের অনুকৃত উপাদান রয়েছে। একইসাথে প্রোটিনের ঢোকা ও বের হওয়ার কিছু পয়েন্টও রয়েছে।
যেখানে রোগ প্রতিরোধকারী কোষগুলোর মূল দূর্গ সিডিফোর কোষগুলোও রয়েছে। এই দূর্গের মুখে এসে এইচআইভি ভাইরাসগুলো ব্যাপকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়।
গবেষণায় এই ইসিডিফোর-এলজির অনুকরণেই এইডসের ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা চালানো হয়। মূলত প্রোটিনের ঢোকা ও বের হওয়ার যে প্রক্রিয়া রয়েছে তা পাকাপাকিভাবে শুরু হওয়ার আগেই তাতে বিশেষ ধরনের প্রতিরোধকারী কৌশল হিসেবে কাজ করে এই ভ্যাকসিন। যাতে কোনোভাবেই ভাইরাস ছড়িয়ে না পড়ে।
মোটকথা এই ভ্যাকসিনে এমন সব উপাদান রয়েছে যা কার্যকরভাবেই ভাইরাস প্রবেশ করার দরোজাই বন্ধ করে দেয়। বিজ্ঞানীরা এই গবেষণাকে খুবই কার্যকর অর্জন হিসেবে দেখছিলেন। কিন্তু আশার আলো দেখেনি।
দক্ষিণ আফ্রিকাতেও প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষের ওপর এই ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (এনআইএআইডি)। স্বাধীন তথ্য এবং সুরক্ষা নিরীক্ষণ বোর্ড এইচআইভি প্রতিরোধে ভ্যাকসিনটি অকার্যকরের প্রমাণ পাওয়ায় এর ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সংস্থাটির পরিচালক ড. অ্যান্হনি ফসি এক লিখিত বিবৃতিতে বলেছিলেন, বিশ্বব্যাপী এইচআইভি নির্মূলে একটি ভ্যাকসিন খুবই দরকার। আমরা আশা করেছিলাম, এটি কাজ করবে। দুঃখজনকভাবে তা হয়নি। নিরাপদ ও কার্যকর এইচআইভি ভ্যাকসিন আবিষ্কারের অন্য গবেষণা চলবে। আমি বিশ্বাস করি, এটা অর্জন সম্ভব।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪১০
আপনার মতামত জানানঃ