সফলভাবে শূকরের দেহ থেকে মানবদেহে কিডনি প্রতিস্থাপনের পর এবার নতুন সফলতা পেলেন যুক্তরাষ্ট্রের সার্জনরা। বিশ্বে প্রথমবারের মতো মার্কিন এক রোগীর শরীরে শূকরের হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ৫৭ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি অস্ত্রোপচারের তিনদিন পরও বেশ সুস্থ আছেন। তবে এই রোগীর শরীরে শূকরের হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন করার আগে হৃদপিণ্ডটিকে জেনেটিক্যালি রূপান্তরিত করে নেওয়া হয়। খবর বিবিসির
শূকরের হৃৎপিণ্ড ধারণ করা রোগীর নাম ডেভিড বেনেট। তার শারীরিক অবস্থা ভালো ছিল না। প্রচলিত পদ্ধতিতে মানবদেহ থেকে তিনি অঙ্গ প্রতিস্থাপনে সক্ষম ছিলেন না। তাই তার দেহেই শূকরের হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
বর্তমানে বেনেট ধীরে ধীরে সার্জারির ধকল কাটিয়ে উঠছে।
সার্জারির আগে তিনি বলেছিলেন, ‘পরিস্থিতি এমন, হয় আমি মরব নয়তো অঙ্গ প্রতিস্থাপন করব। আমি বাঁচতে চাই। আমি জানি, পুরো বিষয়টি অন্ধকারে গুলি ছোড়ার মতো। কিন্তু এটাই আমার শেষ সুযোগ।’
তিনি সর্বশেষ কয়েক মাস ধরে শয্যাশায়ী, হার্ট ও লাং বাইপাস মেশিনের ওপর নির্ভর ছিলেন।
আমি সুস্থ হয়ে বিছানা ছাড়ার অপেক্ষায় আছি, এমনটাই বলেছিলেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন থেকে নতুন বছরের শুরুতেই এই সার্জারির অনুমতি দেয়া হয়। এটাই বেনেটের জন্য ছিল বাচার শেষ আশা।
সফল সার্জারি শেষে সার্জারি দলের প্রধান বার্টলে গ্রিফিথ বলেন, ‘অঙ্গ প্রতিস্থাপনে যে সংকট তা কাটাতে আমরা আরও একধাপ এগিয়ে গেলাম। আমরা সাবধানতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা আশাবাদী যে এই সার্জারি ভবিষ্যতে রোগীদের জন্য একটি নতুন সুযোগ তৈরি করবে।’
চিকিৎসকরা বলছেন, সাত ঘণ্টা ধরে পরীক্ষামূলকভাবে এ অস্ত্রোপচার চালানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরে এ অস্ত্রোপচার হয়। অস্ত্রোপচারের তিনদিন পরও ডেভিড বেনেট বেশ সুস্থ রয়েছেন।
ডেভিড বেনেটের জীবন বাঁচাতে চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে এটাই সর্বশেষ চেষ্টা ছিল। তবে দীর্ঘমেয়াদে তিনি কতদিন সুস্থ থাকতে পারবেন, তা এখনও স্পষ্ট করে বলেননি চিকিৎসকরা।
বিশ্বের প্রথম এ ধরনের অস্ত্রোপচার করার জন্য ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড মেডিকেল সেন্টারকে বিশেষ অনুমতি দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসা তদারকি কর্তৃপক্ষ।
মানব হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের জন্য তিনি উপযুক্ত ছিলেন না। সাধারণত রোগীর স্বাস্থ্য অত্যন্ত দুর্বল হলে চিকিৎসকরা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
চিকিৎসকদের যে দল এ অস্ত্রোপচার করেছে, তারা বহু বছর ধরে এ নিয়ে গবেষণা করছিল। এটি সফল হলে সারাবিশ্বের কোটি কোটি মানুষের জীবন বদলে যাবে।
ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড স্কুল অব মেডিসিনে এক বিবৃতিতে সার্জন বার্টলে গ্রিফিথ বলেছেন, ‘অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্বল্পতার সমাধানে এই অস্ত্রোপচার বিশ্বকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
