কিছুদিন আগেও তুরস্ক বলত, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে ফিলিস্তিনিদের প্রতি তেল আবিবের আচরণের ওপর। ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমিও ইতিহাস থেকে প্রায় মুছে দিয়েছে ইসরায়েল। মুসলমানদের কাছে তারা মসজিদুল আকসা দখলকারী।
গত কয়েক বছর মধ্যপ্রাচ্যের আরব শাসকেরা একের পর এক ইসরায়েলের কাছে নিজেদের সমর্পণ করে চলেছেন। এরদোগান তখন তার বিরোধী ছিলেন। আরব দেশগুলো এভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে থাকলে ফিলিস্তিনিদের প্রতি বর্বর আচরণ আরও গতি পাবে, এটাই ছিল এরদোগানের যুক্তি।
সেই বর্বরতায় বড় কোনো পরিবর্তন চোখে পড়েনি কারও, কিন্তু মুসলিম বিশ্বের অন্যতম নেতা এরদোগানের ইসরায়েল নীতি দ্রুত পাল্টাচ্ছে। সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রেসিডেন্টকে তুরস্কে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান।
কেন এই ঘনিষ্ঠতা?
মাঝের অস্বস্তিকর কয়েকটা বছর কাটিয়ে এরদোগান এখন মনে করছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে বন্ধুত্ব জরুরি তার জন্য। গত কয়েক বছর ধরে তুরস্কে ইহুদিদের নানান বৈঠকে এরদোগানকে দেখা যাচ্ছিল।
আইজ্যাক হার্জগ প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর গত জুলাইয়ে এরদোগান অভিনন্দন জানাতেও দেরি করেননি। সেবার ৪০ মিনিট ধরে কথা বলেছিলেন তারা। স্পষ্টত ওটা দায়সারা এবং সৌজন্যমূলক ছিল না শুধুই। সম্প্রতি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আরও খোলামেলাভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন।
ইসরায়েলের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কও অনেক বিস্তৃত। বছরে অন্তত পাঁচ লাখ ইহুদি তুরস্ক যান বেড়াতে। তুরস্ক বছরে অন্তত ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে ইসরায়েলে। আমদানির পরিমাণও বছরে গড়ে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার। ১৯৯৭ থেকে উভয় দেশের মধ্যে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি কাজ করছে। তুরস্ক এই চুক্তির পরিসরও আরও বাড়াতে আগ্রহী।
এবার কেবল ইসরায়েলের নেতাদের আঙ্কারায় স্বাগত জানানোই নয়, দেশটির সঙ্গে মিলে ইউরোপমুখী একটা গ্যাস পাইপলাইনও বানাতে ইচ্ছুক এরদোগান। গ্যাস-অর্থনীতির বাইরেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নেও তেল আবিবকে দরকার তুরস্কের।
এরদোগানের চলতি কূটনীতিক মোড় পরিবর্তন সে লক্ষ্যেও। গত বছর পাঁচেক থেকে এরদোগান যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ইহুদি সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছেন, পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন করছেন।
মূলত, যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে ইহুদিদের অদৃশ্য ভূমিকা এরদোগানের বিশেষভাবে দরকার, তার মানবাধিকারবিরোধী ইমেজকে কিছুটা হলেও আড়াল করতে। অন্তত আগামী বছরটা এরদোগান নির্বিঘ্নে পেরোতে চান। ২০২৩ সাল তুরস্ক এবং এরদোগান উভয়ের জন্য ঐতিহাসিক বছর। আধুনিক তুরস্কের শততম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এটা।
দেশটিতে নতুন নির্বাচনও হবে তখন। নিশ্চিতভাবেই এরদোগান তাঁর প্রায় দুই দশকের শাসনকালের মেয়াদ তখন আরও বাড়াতে আগ্রহী হবেন। যদিও সেটা ঠিক হবে কি না, তা নিয়ে তুরস্কজুড়ে বিপুল বিতর্ক আছে।
