আফগানিস্তান দখলের পর থেকে তালিবানরা ক্ষমা প্রার্থনা করে নানারকম প্রতিশ্রুতি দিলেও তাদের শাসন প্রক্রিয়ায় কট্টরপন্থী আফগান নাগরিকরা অতিষ্ট হয়ে আছেন। বাস্তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তালিবান তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। তাদের বিরুদ্ধে বেসামরিক লোকজনদের রাস্তাঘাটে হত্যা, প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের হত্যা এবং মুখ খোলার জন্য নারীদের মারধরের অভিযোগ উঠেছে।
গত বছরের আগস্টে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে তালিবান। এরপর থেকেই তারা নারীদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে থাকে। নারীদের পুরুষ সঙ্গী ছাড়া দূরবর্তী স্থানে ভ্রমণে নিষেধ করা হয়েছে, গাড়িচালকদের আহ্বান জানানো হয়েছে বোরকা ছাড়া গণপরিবহনে উঠতে না দিতে।
এমতাবস্থায় দেশটির নারীরাও বসে নেই। তারাও তালিবান সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের বিরোধিতা করছে।
তবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবার তামানা পারিয়ানি, পারায়ান ইব্রাহিমখেল ছাড়াও আরও কয়েকজন নারী কর্মী আফগানিস্তানে নিখোঁজ হয়েছেন।
তবে তালিবান নারী আন্দোলন কর্মীদের আটকের বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তারাও নিখোঁজ নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যদিও এর আগে তালিবান নারী কর্মীদের বেআইনিভাবে কণ্ঠ রোধ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিল।
গত ১৬ জানুয়ারি, পারিয়ানি ও ইব্রাহিমখেল কাবুলে তালেবানবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এর ঠিক ২ দিন পরই ১৯ জানুয়ারি, সশস্ত্র কিছু ব্যক্তি নিজেকে তালিবান গোয়েন্দা বলে পরিচয় দিয়ে দরজা ভেঙে ৩ বোনসহ পারিয়ানিকে ধরে নিয়ে যায়। সশস্ত্র ব্যক্তি বাড়িতে ঢোকার আগ মুহূর্তের একটি ভিডিও পোস্ট করেন পারিয়ানি।
ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে ইব্রাহিমখেলের ক্ষেত্রে। তাদের খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি।
ক্ষমতায় আসার পর তালিবান দেশটির নারীদের কাজ ও পড়াশোনার অধিকারের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। দেশের বেশির ভাগ অংশে নারীদের মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা নিষিদ্ধ করেছে। শান্তিপূর্ণ নারী বিক্ষোভকারীদের মারধর, পিপার স্প্রে নিক্ষেপ করেছে।
এমনকি এসব বিষয়ে সাংবাদিকদের স্বাভাবিক কার্যক্রম সীমিত করতে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ ছাড়া সাংবাদিকদের আটক ও মারধর ছাড়াও আগের প্রশাসনের কর্মকর্তাদের গুম করার অভিযোগ আসছে তালিবানের বিরুদ্ধে।
২৩ জানুয়ারি নরওয়ের রাজধানী অসলোতে তালিবান কর্তৃপক্ষ এবং বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশের সঙ্গে আলোচনা চলাকালীন আফগান কর্মী হোদা খামোশ প্রকাশ্যে তালিবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুত্তাকিকে বলেন, ‘এখনই কাবুলে ফোন করুন, অবিলম্বে তাদের (গুম হওয়া নারীদের) মুক্তির নির্দেশ দিন।’
সাংবাদিকদের স্বাভাবিক কার্যক্রম সীমিত করতে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ ছাড়া সাংবাদিকদের আটক ও মারধর ছাড়াও আগের প্রশাসনের কর্মকর্তাদের গুম করার অভিযোগ আসছে তালিবানের বিরুদ্ধে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে তালিবান তাদের সদস্যদের জবাবদিহির আওতায় আনতে ব্যর্থ হচ্ছে। তবে যে কোনো গুম-খুনে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে সংগঠনটি।
এ ছাড়া তালিবান দাবি করে থাকে যে, তারা নারীদের শিক্ষার অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়। এ বছরের মার্চ মাস থেকে পুরো আফগানিস্তানের মাধ্যমিক স্কুলগুলো মেয়েদের জন্য খুলে দেয়ার পরিকল্পনা আছে তাদের। তালিবান কর্তৃপক্ষ শুরু থেকেই বলে আসছে, তারা শরীয়াহ-এর আলোকে নারীদের সব ধরনের অধিকারই দেবে। কিন্তু সেটা বলা পর্যন্তই।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত মধ্য আগস্টে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসার পর তালিবান নেতারা ক্ষমতাচ্যুত আফগান সরকার এবং সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ক্ষমা করে দেওয়া এবং তাদের ওপর প্রতিশোধ না নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশটির সাবেক নিরাপত্তা বাহিনীর শতাধিক সদস্যকে হত্যা অথবা গুম করেছে।
