টানা এক যুগ ধরে ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে এখন ৭২ বছরের প্রাচীন এই দলটি নিয়ে সংশয় সাধারণ মানুষের মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে পড়ছে দলটির মধ্যেও। দলীয় কোন্দল, ব্যক্তিগত স্বার্থ, ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণে টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় আসা সহজ হবে না দলটির জন্য।
এর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে সামনে এসেছে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের বিভাজন। দলীয় বিভাজনের ফলে নৌকার চেয়ে বিরোধীদের জয়ের হার বেড়েছে। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদেরও। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে দলটির নেতৃস্থানীয়দের কপালে।
এছাড়া কোথাও কোথাও এ বিভাজন রূপ নিয়েছে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে। গত পাঁচ ধাপের নির্বাচনী সংঘাতে ঘটেছে শতাধিক প্রাণহানি। আহত হয়েছেন হাজারের বেশি নেতাকর্মী। এতে আস্থা হারাচ্ছে মানুষ।
দলীয় সূত্র বলছে, এ নিয়ে কাজ করছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। তারা নৌকার বিরোধিতাকারীদের তালিকা করছেন। নৌকার বিরোধিতায় কারা ইন্ধন দিচ্ছে, কার কী ভূমিকা—সব খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেবে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। জাতীয় নির্বাচনের আগেই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে ঘর গোছাতে চায় ক্ষমতাসীন দলটি।তবে আওয়ামী লীগ নেতারাও মনে করছেন, এখনই রোগ নির্ণয় করে সারিয়ে তুলতে না পারলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
ভারী হচ্ছে পরাজয়ের পরিসংখ্যান
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত পাঁচ ধাপের ইউপি নির্বাচনের প্রথম ধাপে চেয়ারম্যান পদে নৌকা জিতেছে ৭৬ শতাংশ, দ্বিতীয় ধাপে ৫৯ শতাংশ, তৃতীয় ধাপে ৫৪ শতাংশ এবং চতুর্থ ধাপে ৫১ শতাংশ। পঞ্চম ধাপে নৌকা জেতার হার আরও কমেছে। অবশিষ্টদের মধ্যে বেশিরভাগ বিদ্রোহী প্রার্থী জিতেছে।
ফলাফলের চেয়ে ভয়ংকর তথ্য হলো, ভোট দিতে পারেননি নৌকার প্রার্থী, জালভোট দিতে গিয়ে নৌকার প্রার্থী আটক, অবরুদ্ধ নৌকার প্রার্থী বা নৌকা প্রতীকে ৫৬ ভোট— এ জাতীয় সংবাদ শিরোনাম সামনে এসেছে।
পঞ্চম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ফরিদপুরের একটি ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী লজ্জাজনক হার হেরেছেন। চেয়ারম্যান পদে ১১ জন প্রার্থীর মধ্যে তিনি পেয়েছেন মাত্র ৫৬ ভোট! আর এমন লজ্জাজনক হারে রেকর্ড গড়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্যাহর নির্বাচনী এলাকা সদরপুর উপজেলার চরমানাইর ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মো. বজলু মাতুব্বর।
শুধু তাই নয়, এ ইউনিয়নে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীও দুই শতাধিক ভোট পেয়েছেন। অথচ প্রতিটি ওয়ার্ড ও ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের কমিটিও আছে। এ ইউনিয়নে চশমা প্রতীক নিয়ে তিন হাজার ৩০০ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন মো. রফিকুল ইসলাম।
নেতাদের দুশ্চিন্তা
ইউপি নির্বাচন ও তৃণমূলের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা ইউনিটের সহ-সভাপতি বলেন, এই প্রতীক দিয়ে তৃণমূল আওয়ামী লীগে বিভাজন বেড়েছে। প্রতীক তুলে দিলে বরং ভালো হতো। কারণ নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া যায় বা নৌকার বিরোধিতা করলে কিছুই হয় না, এই মেসেজটা তৃণমূলে যাচ্ছে।
এটি খারাপ পরিণতির ইঙ্গিত করছে। এমনও নজির আছে, একটা ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে পাঁচজন প্রার্থী। একজন নৌকার, বাকি চারজন এক হয়ে গেছেন নৌকাকে হারাতে।
ঢাকার পার্শ্ববর্তী এক উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখনকার মনোনয়ন দেওয়া হয় টাকার বিনিময়ে বা স্বজনপ্রীতি করে। এ কারণে তুলনামূলক কম যোগ্য লোকের কাছে যাচ্ছে নৌকা। বিদ্রোহী বা তার চেয়ে যোগ্য লোক পাস করে যাচ্ছে, নৌকা হারছে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন জাগো নিউজকে বলেন, নৌকা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী-সমর্থকদের আবেগ-ভালোবাসার প্রতীক। আগে মনোনীত প্রার্থী পছন্দ না হলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতকতার প্রবণতা ছিল না, এমন নয়। এবারের ইউপি নির্বাচনে এর প্রবণতা আশঙ্কাজনক।
তিনি আরও বলেন, এখন সময় এসেছে আমাদের নিরপেক্ষ, নির্মোহ ও গভীরভাবে গবেষণা করতে হবে যে, অনেক ইউনিয়নে কেন নৌকার বিপক্ষে দলের তৃণমূল অবস্থান নিয়েছে। গবেষণার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করে তা প্রশমনের উদ্যোগ না নিলে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে একজন মাঠকর্মী হিসেবে আমি মনে করি।
