গত কয়েক বছর ধরে চলে আসা অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে করোনা অতিমারির প্রভাব যোগ হওয়ায় শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি এখন অনেকটাই বিপর্যস্ত। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সে ব্যাপকভাবে কমে আসার পাশাপাশি পর্যটন খাতে ধস নেমেছে। চলতি বছর এরই মধ্যে এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে দেশটিকে। ফলে গত জুন মাস শেষে শ্রীলঙ্কার বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ চার বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যা দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয়ও মেটানো যাবে না।
বড় ধরনের আর্থিক ও মানবিক সংকটের মুখোমুখি শ্রীলঙ্কা । অর্থনৈতিক সংকট ও ঋণের বোঝায় যখন নিমজ্জিত শ্রীলঙ্কা, তখন দেশটিতে সফরে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। এ অবস্থায় চীনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধে আরও সময় চেয়েছে শ্রীলঙ্কা। এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান।
শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় ঋণদাতা চীন। চীনের কাছে তাদের অপরিশোধিত ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি। বেইজিং-এর কাছে কলম্বোর ৫০০ কোটি ডলার দেনা রয়েছে। গত বছর আরও ১০০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে কলম্বো। আগামী ১২ মাসে সরকারি ও বেসরকারি খাতকে দেশি ও বিদেশি ঋণ শোধ করতে হবে ৭৩০ কোটি ডলার। এরমধ্যে জানুয়ারিতেই আন্তর্জাতিক বন্ডের জন্য ৫০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। যদিও নভেম্বর পর্যন্ত দেশটির বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ১৬০ কোটি ডলার।
ঋণের ঝোঝায় শ্রীলঙ্কা যখন জর্জরিত, তখন দেশটিতে সফরে এসেছেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সাক্ষাৎ করেছেন লঙ্কা প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসের সঙ্গে। বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসে ও প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দ রাজাপাকসের কার্যালয় জানিয়েছে, করোনা মহামারি পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকট কারণে ঋণ পরিশোধে আরও সময় বাড়ানো হলে এটি বড় স্বস্তির কারণ হবে। এ বিষয়ে রাজধানী কলম্বোয় অবস্থিত চীনের দূতাবাস থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
অর্থনৈতিক এই পতনের মুখোমুখি থাকা সরকারের নেতৃত্বে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসা। এই সংকটের জন্য করোনাভাইরাস মহামারি আংশিকভাবে দায়ী। পর্যটন খাতের লোকসানেরও ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে উচ্চ ব্যয় ও কর কর্তনের ফলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে রাজস্ব কমেছে, চীনের কাছে বড় ঋণ এবং কয়েক দশকের মধ্যে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। দেশি ঋণ ও বিদেশি বন্ডের টাকা শোধ করতে সরকার টাকা ছাপানোর ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুসারে, মহামারির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ৫ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে এসেছে সেখানে।
নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ১১.১ শতাংশ ছুঁয়েছিল। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে একসময় সচ্ছল মানুষেরাও তাদের পরিবারের ভরণপোষণে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার সামর্থ্যও নেই। রাজাপাকসা অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর সেনাবাহিনীকে চাল ও চিনির মতো আবশ্যক পণ্য বিতরণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে এতে জনগণের দুর্দশা বিন্দুমাত্র কমেনি।
পরিস্থিতি এত খারাপ হয়েছে যে প্রতি চার জনের একজন পাসপোর্ট অফিসে ভিড় জমাচ্ছেন। বেশিরভাগ তরুণ ও শিক্ষিত। তারা দেশ ছাড়তে চান। বয়স্কদের কাছে এটি ১৯৭০-এর দশকের মতো। যখন আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও দেশে উৎপাদন ঘাটতির কারণে রুটি, দুধ ও চালের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হতো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ডব্লিউএ বিজেওয়ার্ডেনা সতর্ক করে বলছেন, সাধারণ মানুষের দৈন্যদশা আর্থিক সংকটকে আরও গভীর করতে পারে। ফলে তাদের জীবন-জীবিকা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।
তিনি বলেন, যখন মানুষের আর্থিক সংকট মোচনের অযোগ্য হয়ে যায় তখন দেশও যে অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে তা অনিবার্য। উভয় ক্ষেত্রেই কম উৎপাদন এবং বিদেশি মুদ্রার ঘাটতির কারণে আমদানিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে খাদ্য নিরাপত্তা হ্রাস পায়। তখন তা একটি মানবিক সংকটে পরিণত হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর অজিত নিভার্দ চাবরাল ঋণ পরিশোধের বিষয়ে জনগণকে আশ্বস্ত করলেও বিজেওয়ার্ডেনা বলছেন, ঋণ পরিশোধে দেশ খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। যেটির ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিণতি থাকবে।
করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কায় ২০২০ সালে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছিল রেকর্ড ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এসময় তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও ঘাটতি দেখা দেয়। ২০১৯ সালে যেখানে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল সাড়ে সাতশ কোটি ডলার, তা কমতে কমতে চলতি বছরের জুলাইয়ে এসে দাঁড়ায় মাত্র ২৮০ কোটি ডলারে।
২০১৭ সালে, শ্রীলঙ্কা আরো চীনা বিনিয়োগের বিনিময়ে এই বন্দরের ৭০% শতাংশ নিয়ন্ত্রণ চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চায়না মার্চেন্টস কোম্পানির কাছে ৯৯ বছরের জন্য ছেড়ে দিতে সম্মত হয়েছে।
এ অবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের লক্ষ্যে গত বছরের মার্চ মাসে গাড়ি, ভোজ্যতেল, হলুদসহ বেশ কিছু পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করে লঙ্কান সরকার। স্থানীয় আমদানিকাররা জানিয়েছেন, তারা ডলার জোগাড় করতে না পারায় খাদ্য-ওষুধের মতো অনুমোদিত পণ্যও কিনতে পারছেন না। লঙ্কান জ্বালানিমন্ত্রী উদয় গামনপিলা গাড়িচালকদের কম জ্বালানি তেল ব্যবহারের অনুরোধ জানিয়েছেন, যেন সেখান থেকে বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচিয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও টিকা কেনা যায়।
বাস্তব চিত্র হলো শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি এরই মধ্যে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এরই মধ্যে দেশটিতে প্রধান খাদ্যপণ্য চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছে। পরিস্থিতি সামলাতে বর্তমানে মিলারদের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে চালের সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করে দেয়ার কথা ভাবছে শ্রীলঙ্কার সরকার। একই সঙ্গে বাড়তি দামে চাল বিক্রির অভিযোগ প্রমাণ হলে শাস্তির মাত্রা বাড়ানোরও পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
দরিদ্র দেশগুলোকে চীন যেভাবে ঋণ দিচ্ছে তার কারণে দেশটির সমালোচনা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে যে এই ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে সেসব দেশ হিমশিম খাচ্ছে এবং এর ফলে তারা বেইজিং-এর কাছ থেকে চাপের মুখেও পড়ছে।
তবে চীন এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলছে, তাদের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার জন্য পশ্চিমের কিছু কিছু দেশ এধরনের বক্তব্য প্রচার করছে।
তারা বলছে, ‘এমন একটি দেশও নেই যারা চীনের কাছ থেকে অর্থ ধার করার কারণে তথাকথিত ‘ঋণের ফাঁদে’ পড়েছে’।
দাবি করা হয় যে চীন অন্যান্য দেশকে ঋণ হিসেবে অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকে যারা সেই ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে তাদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বা অধিকার ছেড়ে দেয়। তবে চীন এই অভিযোগ বহু কাল ধরে অস্বীকার করে আসছে।
চীনের সমালোচকরা এব্যাপারে প্রায়শ যে দেশটির উদাহরণ দেয় তা হচ্ছে শ্রীলঙ্কা। এই দেশটি কয়েক বছর আগে চীনা বিনিয়োগের মাধ্যমে হাম্বানটোটায় একটি বৃহৎ আকারের বন্দর নির্মাণের প্রকল্প শুরু করেছে।
কিন্তু কয়েক’শ কোটি ডলারের এই প্রকল্প, যাতে চীনের ঋণ এবং ঠিকাদার ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটিকে ঘিরে ইতোমধ্যে বহু বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এই প্রকল্প কতোটা বাস্তবায়নযোগ্য সেটা প্রমাণ করাও এখন বেশ কঠিন। এর ফলে শ্রীলঙ্কা ক্রমবর্ধমান ঋণের চাপে জর্জরিত হয়ে পড়েছে।
শেষ পর্যন্ত, ২০১৭ সালে, শ্রীলঙ্কা আরো চীনা বিনিয়োগের বিনিময়ে এই বন্দরের ৭০% শতাংশ নিয়ন্ত্রণ চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চায়না মার্চেন্টস কোম্পানির কাছে ৯৯ বছরের জন্য ছেড়ে দিতে সম্মত হয়েছে।
এই বন্দর প্রকল্পের উপর যুক্তরাজ্যের গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাটাম হাউজের বিশ্লেষণে এটিকে ‘ঋণের ফাঁদ’ বলা যাবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বলা হচ্ছে, স্থানীয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, এবং চীন কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে এই বন্দরের মালিকানা গ্রহণ করেনি।
চ্যাটাম হাউজের গবেষণায় বলা হচ্ছে, শ্রীলঙ্কার মোট ঋণের একটা বড় অংশ চীনের বাইরে অন্যান্য ঋণদাতাদের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে। এছাড়াও চীন যে এই বন্দরের অবস্থান থেকে কৌশলগত সামরিক সুবিধা নিয়েছে তার পক্ষেও কোনো প্রমাণ নেই।
তা সত্ত্বেও গত এক দশকে শ্রীলঙ্কায় যে চীনের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ বেড়েছে তা নিয়ে খুব সামান্যই সন্দেহ রয়েছে। এবং এই অঞ্চলে চীন তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে যে এটিকে ব্যবহার করতে পারে—দেশটিতে এমন উদ্বেগও রয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৩৩
আপনার মতামত জানানঃ