১৮ শতকের মহীশূরের শাসক টিপু সুলতান হিন্দুদের উপর যথেচ্ছ অত্যাচার করেছিলেন এবং সেই কারণে তার নামে জনসাধারণের প্রয়োজনীয় কোনও বিষয়ের নাম রাখা মেনে নেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে বিজেপি। বিজেপি বলছে, টিপু সুলতান হিন্দুদের ওপর যথেচ্ছ অত্যাচার করেছিলেন এবং সেই কারণে তার নামে জনসাধারণের প্রয়োজনীয় কোনো বিষয়ের নাম মেনে নেওয়া হবে না।
এই ইস্যুতে এখন মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে বিজেপি ও শিবসেনা। বৃহস্পতিবার শিবসেনা সাংসদ সঞ্জয় রাউত বলেছেন, কর্ণাটকে গিয়ে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ টিপু সুলতানের প্রশংসা করেছিলেন তবে কি বিজেপি এবার রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি করবে? বিজেপি আসলে চাইছে ইতিহাস বদলে দিতে।
সঞ্জয় রাউত আরও বলেন, বিজেপি ইতিহাস লেখার চেষ্টা না করলেই ভাল হয়। যদিও ওরা দিল্লিতে সেই চেষ্টাই করেছে, কিন্তু সফল হয়নি। রাউত আরও বলেন টিপু সুলতান কে তা আমরা জানি, তাই এই বিষয়ে বিজেপি যত কম বোঝানোর চেষ্টা করে ততই ভালো।
এর আগে বিজেপি নেতা এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিস বলেছিলেন, ইতিহাস বলছে টিপু সুলতান তার রাজ্যে হিন্দুদের বিরুদ্ধে নৃশংসতার জন্য পরিচিত। এই ধরনের ব্যক্তিদের সম্মান বিজেপি কখনই মেনে নেবে না। টিপু সুলতানের নামে উদ্যানের নামকরণের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হবে।
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের শিরাজ নায়ার আবার টুইটারে লিখেছেন, বর্বর টিপু সুলতানের নামে উদ্যানের নামকরণ করা আসলে সন্ত ভূমি মহারাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা।
টিপু সুলকতানকে নিয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত অবশ্য আগেও হয়েছে ভারতে। ২০২০ সালে কর্ণাটক রাজ্যে সপ্তম শ্রেণির সমাজবিজ্ঞান বইয়ের পাঠ্যসূচি থেকে টিপু সুলতান ও তার বাবা হায়দার আলীর ওপর লেখা নিবন্ধ বাদ দেওয়া হয়।
বিজেপির আমলেই বন্ধ হয়েছে সরকারিভাবে টিপু জয়ন্তী পালন।
বিজেপি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস মনে করে টিপু সুলতান কুর্গ, মালাবার সহ নানা এলাকায় কয়েক লক্ষ হিন্দুকে মেরে ফেলেছিলেন এবং বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করেছিলেন।
টিপু সুলতান হিন্দুদের ওপর যথেচ্ছ অত্যাচার করেছিলেন এবং সেই কারণে তার নামে জনসাধারণের প্রয়োজনীয় কোনো বিষয়ের নাম মেনে নেওয়া হবে না।
তবে মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সেবাস্টিয়ান যোসেফ এই দাবির সঙ্গে একমত নন। তিনি বলেন, টিপু সুলতানকে নিয়ে যত গবেষণা হয়েছে, তাতে এরকম তথ্য বিশেষ পাওয়া যায় না যে তিনি নির্দিষ্টভাবে হিন্দুদের ওপরেই অত্যাচার করেছিলেন।
তিনি বলেন, কুর্গ বা মালাবার উপকূলে যুদ্ধ নিঃসন্দেহে হয়েছিল সেখানকার হিন্দু শাসকদের সঙ্গে। এবং সেই যুদ্ধে অনেক হিন্দুর যে প্রাণ গিয়েছিল, সেটা অস্বীকার করা যাবে না—কিন্তু সেটাকে একটা ধর্মীয় অত্যাচার বলা ভুল। মহাভারতের কাহিনীতে তো যারা নিহত হয়েছিলেন, তারাও হিন্দুই ছিলেন। আবার মারাঠারা যখন মহীশূর দখল করতে এসেছিল, তখন তারা অতি পবিত্র হিন্দু তীর্থ শৃঙ্গেরি মঠ ধ্বংস করে দিয়েছিল – এমনকী বিগ্রহটিও ধ্বংস করে দেয় তারা।
