আমেরিকান মুসলমানদের কাছে আইকন হয়ে ওঠা কিংবদন্তি মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলির ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া নিয়ে রয়েছে অনেক জল্পনা। মোহাম্মদ আলির ধর্মান্তরিত হওয়ার সিদ্ধান্ত তার ব্যক্তি ও কর্মজীবনে রেখেছে সুদূরপ্রসারী প্রভাব। ঠিক কী কারণে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন?
এটা জানতে ফিরে যেতে হবে সময়টা ১৯৬৪ সাল। তার মাত্র কয়েক বছর আগেই ধর্মান্তরিত হয়েছেন তিনি। হঠাৎই একদিন তুচ্ছ ব্যাপারে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েন আলি। স্ত্রী বেলিন্ডার ভাষায়, তর্কের এক পর্যায়ে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন আলি।
মানবিকতা আর বিনয়ের সব চিহ্ন যেন তার ভেতর থেকে হারিয়ে যাচ্ছিল। অনেকটা সর্বশক্তিমানের মতো আচরণ করছিলেন তিনি। এমন পরিস্থিতির মুখে বেলিন্ডা তাকে বললেন, “তুমি নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলতে পারো, কিন্তু তুমি কখনই আল্লাহ’র চেয়ে বড় হতে পারবে না।”
এরপর আলিকে শান্ত হয়ে বসতে বললেন বেলিন্ডা; সেইসঙ্গে একটি চিঠিও লিখতে বললেন। কেনো তিনি মুসলিম হলেন সে সম্পর্কে তাকে লিখতে বলেছিলেন বেলিন্ডা। আলি বাধ্য ছেলের মতো বসলেন, কয়েক টুকরো সাদা কাগজ এবং একটি নীল রঙের কলম বের করে লিখতে শুরু করলেন।
মোহাম্মদ আলি কেনো ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, সেই ব্যাখ্যা বেলিন্ডার জন্য লেখা ওই চিঠিতেই পাওয়া যায়। চিঠিতে আলি লুইসভিলেতে তার কৈশোর জীবনের স্মৃতি বর্ণনা করেছেন, যখন তার নাম ছিল ক্যাসিয়াস ক্লে জুনিয়র। রাস্তা দিয়ে স্কেটিং করার সময় তখন ফুটপাত দিয়ে কোনো সুন্দরী নারী হেঁটে যাচ্ছে কি না, তা নজরে রাখতেন আলি।
আর এ কাজ করতে গিয়েই তিনি মুসলিম সংগঠন ‘নেশন অব ইসলাম’ এর পক্ষে পত্রিকা বিক্রি করতে দেখেন এক ব্যক্তিকে। ওই সংগঠন ও সংগঠনের নেতা এলিজাহ মোহাম্মদ সম্পর্কে আলি আগে থেকেই শুনেছিলেন, কিন্তু সংগঠনটিতে যোগ দেওয়ার বিষয়টি তখনও তিনি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেননি। সংগঠনটি ইসলামের আলোকে আত্মোন্নয়ন ও কৃষ্ণাঙ্গদের বিচ্ছিন্নতার কথা প্রচার করত।
একদিন ওই সংগঠনের পত্রিকা কেনেন আলি। পত্রিকায় প্রকাশিত একটি কার্টুন ছবি তার নজরে আসে। ছবিটিতে দেখানো হয়েছিল, এক শ্বেতাঙ্গ মালিক তার কৃষ্ণাঙ্গ দাসকে মারধর করছেন এবং যিশুর কাছে প্রার্থনা করার জন্য তাকে বাধ্য করছেন। কার্টুনের বার্তা ছিল অনেকটা এরকম— শ্বেতাঙ্গরা তাদের দাসদের ওপর খ্রিষ্টধর্ম চাপিয়ে দিচ্ছে জোর করে। ওই কার্টুন ছবিটিই আলির মনে দাগ কাটেছিল।
ইসলামের প্রতি আলি কেন আকৃষ্ট হয়েছিলেন, তার কোনো আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা নেই ওই চিঠিতে। বরং বাস্তবতার আলোকেই বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। পত্রিকার কার্টুন তার বিবেককে জাগিয়ে তুলেছিল। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, খ্রিষ্টধর্ম তার পছন্দ নয়। ক্যাসিয়াস ক্লে নামটিও তার ভালো লাগত না।
নিজের নাম সম্পর্কে আলি একবার বলেছিলেন, “ক্যাসিয়াস ক্লে একটি দাসত্ব বোধক নাম। আমি তা ঠিক করি নি এবং রাখতেও চাই না। আমি মোহাম্মদ আলি; একটি স্বাধীন নাম- এর অর্থ সৃষ্টিকর্তার প্রিয়; এবং আমি চাই মানুষ যখন আমার সঙ্গে বা আমার সম্পর্কে কথা বলবেন, সবাই এই নামটিই ব্যাবহার করুন।”
১৯৬৪ সালে ২২ বছর বয়সে বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নেওয়ার পর, তিনি জনসমক্ষে নিজের খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ, ইসলাম গ্রহণ ও নিজের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন, “আমি আল্লাহ এবং শান্তিতে বিশ্বাস করি। আমি শ্বেতাঙ্গ প্রতিবেশীদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করব না। আমি শ্বেতাঙ্গ কোনো নারীকেও বিয়ে করতে চাই না। ১২ বছর বয়সে আমি খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হই। তবে আমি কী করছি, তখন তা জানতাম না। আমি আর এখন খ্রিষ্টান নই।”
পরবর্তী বছরগুলোতে আলি তার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি অন্বেষণ করতে থাকেন। যদিও সবসময় তার দর্শন স্পষ্ট ছিলনা। তিনি যে নীতিগুলো সমর্থন করতেন, সেগুলো তিনি সব সময় মেনেও চলতেন না। কিন্তু তিনি কখনও নিজের অন্বেষণ বন্ধ করেননি।
নেশন অব ইসলামের নেতা এলিজাহ মোহাম্মদের মৃত্যুর পর সংগঠনটির আমূল সংস্কার করা হয়। এরপর আলি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং পবিত্র কোরআন পড়েন। পারকিনসনস রোগে আক্রান্ত হয়ে আলির কণ্ঠে জড়তা চলে আসলেও, তিনি প্রায়ই ধর্মীয় বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনার জন্য অন্যদের আমন্ত্রণ জানাতেন।
মোহাম্মদ আলির জীবনী নিয়ে লেখা গ্রন্থ ‘আলি: আ লাইফ’র রচয়িতা জনাথন ইগ তার গ্রন্থটি রচনার জন্য আলির স্ত্রী বেলিন্ডার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেসময় বেলিন্ডা তাকে ওই চিঠিটি দেন। সেই চিঠি থেকেই আলির ইসলাম গ্রহণের কারণ প্রকাশ পেয়েছে। চিঠিটি এখন আফ্রিকান আমেরিকান ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ক জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত রয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯০২
আপনার মতামত জানানঃ