‘অঙ্গ প্রতিস্থাপনে যে সংকট তা কাটাতে আমরা আরও একধাপ এগিয়ে গেলাম। আমরা সাবধানতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা আশাবাদী যে এই সার্জারি ভবিষ্যতে রোগীদের জন্য একটি নতুন সুযোগ তৈরি করবে।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে প্রতিদিন ১৭ জন মানুষ অঙ্গ প্রতিস্থাপনের আশায় থাকতে থাকতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। দেশটিতে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের অপেক্ষমাণ তালিকায় এক লাখের বেশি মানুষ রয়েছে।
চিকিৎসাক্ষেত্রে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের চাহিদা মেটাতে জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন নামে প্রাণীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবহারের বিষয়ে অনেকদিন ধরেই গবেষণা চলছে। হৃৎপিণ্ডে শুকরের ভাল্ব ব্যবহার এখন অনেকটা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে উঠেছে।
এর আগে গত বছরের অক্টোবরে নিউইয়র্কের চিকিৎসকরা ঘোষণা করেন যে, তারা একজন ব্যক্তির দেহে সফলভাবে শুকরের কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন।
তবে যার দেহে সেটি স্থাপন করা হয়েছিল, তিনি কোমায় (ব্রেইন ডেড) চলে যান এবং সেখান থেকে তার সুস্থ হয়ে ওঠার আর কোন আশা ছিল না।
তবে বেনেটকে নিয়ে সবাই আশাবাদী, তিনি আবার সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করতে পারবেন।
অস্ত্রোপচারের ছয় সপ্তাহ আগে গুরুতর হৃদরোগ শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই বেনেট ছিলেন শয্যাশায়ী। দেহের সাথে সংযুক্ত একটি যন্ত্র তাকে বেঁচে থাকতে সহায়তা করছে।
প্রতিস্থাপনের পর থেকে তাকে সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
এএফপি নিউজ এজেন্সির খবর অনুযায়ী, শুকরের হৃদপিণ্ডটিকে জিনগতভাবে রূপান্তর করা হয়েছে। কারণ সেখানে এমন কিছু জিন ছিল, যা মানবদেহে প্রতিস্থাপনে বাধা দিতে পারে।
গ্রিফিথ জানিয়েছেন, তারা খুবই সতর্কতার সঙ্গে বেনেটকে পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এর আগে মানবদেহে এমন অস্ত্রোপচার করিনি। থেরাপি বেনেটকে যা দিতে পারতো, আমরা তার চেয়ে ভালো একটি বিকল্প দিতে পেরেছি। অন্তত আমি এটাই বিশ্বাস করি। তবে তিনি একদিন, এক সপ্তাহ, মাস, নাকি বছর বেঁচে থাকবেন, আমি তা জানি না’।
অন্যদিকে বেনেটের ছেলে ডেভিড বেনেট জুনিয়র অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে তাদের পক্ষে কিছুই বোঝা বা বলা সম্ভব নয়।
শূকরটি সম্পর্কে যা জানা গেছে
শূকরটি স্বাভাবিক কোনো শূকর নয়। তাকে দীর্ঘ মেয়াদে জিন এডিটিংয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। যেসব জীনের কারণে মানবদেহ শূকরের হৃৎপিণ্ড গ্রহণে বাধাপ্রাপ্ত হয়, সেসব জীন সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
বরঞ্চ ১০টি জিন এডিটিংয়ের মাধ্যমে মানবদেহে প্রতিস্থাপিত হৃৎপিণ্ড গ্রহণের জন্য সহায়ক ৬টি জীনকে শূকরের দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পাদন করেছে ভার্জিনিয়ার বায়োটেক ফার্ম রিভিসর, এর আগেও একজন মস্তিষ্ক অচল রোগীর দেহে শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপনের সময় সেই কিডনিও তারাই দেয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১৩
আপনার মতামত জানানঃ