তবে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি এরদোগান কীভাবে গাজায় হামাসের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখেন, সেটা এখন নজর রাখার মতো বিষয়। ক্ষমতাসীন এ কে পার্টির ইসরায়েলবিরোধী কর্মীরা কীভাবে তাদের চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক মোড়বদল মেনে নেন, সেও দেখার বিষয়। এই দলের কর্মীরা এত দিন এরদোগানের কাছেই শুনে এসেছে—ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ হলো ইসরায়েল-তুরস্ক সম্পর্কের লাল রেখা।
তুরস্ক ও ইসরায়েলের অতীত সম্পর্ক
ইসরায়েল ও তুরস্কের মধ্যে গত ১৩ বছর প্রকাশ্যে কূটনীতিক যোগাযোগ নেই। এই জানুয়ারিতে সেই দূরত্বের অবসান হয়েছে। দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথাবার্তা হয়েছে। এটা এখন দুনিয়াজুড়ে বড় খবর। অতি উৎসাহীরা একে উভয় দেশের সম্পর্কের ‘রেনেসাঁ’ বলেছে।
বিশ্ব গণমাধ্যমের এই মৃদু হইচইয়ের কারণ— এরদোগান ক্ষমতায় এসে প্রায় জিহাদে নেমেছিলেন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। অথচ অতীতের দিকে ফিরে তাকালে দেশ দুটির মধ্যে ‘কাছে থাকার’ বিবরণই কেবল পাওয়া যায়।
তেল আবিবে যেমন বরাবর তুরস্কের দূতাবাস ছিল, তেমনি সে দেশের অন্তত দুই জায়গায় ইসরায়েলেরও কূটনীতিক দপ্তর আছে। ২০০৭ সালে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেস তুরস্কের জাতীয় পরিষদে ভাষণ দেওয়ার বিরল সুযোগ ও সম্মান পেয়েছিলেন।
তবে ২০০৯ সালে গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতা এবং পরের বছর তাদের নৌ-কমান্ডোদের হাতে গাজামুখী তুরস্কের শান্তিবাদীদের এক জাহাজে ১০ জনকে খুন দেশটির সঙ্গে বন্ধুত্ব চালিয়ে যেতে এরদোগানের জন্য অস্বস্তির কারণ ঘটায়।
গাজার অবরোধ ভাঙতে চাওয়া তুরস্কের শান্তিবাদীদের ওই খুনকে এরদোগান একাধিকবার ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ২০১৩ সালের মার্চে জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে এরদোগান এও বলেন, ইহুদিবাদের অপর নাম ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’। গত বছর মে মাসে আল-আকসায় ইসরায়েলি সৈনিকদের অবরোধকালেও এরদোগান দেশটিকে আরেকবার ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
কূটনীতিক সম্পর্কের বাইরেও ইসরায়েলের সঙ্গে তুরস্কের রয়েছে অতি পুরোনো সামরিক ও গোয়েন্দা সম্পর্ক। যুদ্ধাস্ত্রের উন্নয়ন ও বিনিময়ে উভয়ের সহযোগিতার সম্পর্ক অনেক দিনের। এ বিষয়ে উভয়ের মধ্যে একটা চুক্তিও হয় ১৯৯৬ সালে। বহুকাল পরস্পরের পাইলটরা একে অপরের দেশে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। ২০১১ সালে এসবে এক দফা বিরতি আসে তুরস্কের তরফ থেকে। এখন নিশ্চিতভাবেই সম্পর্ক আগের জায়গায় ফিরবে।
মুসলিম-প্রধান দেশগুলোর মধ্যে তুরস্কই প্রথম ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। ২০০৫ সালে খোদ এরদোগানও ইসরায়েল সফর করেছিলেন। সেই সফরে নির্বিঘ্নেই হাত মিলিয়েছিলেন সাবরা-শাতিলা গণহত্যার খলনায়ক কুখ্যাত এরিয়েল শ্যারনের সঙ্গে। ফলে এখন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট বা প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হার্জগকে স্বাগত জানাতে কুণ্ঠিত হওয়ার বিশেষ কারণ নেই।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫২৫
আপনার মতামত জানানঃ