সাধারণ নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তুলে সু চির সরকারকে হটিয়ে গত ১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা দখল করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। সঙ্গে সঙ্গেই এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন দেশটির সাধারণ মানুষ। শুরু হয় সংঘাত। এতে প্রাণ হারিয়েছেন দেড় হাজারের বেশি মানুষ এবং ১১ হাজারের বেশি মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছেন। এর প্রেক্ষিতে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে নিন্দার ঝড় বইতে থাকে। চাপ আসতে থাকে। সামরিক সরকারের নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের এবং বেশ কয়েকটি সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তারাই দেশটি থেকে গোপনে মূল্যবান সেগুন কাঠ আমদানি অব্যাহত রেখেছে, যাতে ফুলেফেঁপে উঠছে জান্তা সরকারের অর্থভাণ্ডার।
সম্প্রতি চাঞ্চল্যকর এ তথ্য সামনে এনেছে জাস্টিস ফর মিয়ানমার নামে একটি মানবাধিকার সংগঠন। খবর আল জাজিরার।
সংগঠনটি জানিয়েছে, গত ডিসেম্বর মাসেও মিয়ানমার থেকে সেগুন কাঠ নিয়েছে কয়েকটি মার্কিন প্রতিষ্ঠান, অথচ যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব দপ্তর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল গত বছরের এপ্রিলে। মার্কিন আমদানিকারকরা তৃতীয় পক্ষ ব্যবহার করে কৌশলে নিষেধাজ্ঞা এড়িয়েছে বলে জানিয়েছে জাস্টিস ফর মিয়ানমার।
প্রতিবেদনে বলেছে, মার্কিন কোম্পানিগুলির কাছে মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে ওই পণ্য রপ্তানি করেছে মিয়ানমার। তার কারণ এতে নিষেধাজ্ঞা এড়াতে সহজ হয়েছে। গ্লোবাল ট্রেড ডাটাবেস পরিসংখ্যান দেখিয়ে গ্রুপটি বলেছে, গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে নভেম্বরের মধ্যে মার্কিন কোম্পানিগুলোর কাছে প্রায় ১ হাজার ৬শ’ টন কাঠ পৌঁছেছে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে নভেম্বরের মধ্যে মার্কিন কোম্পানিগুলোর কাছে প্রায় ১ হাজার ৬শ’ টন কাঠ পৌঁছেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘পণ্যগুলো ৮২টি বিভিন্ন চালানে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে। মিয়ানমার থেকে রপ্তানি করা কাঠ মূলত সেগুন বোর্ড যা জাহাজ নির্মাণ, আউটডোর ডেকিং এবং আসবাবপত্রের জন্য ব্যবহৃত হয়।’
ওই মানবাধিকার গ্রুপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশের সরকারকে সেগুন বাণিজ্যকে আরও ভালভাবে আটকানোর জন্য চাপ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। তাদের মতে এই ধরনের রপ্তানি মিয়ানমারের সামরিক সরকারের তহবিল বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ধরনের বাণিজ্য সম্ভবত চীনের মতো তৃতীয় দেশগুলির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা হয়েছে।
আল জাজিরা জানিয়েছে সংস্থাটি মিয়ানমার থেকে সমস্ত কাঠ রপ্তানি তত্ত্বাবধান করে এবং নিলামের মাধ্যমে বেসরকারী সংস্থাগুলির কাছে বিক্রি করে।
২০২১ সালের ২১ এপ্রিল জারি মার্কিন রাজস্ব দপ্তরের নিষেধাজ্ঞা অনুসারে, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান মিয়ানমার টিম্বার এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে সবধরনের আর্থিক লেনদেন নিষিদ্ধ। এটি মিয়ানমারের কাঠ রপ্তানি এবং নিলামের মাধ্যমে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির বিষয়গুলো দেখভাল করে। গত জুনে একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নও।
মিয়ানমারের সবচেয়ে মূল্যবান শিল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম এই সেগুন কাঠ। প্রতি বছর কাঠ রপ্তানি করে কোটি কোটি ডলার আয় করে তারা।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক গ্রুপ এক্সট্রাক্টিভ ইন্ডাস্ট্রিজ ট্রান্সপারেন্সি ইনিশিয়েটিভের তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কাঠ শিল্পের ট্যাক্স ও রয়্যালিটি থেকে প্রায় ১০ কোটি ডলার আয় করেছিল মিয়ানমার সরকার। ওই বছর গোটা বন শিল্প থেকে তাদের আয় ছিল অন্তত ৩২ কোটি ২০ লাখ ডলার।
নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তুলে গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে দেশটির সামরিক বহিনী। এরপর থেকেই বিক্ষোভ-সহিংসতায় উত্তাল দেশটি।
মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে নানামুখি সংকট চলমান রয়েছে। দেশটিতে দারিদ্রতার পরিমাণ এতটাই যে, গত ২০ বছরের মধ্যে দেশটিতে এই পর্যায়ের দারিদ্র্য আর দেখা যায়নি। চলমান বিক্ষোভের পরিস্থিতিতে গভীরতর আর্থিক সংকটে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা দ্রুত গতিতে বাড়ছে। অসংখ্য মানুষের চাকরি হারানো, খাবারের দাম বৃদ্ধি, উৎপাদন ব্যবস্থায় অস্থিতিশীলতা ইত্যাদি কারণে দেশটির নাগরিকদের খাদ্য জোগাড় করতে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে দেশটির হাজার হাজার মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী থাইল্যান্ডে আশ্রয় খুঁজছে।
মিয়ানমারের সংকট দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে, এমনকি এর বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে বৃহৎ সংঘাতে রূপ নিতে পারে বলে সতর্ক করেছেন জাতিসংঘপ্রধান আন্তোনিও গুতেরেস। এমন ‘বহুমুখী বিপর্যয়’ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধভাবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২৮
আপনার মতামত জানানঃ