দলটির তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, বিষয়টি আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা দেখছি কোথাও কোথাও নির্বাচনে ভেতরে ভেতরে সরকারের বিরুদ্ধে অনেকেই কাজ করেছেন। এগুলো আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। নৌকার প্রার্থী হারাতে পারলেই তারা আনন্দ পান, এরকম একটা বিষয়। নিরপেক্ষতা মানেই তারা মনে করেন নৌকাকে হারানো।
আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার সহ-সভাপতি কাদের খান বলেন, তৃণমূলের এই নির্বাচনে যে বিভাজন হয়ে গেলো এর প্রভাব তো জাতীয় নির্বাচনেও পড়বে। দেখা গেছে, নৌকার প্রতীক একজন পেয়েছে, বিদ্রোহী পাঁচজন ছিলেন। ওই পাঁচজন এক হয়ে নৌকার বিরুদ্ধে ভোট করেছেন।
এই কালচার তো জাতীয় নির্বাচনেও থাকবে। নৌকা প্রতীক নিয়ে যিনি ছিলেন, তিনি জাতীয় নির্বাচনে নৌকার পক্ষে গেলে, বিদ্রোহীরা তার বিরোধিতা করবে।
তিনি বলেন, নীতি নির্ধারকরা বুঝুক ব্যাপারটা। কেন তারা নৌকা প্রতীক দিতে গেলেন? কোন হিসেবে তারা ইউনিয়ন পরিষদে নৌকা দেন? এটা আমাদের বোধগম্য নয়। আমরা কোনো অবস্থাতেই তৃণমূলে নৌকা দেওয়ার পক্ষে নই। নৌকা শুধু জাতীয় নির্বাচনে ব্যবহার করা হোক।
কাদের খান বলেন, নৌকা দিলেও মনোনয়ন যদি সঠিকভাবে দেওয়া হতো, তাহলে এত বিদ্রোহী হতো না। বিদ্রোহী প্রার্থী কখন হয়? যখন একটা অযোগ্য লোক নৌকা পায়। তখন সব যোগ্য লোক এক হয়ে যায়। তখনই বিদ্রোহী প্রার্থী ছড়িয়ে যায়। আপনি মনোনয়ন দেবেন- যার যোগ্যতা নেই, হাইব্রিড, টাকাওয়ালা। তাহলে তো এই পরিস্থিতি দাঁড়াবেই।
কারা টাকা খাচ্ছে, এমন প্রশ্নের জাবাবে তিনি বলেন, ‘টাকা খেয়ে এমপি সাহেবরা এগুলো করছেন।’
বাড়ছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও ব্যক্তি স্বার্থ
সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচিত হয় নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাই আবদুল কাদের মির্জাকে ঘিরে কর্মকাণ্ড।
মির্জা এবং তার পাল্টা গ্রুপের মধ্যে কোন্দলের জেরে সেখানে দফায় দফায় সংঘর্ষ, অস্ত্রের ব্যবহার, হতাহতের ঘটনাও ঘটেছিল। এর পেছনে ক্ষমতা এবং গোষ্ঠীগত স্বার্থ ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
শুধু কোম্পানীগঞ্জেই নয়, দেশের বিভিন্ন জায়গায় দলটিতে কোন্দল প্রকট হয়েছে। দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে যে, দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকার কারণে ‘কিছু পাওয়া না-পাওয়ার’ প্রশ্নে আওয়ামী লীগে স্বার্থের দ্বন্দ্ব বেড়েছে।
বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে আওয়ামী লীগের একজন নেত্রী জিনাত সোহানা চৌধুরী বলেছেন, ব্যক্তিস্বার্থ বা সুবিধা পাওয়ার প্রশ্ন যখন সামনে আসছে, তখন মাঠের ত্যাগী নেতাকর্মীরা ‘নিস্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছেন।
তিনি আরও বলেছেন, সুবিধা পাওয়ার জন্য দলের বাইরে থেকেও অনেকে তাদের দলে আশ্রয় পাচ্ছেন। তারাই বেশি ক্ষতি করছে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সময় ক্ষমতার পালা বদলের সাথে সাথে বিভিন্ন দল থেকে যারা তাদের দল পরিবর্তন করে, এরকম কিছু সুবিধাবাদী মৌসুমী পাখির মতো লোকজন আমাদের দলে ঢোকার জন্য অপচেষ্টায় আছেন। তাদের অনেকে এ দলে এসেছেন।
বিশ্লেষকদের অনেকে আবার বলেছেন, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনকে অকার্যকর করার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া আওয়ামী লীগের প্রবল দাপটের মুখে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিও রাজনৈতিকভাবে অকার্যকর হয়ে রয়েছে।
সংসদে বিরোধীদল হিসাবে জাতীয় পার্টি থাকলেও তারা সরকারের অনুগত বলে মনে করা হয়। ফলে রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের সামনে কোন চ্যালেঞ্জ নেই। সে কারণেই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক তৎপরতা নেই বলে মনে করেন লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ।
তিনি বলেন, সরকার এবং রাষ্ট্রে এই দল বিলীন হয়ে গেছে। আর যেহেতু মাঠে কোন প্রবল প্রতিপক্ষ দৃশ্যমান নেই, ফলে বাইরে থেকেও কোন চ্যালেঞ্জ আসছে না।
তিনি আরও বলেন, এখন রাষ্ট্রের সঙ্গে এবং অন্যান্য সামাজিক শক্তি যারা রাষ্ট্রে স্টেকহোল্ডার, তাদের সাথে একটা রসায়ন তৈরি করে আওয়ামী লীগ যেভাবে ক্ষমতায় আছে, এখানে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি হয়ে গেছে। এখানে আর জনগণ কেন্দ্রিক রাজনীতিটা নেই।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪১৫
আপনার মতামত জানানঃ