টিপু সুলতানের ওপরে বহুদিন ধরে গবেষণা করেছেন মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সেবাস্টিয়ান যোসেফ। তিনি বলেন টিপু সুলতানকে ভারতীয় ইতিহাসের একজন ‘খলনায়ক’ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘টিপু সুলতানকে নিয়ে যা বলা হচ্ছে, সেগুলো রাজনৈতিক কথাবার্তা। টিপু সুলতানকে একজন খলনায়ক করে তোলার এই প্রচেষ্টাটা কয়েক বছর ধরেই শুরু হয়েছে।
এই প্রথম নয়, এর আগেও কর্নাটকে সরকারিভাবে যে টিপু জয়ন্তী পালিত হত, তা-ও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বিজেপি-র আমলে।
বিজেপি এবং হিন্দু পুনরুত্থানবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস মনে করে টিপু সুলতান কুর্গ, মালাবার সহ নানা এলাকায় কয়েক লক্ষ হিন্দুকে মেরে ফেলেছিলেন এবং বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করেছিলেন।
আরএসএসের মতাদর্শে বিশ্বাস করে, এমন একটি সংগঠন, ইতিহাস সংকলন সমিতির পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং ইতিহাসের অধ্যাপক রবিরঞ্জন সেন বলছিলেন, তার মতে, বাস্তবে যা যা করেছেন টিপু সুলতান—সবটাই থাকা উচিত।
টিপু সুলতান যে হিন্দুদের ওপরে নিপীড়ন চালিয়েছিলেন বা লক্ষ লক্ষ হিন্দুকে মেরে ফেলেছিলেন বলে আর এসএস যা দাবী করে, তা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন অধ্যাপক যোসেফ।
তিনি বলেন, ‘টিপু সুলতানকে নিয়ে যত গবেষণা হয়েছে, তাতে এরকম তথ্য বিশেষ পাওয়া যায় না যে তিনি নির্দিষ্টভাবে হিন্দুদের ওপরেই অত্যাচার করেছিলেন’।
অধ্যাপক যোসেফ বলেন, ‘কুর্গ বা মালাবার উপকূলে যুদ্ধ নি:সন্দেহে হয়েছিল সেখানকার হিন্দু শাসকদের সঙ্গে। এবং সেই যুদ্ধে অনেক হিন্দুর যে প্রাণ গিয়েছিল, সেটা অস্বীকার করা যাবে না – কিন্তু সেটাকে একটা ধর্মীয় অত্যাচার বলা ভুল’।
তিনি বলেন, মহাভারতের কাহিনিতে তো যারা নিহত হয়েছিলেন, তারাও হিন্দুই ছিলেন। আবার মারাঠারা যখন মহীশূর দখল করতে এসেছিল, তখন তারা অতি পবিত্র হিন্দু তীর্থ শৃঙ্গেরি মঠ ধ্বংস করে দিয়েছিল—এমনকী বিগ্রহটিও ধ্বংস করে দেয় তারা।
অধ্যাপক যোসেফ ব্যাখ্যা করছিলেন, ‘শৃঙ্গেরি মঠ পুণর্নিমানে অর্থ দিয়েছিলেন টিপু সুলতান। এগুলোকে তো ধর্মীয় নিপীড়ন বলা যায় না’।
টিপু সুলতান যখন ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধে যেতেন, রাজ্যের সর্বেসর্বা হয়ে শাসন চালাতেন একজন হিন্দু—পুন্নাইয়া। আবার মালাবার দখল করার সময়েও টিপুর সেনাপতি ছিলেন শ্রীনিবাস রাও—তিনিও হিন্দু।
অধ্যাপক যোসেফের যুক্তি, ‘টিপুর পরেই যার হাতে সব ক্ষমতা, সেই পুন্নাইয়া, কুর্গে হিন্দুদের ওপরে অত্যাচার করতে দিয়েছেন, এটা কি যুক্তিগ্রাহ্য বা হিন্দু হয়েও শ্রীনিবাস রাও মালাবারে হিন্দুদের ধর্মান্তকরণ করানোতে মদত দিয়েছিলেন—সেটা কি মেনে নেওয়া যায়’?
টিপু সুলতান ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হওয়ার পরে তার ১২জন পুত্র এবং পরিবার পরিজন সবাইকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয় ব্রিটিশ সরকার।
সেই থেকে কলকাতাতেই টিপুর পরিবারের বসবাস। শহরের সবথেকে পরিচিত মসজিদ ‘টিপু সুলতান মসজিদ’ যেমন এই কলকাতাতেই, তেমনই তার পুত্র আনোয়ার শাহ এবং পরিবারের আরও কয়েকজনের নামে রয়েছে শহরের বড় বড় কয়েকটি রাস্তার নাম।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২৬
আপনার মতামত জানানঃ