আজ থেকে ৪৫০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর জন্ম হয়েছিল। তারপর থেকেই এর ভেতরটা ক্রমাগত ঠান্ডা হচ্ছে। যদিও পৃথিবীপৃষ্ঠের আবহাওয়া ও বায়ুমণ্ডল সময়ের সাথে সাথে বারবার ওঠানামা করেছে এবং এখনো করছে, পৃথিবীর ভেতরটা শুরু থেকে কেবল শীতলই হচ্ছে। সূত্র: দ্য এক্সপ্রেস ডটইউকে
পৃথিবীর গভীরে থাকা উপাদানগুলোর কারণেই পৃথিবীর নিজস্ব চুম্বকীয় ক্ষেত্র রয়েছে। এই চুম্বকীয় ক্ষেত্র বা ম্যাগনেটিক ফিল্ডের কারণে পৃথিবী এখনো টিকে আছে। ম্যাগনেটিক ফিল্ডটির কোনোপ্রকার বিচ্যুতি ঘটলে পৃথিবীতে আর প্রাণের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।
কিন্তু পৃথিবীর অভ্যন্তরের তাপমাত্রা এভাবে কমতে থাকলে একসময় এর ভেতরে থাকা তরল জ্বলন্ত উপাদানগুলো কঠিন পদার্থে পরিণত হবে। এর ফলে ভূতাত্ত্বিক কাজগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। ভূতাত্ত্বিক বিভিন্ন ঘটনা যেমন টেকটনিক অ্যাক্টিভিটি, ভূঅভ্যন্তরে তাপের পরিচলন, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ইত্যাদির কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা ও বৈশ্বিক কার্বন সাইকেল ঠিক থাকে।
তাহলে যদি ভূঅভ্যন্তরের পদার্থগুলো শক্ত হয়ে যায়, তাহলে এ ভূতাত্ত্বিক কাজগুলো বন্ধ হয় যাবে। আর এর ফলে পৃথিবী নিজেই একটি জড়বৎ নিষ্প্রাণ গ্রহে পরিণত হবে। পৃথিবীর সাথে মঙ্গল বা বুধগ্রহের কোনো পার্থক্য থাকবে না।
নতুন এক গবেষণায় জানা গেছে এমন ঘটনা ঘটতে পারে দ্রুতই। মানে আগে এরকম পরিস্থিতির জন্য যে সময়ের কথা ভেবেছিলেন বিজ্ঞানীরা, তার আগেই এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে আমাদের এই গ্রহে।
আমাদের পৃথিবী নামক গ্রহটি সৃষ্টির আদিকাল থেকেই এর অভ্যন্তরের বিপুল পরিমাণ উত্তাপ ভূপৃষ্ঠে নির্গত করে আসছে। তাপ নির্গমনের এই প্রক্রিয়ায় চালিত হয় পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরে অবস্থিত ভূগোলক (কোর) এবং তার সাথে টেকটনিক প্লেটগুলোর সঞ্চালন।
পৃথিবীর ‘কোর’ বলে পরিচিত অভ্যন্তরের গলিত অংশটির একদম বাইরের আবরণ বা ‘ম্যান্টল’- এর উপর ভাসমান টেকটনিক প্লেট।
তাহলে যদি ভূঅভ্যন্তরের পদার্থগুলো শক্ত হয়ে যায়, তাহলে এ ভূতাত্ত্বিক কাজগুলো বন্ধ হয় যাবে। আর এর ফলে পৃথিবী নিজেই একটি জড়বৎ নিষ্প্রাণ গ্রহে পরিণত হবে। পৃথিবীর সাথে মঙ্গল বা বুধগ্রহের কোনো পার্থক্য থাকবে না।
পৃথিবীর অভ্যন্তরের তাপ সঞ্চালন প্রক্রিয়াতে অত্যন্ত অপরিহার্য ভূমিকা রয়েছে কোর ও ম্যান্টেল এর সীমানা। এখানেই উত্তপ্ত ও গলন্ত কোর অপেক্ষাকৃত জমে যাওয়া ম্যান্টেলের শক্ত শিলাস্তরের খনিজের সংস্পর্শে আসে। এভাবে উপরিভাগের আস্তরণ বা ম্যান্টেলে সঞ্চারিত হয় পৃথিবীর গভীরের উত্তাপ।
এই সীমানায় থাকা তাপ পরিবাহী খনিজ হলো ব্রিজমেনাইট। এটি কতটা দক্ষতার সাথে কোরের উত্তাপ ভূপৃষ্ঠ পর্যন্ত বয়ে আনছে তা জানতে অনুসন্ধান চালান বিজ্ঞানীরা।
সে গবেষণায় উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন এই খনিজ এত বিপুল পরিমাণ উত্তাপ শুষে ভূপৃষ্ঠে বয়ে আনতে সাহায্য করছে যে বিস্ময়কর গতিতে পৃথিবী হারাচ্ছে তার অভ্যন্তরের উত্তাপ।