সংস্থাটি বলেছে, তালিবান নেতারা ক্ষমতাচ্যুত আফগান সরকার এবং সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ক্ষমা করে দেওয়া এবং তাদের ওপর প্রতিশোধ না নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও স্থানীয় তালিবান কমান্ডাররা সাবেক ওইসব সেনা ও পুলিশ সদস্যকে হত্যার নিশানা করেছে।
গত ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ তালিবানের হাতে চলে যায়। এর আগে দেশ ছেড়ে পালান তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। কাবুল দখলের পর তালিবান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিল। এতে বলা হয়েছিল, যারা সরকারের পুলিশ, সেনাবাহিনী কিংবা বিভিন্ন প্রদেশেও কাজ করেছেন, তারা তালিবান সরকারের আমলে নিরাপদে থাকবেন। যদিও এই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর থেকেই তা নিয়ে সন্দেহ ছিল। কারণ, দেশটির সাধারণ মানুষ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হত্যার রেকর্ড রয়েছে তালিবানের। বিশেষ করে ২০২০ সালের শুরু থেকে চলতি বছর ক্ষমতা দখলের আগপর্যন্ত প্রায় ১৮ মাসে বেশ কিছু নৃশংস হামলা চালায় তালিবান। এসব হামলার ভুক্তভোগীদের মধ্যে রয়েছেন বিচারক, সাংবাদিক, অধিকারকর্মীও।
এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তালিবান ক্ষমতা দখলের পরও অব্যাহত ছিল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, তালিবান ক্ষমতায় আসার আগে দিয়ে তাদের সমালোচনায় মুখর হতে পারে এমন মানুষদের নির্মূল করা এবং বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করার জন্য ওই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে।
এইচআরডব্লিউ বলেছে, তালিবান ক্ষমতা নেওয়ার পর আদেশ দিয়েছিল, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা আত্মসমর্পণ করে নিবন্ধন করুন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যে চিঠি দেওয়া হচ্ছে, তা সংগ্রহ করুন। কিন্তু ঘটনা ঘটেছে উল্টো। আত্মসমর্পণ করে নিবন্ধনের পর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের অনেকে সেখানে গুম হয়েছেন বা তাদের হত্যা করা হয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, তালিবান তাদের পূর্ববর্তী সরকারের বিভিন্ন নথি ধরে সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের খুঁজে বের করে হত্যা অথবা গুম করেছে।
গত আগস্টে ক্ষমতা দখলের পর তালিবান একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু পশতুন নৃগোষ্ঠীর সুন্নি আলেম প্রভাবিত একটি পুরুষ মন্ত্রিসভা বেছে নিয়েছে তারা। প্রতিশোধমূলক হত্যা, সাংবাদিকদের উপর হামলা, নারী অধিকার হরণসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তালিবানের বিরুদ্ধে।
তালিবানের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ এনেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। দেশটির সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়ের ওপর হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চালিয়েছে গোষ্ঠীটি। আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়ের কমপক্ষে ১৩ সদস্যকে হত্যা করেছে দেশটির ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তালিবান।
তবে চলতি বছর হাজারাদের ওপর তালিবানের চালানো হত্যাকাণ্ড এটিই প্রথম নয়। গত ১৯ আগস্ট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, আফগানিস্তান দখলে নেওয়ার আগে গত জুলাই মাসে দেশটির গজনি প্রদেশে হাজারা সম্প্রদায়ের ৯ ব্যক্তিকে হত্যা করে তালিবান।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত জঙ্গিপ্রবণ আফগানিস্তানে হাজারারা নিষ্পেষিত— এ কথা প্রমাণ দিয়ে বলা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে এমন আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে যে, আফগানিস্তানে আসলে কারা সুরক্ষিত? কেউ নয়। জোর দিয়ে বলা যায়, যত দিন ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষ হত্যা বন্ধ না হবে, ততদিন শান্তি ফিরবে না আফগান মুল্লুকে। আর ততদিন শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না হাজারারা। ফলে শান্তির জন্য আফগানিস্তানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বহু বিভক্ত আফগানিস্তানে সেই সম্প্রীতি কবে হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬১২
আপনার মতামত জানানঃ