কেন এমনটি ঘটছে তা জানতে ফিরে দেখতে হবে পৃথিবী গঠনের ইতিহাস। সাড়ে ৪শ কোটি বছর আগে পৃথিবী গঠনের আদি মুহূর্তে চারপাশে ছিল ম্যাগমার (গলন্ত খনিজ) সমুদ্র। সেই ম্যাগমা ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে আমাদের আজকের পরিচিত ভূপৃষ্ঠ গঠন করলেও, গভীরে রয়ে যায় উত্তপ্ত ম্যাগমা।
কিন্তু, পৃথিবীর অভ্যন্তর এখনও উত্তাপ নির্গত করে চলেছে, ফলে এক সময় শীতল হয়ে পড়বে। তখন আমাদের পৃথিবী পরিণত হবে মঙ্গল বা বুধের মতো বিরান প্রাণহীন গ্রহে।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো- পৃথিবীর অভ্যন্তরের তাপ নিস্ক্রিয় হলে বিনষ্ট হবে ভূ-চুম্বকীয় ক্ষেত্র। বায়ুমণ্ডলও তখন মধ্যাকর্ষণের বাঁধনমুক্ত হবে সহজে। পৃথিবী হারাবে প্রাণদায়ী বিভিন্ন গ্যাস, বায়ুমণ্ডলের সুরক্ষা ছাড়া সরাসরি সুর্যালোকে বাষ্পীভূত হবে সাগর-মহাসাগরের সমস্ত পানি। এক কথায় কোনো প্রাণীর জীবনধারণের পরিবেশ থাকবে না।
বিজ্ঞানীরা তাদের সাম্প্রতিক গবেষণায় ব্রিজমেনাইটের একটি স্ফটিককে পালস লেজার দিয়ে বিকিরিত করেন। এর ফলে স্ফটিকের উত্তাপ ২ হাজার ৪৪০ ডিগ্রী কেলভিনে পৌঁছায়, আর সৃষ্টি হয় ৮০ গিগাপ্যাসকেলের মতো প্রচণ্ড চাপ। ম্যান্টেলের নিম্ন অংশেও ঠিক একইরকম তাপ ও চাপ কাজ করে। একদম নিচের অংশে যা সর্বোচ্চ হতে পারে ২ হাজার ৬৩০ কেলভিন ও ১২৭ গিগাপ্যাসকেল।
গবেষণায় নেতৃত্বদানকারী গ্রহবিজ্ঞানী মোতোহিকো মুরাকামি বলেন, ‘এভাবে আমরা ব্রিজমেনাইটের তাপ পরিবাহী ক্ষমতা মেপেছি, তাতে জানা গেছে এটি আমাদের ধারণার চেয়ে দেড় গুণ বেশি তাপ শোষণ ও সঞ্চালনে সক্ষম’।
এই গবেষণা বলছে প্রাকৃতিক চক্রেই পৃথিবীর অভ্যন্তর অত্যন্ত দ্রুত গতিতে উষ্ণতা হারাচ্ছে।
উত্তাপ হারালে ব্রিজমেনাইট খনিজ পোস্ট-পেরোভস্কাইটে পরিণত হয়। কোর ও ম্যান্টেলের সীমায় পোস্ট-পেরোভস্কাইটের পরিমাণ বাড়লে ম্যান্টেলের নিম্ন অংশ আরো দ্রুত শীতল হয়ে উঠতে পারে।
তাছাড়া এই খনিজ ব্রিজমেনাইটের চেয়েও জোরালো তাপ পরিবাহী বলে অনুমান করছেন বিজ্ঞানীরা।
মুরাকামি বলেন, ‘পৃথিবীর বিচিত্র পরিবর্তন চক্র জানার ক্ষেত্রে এসব তথ্য নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তারা স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে, বুধ ও মঙ্গল গ্রহের মতোই শীতল হয়ে আসছে আমাদের পৃথিবী। আর তা হচ্ছে আমাদের পুর্বানুমানের চেয়েও জোর গতিতে’।
তবে এ সময়টা কখন, বা কত দ্রুত পৃথিবীর ভেতর শান্ত হচ্ছে তার কোনো নির্দিষ্ট ডেটা বিজ্ঞানীদের কাছে নেই। তারা শুধু জানতে পেরেছেন পৃথিবীর শীতল হওয়ার গতি অনেক বেশি। আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্স লেটার্স-এ এ সংক্রান্ত একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। তবে এতে ভয়ের কিছু নেই, বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছেন এভাবে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার আগেই অন্য কোনো কারণে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৫২
আপনার মতামত জানানঃ